মোঃ শহীদুল্লাহ মানসুর
মোঃ শহীদুল্লাহ মানসুর

কোর্ট ম্যারিজের কোন আইনগত ভিত্তি আছে কি?

অনেক তরুণ-তরুণীর ভুল ধারণা যে, শুধুমাত্র এফিডেভিট করে বিয়ে করলে বন্ধন শক্ত ও নিরাপদ হয়। কাজী অফিসে বিয়ে করলে মোটা অঙ্কের ফিস দিতে হয় তাই কোর্ট ম্যারেজকে অধিকতর সহজ ও ভাল মনে করেন তাঁরা। কিন্তু কোনো বিয়ে যদি কাজী অফিসে নিবন্ধন না করা হয় তাহলে সেই বিয়ের আইনগত কোনো ভিত্তি থাকে না। বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন মোঃ শহীদুল্লাহ মানসুর

পরিবারের মতে বা মতের বিরুদ্ধে কোনো যুবক-যুবতী বা নারী-পুরুষ স্বামী-স্ত্রী হিসেবে একত্রে বসবাস করার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে যেকোন ম্যাজিষ্ট্রেট (১ম/২য়/৩য় শ্রেণীর) অথবা নোটারী পাবলিকের কার্যালয়ে যে হলফনামা সম্পাদন করে তা-ই `কোর্ট ম্যারেজ` নামে পরিচিত। বিয়ের প্রমাণ হিসেবে আলাদাভাবে এর কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। কোনো বিয়ে যদি কাজী অফিসে নিবন্ধন না করা হয় তাহলে সেই বিয়ের আইনগত কোনো ভিত্তি থাকেনা। নিবন্ধন বা রেজিস্ট্রেশন ছাড়া স্বামী-স্ত্রী হিসাবে বসবাস চলাকালীন সময়ে যদি কোনো একপক্ষ অন্যপক্ষকে ত্যাগ করে তাহলে সেখানে আইনগত কোনো প্রতিকার পাওয়া যায় না। এফিডেভিট বা হলফনামা শুধুই একটি ঘোষণাপত্র। এর ব্যতিরেকে হলফনামার গুরুত্ব নেই।

কোর্ট ম্যারিজের কোন আইনগত ভিত্তি আছে কি

রাফিক ও সুমনা (দুটোই ছদ্মনাম) নোটারী পাবলিক কার্যালয়ে গিয়ে ‘কোর্ট ম্যারেজ’ করেছিল বছরখানেক আগে। কিন্তু তারা বিয়ের আগে বা পরে কাবিন রেজিষ্ট্রী করেনি। বিয়ের বছর না পেরুতেই রফিক সুমনার সঙ্গে তার বিয়ের কথা অস্বীকার করে। সুতরাং রফিক মোহরানা, ভরণ-পোষণ ও দাম্পত্য অধিকার দিতে রাজি নন। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়াতে বাধ্য হয় সুমনা। কিন্তু কোর্ট ম্যারেজের প্রধান দুর্বলতা হলো, কাবিন রেজিষ্ট্রী করা না হলে স্ত্রী তাঁর মোহরানা আদায় করতে ব্যর্থ হবে। বরং আইন অনুযায়ী বিয়ে হয়েছে তা প্রমাণ করাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে কোর্ট ম্যারেজের কোন বৈধতা দেওয়া হয়নি, এমনকি এর কোন আনুষ্ঠানিক অস্তিত্বও নেই। ফলে প্রতিকারও পাওয়া যায়নি।

কখন এফিডেভিট করা যায়

আইন অনুযায়ী কাবিন রেজিষ্ট্রী ও বিয়ের আনুষ্ঠিকতা সম্পন্ন করে বিস্তর ঘোষণার জন্য এফিডেভিট করা যাবে। মুসলিম বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) বিধিমালা ২০০৯ -এর ২২ (২ ও ৩) ধারা অনুযায়ী, নিকাহ রেজিস্ট্রার স্বয়ং বিবাহ সম্পন্ন করলে, তিনি নিকাহ রেজিস্টারের সংশ্লিষ্ট কলামসমূহ পূরণ করবেন বা নিকাহ রেজিস্ট্রার ব্যতীত অন্যকোন বিবাহ সম্পন্ন করা হলে, উক্ত ব্যক্তি যিনি নিকাহ সম্পন্ন করেছেন তিনি বিবাহের পনের দিনের মধ্যে উক্ত এলাকার নিকাহ রেজিস্ট্রারকে বিষয়টি অবহিত করবেন এবং নিকাহ রেজিস্টার কলামপূরণ-পূর্বক রেজিস্টারে যে সকল ব্যক্তির স্বাক্ষর লাগবে তাদের স্বাক্ষর গ্রহণ করবেন। এরপর এফিডেভিট করা যায়, যার আইনগত মূল্য রয়েছে।

তবে এক্ষেত্রে লাইসেন্সবিহীন কাজীর নিকট বিয়ে রেজিষ্ট্রী করলে এর কোন আইনত মূল্য নেই। ব্যাখ্যা:“নিকাহ্‌ রেজিষ্ট্রার” অর্থ Muslim Marriages and Divorces (Registration) Act, 1974 এর অধীন লাইসেন্সপ্রাপ্ত নিকাহ্‌ রেজিষ্ট্রার এবং Christian Marriage Act, 1872, Special Marriage Act, 1872 ও হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন, ২০১২ –এর অধীন নিয়োগপ্রাপ্ত নিকাহ্‌ রেজিষ্ট্রার।

