মিন্নির ফাঁসির দণ্ড এবং ‘ফিমেল ক্রিমিনালিটি’

সাঈদ আহসান খালিদ: বরগুনার রিফাত হত্যা মামলার রায়ে মিন্নির মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়েছে। চাঞ্চল্যকর এই মামলার শুরুর দিকে মিডিয়া ও জনগণের দৃষ্টিতে মিন্নি একজন প্রেমময়ী ও দায়িত্ববান স্ত্রীরূপে চিহ্নিত হয়েছিল যে স্বামী রিফাতের জীবন বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। পরবর্তী ঘটনা পরম্পরায় ও তদন্তে মিন্নির নাম হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী হিশেবে ওঠে আসে যা নিম্ন আদালতের বিচারিক রায়ে আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো।

হত্যাকাণ্ডের মূল ষড়যন্ত্রকারী মিন্নি বেঁচে আছে, আইনের আশ্রয়ে আছে, পরবর্তী আপিলে মিন্নির দণ্ড হ্রাস, মওকুফ এমনকি বেকসুর খালাস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও বহাল আছে। মিন্নির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলে বরং সেটিই হবে বাংলাদেশের বিচারিক ইতিহাসে একটি অভূতপূর্ব ও ব্যতিক্রমী ঘটনা।

স্বাধীনতা পরবর্তী বিগত ৪৯ বছরের ইতিহাসে আজ অব্দি বাংলাদেশে কোন মৃত্যদণ্ডপ্রাপ্ত নারীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়নি, বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ পাওয়া নারীদের সবাই উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগে এসে মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পেয়ে গেছেন, আপিল বিভাগ কোন নারীর মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বহাল রাখেন নি, অভিযুক্তরা হয় খালাস পেয়ে গেছেন নয় তো তারা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করেছেন। ফলে আজ অব্দি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষার জন্যও আবেদন পাঠানোর প্রয়োজন হয়নি কোন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত নারী অপরাধীর!

২০০৭ সালে কাশিমপুরে দেশের একমাত্র যে কেন্দ্রীয় মহিলা কারাগার উদ্বোধন করা হয়েছে সেখানে কোন ফাঁসির মঞ্চ ই তৈরি করা হয়নি! নারী অপরাধীর ফাঁসি কার্যকরই যেহেতু হয় না; মঞ্চ বানিয়ে কী লাভ- এই বিবেচনা হয়তো কাজ করেছে।

অন্যদিকে, এই মামলায় আরেকজন অভিযুক্ত- মিন্নির প্রেমিক মতান্তরে স্বামী- ‘নয়ন বন্ড’ এর মৃত্যুদণ্ড এই মামলার রায় হওয়ার বহু আগেই ‘বিচার বহির্ভূত’ পন্থায় দ্রুততম সময়ে ‘কার্যকর’ করা হয়েছে, ক্রসফায়ারে নিহত নয়ন বন্ড ইতোমধ্যে কবরে চলে গেছে কিন্তু সে আসলেই দোষী ছিল কি ছিল না- আইনি তদন্ত ও বিচারিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সেটি জানার আর কোন সুযোগ নেই। নয়ন বন্ডকে যে ‘জুডিসিয়াল ট্রায়াল’ এর আগেই মৃত্যুবরণ করতে হলো সেটির দায় এই ঘটনার ‘মিডিয়া ট্রায়াল’-এ অংশ নেওয়া মানুষদেরও কি নেই? এরাই তো প্রচণ্ড উচ্চস্বরে চিৎকার করে দাবি জানিয়েছিল- ‘ক্রসফায়ার দেওয়া হোক, মেরে ফেলা হোক’, বন্দুকযুদ্ধে নয়ন বন্ডের মৃত্যু সেই পপুলিস্ট (জনপ্রিয়) দাবির বাস্তবায়ন মাত্র।

আমরা সাদাচোখে ঘটনা যেভাবে দেখি- আইনের চোখে সেটির যে সম্পূর্ণ ভিন্ন এমনকি বিপরীত চিত্র ধরা পড়তে পারে- রিফাত হত্যা মামলায় মিন্নির ফাঁসির আদেশ সেটির জ্বলন্ত উদাহরণ। পপুলিস্ট ভিউ এবং লিগ্যাল ভিউ-র ভিন্নতা ও সাংঘর্ষিক অবস্থান এই মামলায় আরো পরিস্ফুটিত হলো। যে ঘটনায় আইনের প্রশ্ন জড়িত সেখানে পপুলিস্ট ভিউকে গুরুত্বারোপ করলে ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন এভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

চূড়ান্ত পর্যায়ে মিন্নির ফাঁসির দণ্ড কার্যকর না হওয়ার সমস্ত সম্ভাবনা সত্ত্বেও বরগুনার রিফাত হত্যা মামলাটির এই রায় আইন ও অপরাধবিজ্ঞানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হবে। কারণ এই রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের আইন ব্যবস্থায় অনালোচিত ও উপেক্ষায় থাকা ‘ফিমেল ক্রিমিনালিটি’ তত্ত্বের একটি প্রায়োগিক উদাহরণ সৃষ্টি হলো।

আমাদের ঔপনিবেশিক আইনব্যবস্থা নারীকে ‘অপরাধী’র তুলনায় ‘ভিক্টিম’ হিসেবে দেখতে এবং দেখাতে অভ্যস্ত। ‘অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীরা ভিক্টিম’- এই সত্য স্বীকার করেও কোন কোন নারী যে পুরুষের সমান এমনকি পুরুষের চেয়েও ভয়ঙ্কর অপরাধী হতে পারে- এই সম্পূরক বাস্তবতাটির আইনগত স্বীকৃতিও প্রয়োগ প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে শুধু অপ্রাপ্তবয়স্ক, অসুস্থ ও গর্ভবতী নারী ব্যতীত অন্যান্য সকল সুস্থ ও সবল নারী অপরাধীকে স্রেফ জেন্ডারের ভিত্তিতে নির্বিচারে ‘অবলা’ বিবেচনা করা, আইন প্রণয়ন, বিচারিক কার্যক্রম কিংবা দণ্ড কার্যকরের ক্ষেত্রে শৈথিল্য প্রদর্শন করা বাংলাদেশে ‘ফিমেল ক্রিমিনালিটি’র ক্রমবর্ধমান প্রবণতাকে অস্বীকার বুঝায় এবং এটি ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।

রিফাত হত্যা মামলার এই রায় ‘ফিমেল ক্রিমিনালিটি’র পাশাপাশি আইনের প্রয়োগ, বিচার ও দণ্ড কার্যকরের ক্ষেত্রে ‘লিঙ্গ নিরপেক্ষতা’ বা জেন্ডার নিউট্রালিটি-র প্রশ্নকে একাডেমিক ডিসকোর্সে নিশ্চয় এখন থেকে আরো প্রাসঙ্গিক করে তুলবে।

সাঈদ আহসান খালিদ: সহকারী অধ্যাপক; আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।