যেভাবে এফিডেভিট বা হলফনামা তৈরী করতে হয়

পঞ্চাশ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে নোটারি পাবলিকের কার্যালয়ে কিংবা একশত পঞ্চাশ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে কোন ম্যাজিষ্ট্রেটের (১ম/২য়/৩য় শ্রেণীর) কাছে করা হয়। এফিডেভিট বা হলফনামা শুধু একটি ঘোষণাপত্র।

বিবাহ রেজিস্ট্রেশন না করার শাস্তি

মুসলিম বিবাহ ও বিচ্ছেদ আইন ১৯৭৪, এর ধারা ৫ অনুযায়ী আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক সকল বিবাহ আইন অনুযায়ী সকল পদ্ধতি মেনে যথাসময়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। যদি কেউ রেজিস্ট্রেশন না করেন তবে সর্বোচ্চ শাস্তি (তিন) মাসের কারাদন্ড বা পাঁচশত টাকা জরিমানা অথবা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

রেজিস্ট্রেশন না করলে প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা

বিয়ে রেজিস্ট্রেশন না করে শুধুমাত্র হলফনামায় ঘোষণা দিয়ে ঘর-সংসার প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। আনুষ্ঠানিক বিয়েতে মোটা অঙ্কের টাকা খরচ হয় বলে কোর্ট ম্যারেজকে অধিকতর ভাল মনে করছে অনেকেই। আবার অনেকেই একাধিক বিয়ের কথা গোপন করার জন্য এফিডেবিটের মাধ্যমে বিয়ে সম্পাদন করে। দেখা যায় কোন একপক্ষ অপর পক্ষকে জিম্মি করে টাকা আদায় কিংবা সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্যও এফিডেভিটের মাধ্যমে ভূয়া বিয়ের দলিল করে থাকে। এফিডেভিটের মতো দলিল খুব সহজেই তৈরি করা যায় এবং এফিডেভিট বা হলফনামা প্রার্থীকে ম্যাজিস্ট্রেট বা নোটারি পাবলিকের কাছে হাজির হতে হয়না ফলে কম বয়সী ছেলে-মেয়েদের ক্ষেত্রে বয়স বাড়িয়ে দেয়ার সুযোগ থাকে। সুতরাং রেজিস্ট্রেশন ছাড়া শুধুমাত্র এফিডেভিটের মাধ্যমে বিয়ে করতে চাইলে তা বৈধ্য হবেই না বরং প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনাই অনেক বেশি।

বৈবাহিক প্রতারণা বন্ধে পদক্ষেপ

  • বর-কনের পরিচয় দানকারীর পূর্ণাঙ্গ নাম, ঠিকানা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন ফরম পূরন করতে হবে।
  • রেজিস্ট্রেশন ছাড়া শুধুমাত্র কোর্ট ম্যারেজের নামে এফিডেভিটের বিয়ে বন্ধ করতে হবে।
  • অনেক ক্ষেত্রে স্ত্রী বা স্বামী থাকা সত্ত্বেও তা গোপন করে একাধিক বিবাহ করে। এক্ষেত্রে বিয়ের আগেই ভালভাবে খোঁজখবর নিয়ে বিয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
  • আইনে নাবালক কিংবা শিশুর বয়স সম্পর্কে সুস্পষ্ট সংজ্ঞা নেই। একাধিক আইনে ভিন্ন ভিন্ন সংজ্ঞা থাকলেও বিয়ের ক্ষেত্রে ১৮ (মেয়ে) ও ২১ (ছেলে) মেনেই বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। কোনোভাবেই বাল্যবিবাহের মতো আইন বিরোধী কাজ করা যাবে না। এতে অনেক তথ্য গোপন করতে হয় যা পরবর্তিতে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করে এবং প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।
  • কোনো ভাবেই অপহরণ ও ভয়-ভীতির মাধ্যমে সৃষ্ট বিবাহ রেজিস্ট্রি করা যাবে না।
  • জন্ম নিবন্ধন সার্টিফিকেট ও ভোটার আইডি (জাতীয় পরিচয়পত্র বা এনআইডি) নাম্বার কাবিননামায় উল্লেখ করতে হবে।
  • বিয়েতে উভয়পক্ষের একাধিক সুস্থ, সবল ব্যক্তি এবং নিকাহ রেজিস্ট্রার ও মৌলভী সাক্ষী হিসাবে থাকতে হবে।
  • বিয়ের ১৫ দিনের মধ্যে বিয়ে নিবন্ধন করতে হবে।
  • কাবিননামায় দেনমোহর সম্পর্কে বিস্তারিত ও স্পষ্ট বর্ণনা থাকা লাগবে।
  • পক্ষগণ চাইলে আনুষ্ঠানিক বিয়েও রেজিস্ট্রি করার পর এফিডেভিট বা হলফনামা করতে পারেন।

মোঃ শহীদুল্লাহ মানসুর: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি