মোঃ জিশান মাহমুদ, তাসনুভা কায়সার, সুনয়না নিঝুম শান্তা,

অপরাধ প্রবণতা ও ধর্ষণ

ধর্ষণ শব্দটি বর্তমানে বহুল আলোচিত শব্দ। টিভি সংবাদ, খবরের কাগজ, অনলাইন পোর্টাল সহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রতিদিনই চোখে পড়ছে ধর্ষণের নানা খবর। সাধারণত, একজন ব্যক্তির অনুমতি ব্যতিরেকে তার সঙ্গে যৌনসঙ্গম বা অন্য কোনো ধরনের যৌন অনুপ্রবেশ ঘটানোকে ধর্ষণ বলা হয়। ভিন্ন ভিন্ন ঐতিহাসিক যুগ ও ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতিতেও ধর্ষণের সংজ্ঞার ক্ষেত্রে ভিন্নতা দেখা দিয়েছে [Smith, ed. by Merril D. (২০০৪)। Encyclopedia of Rape (1. publ. সংস্করণ)।] ২০১২ সালের পূর্ব পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) ধর্ষণকে কেবল নারীদের বিরুদ্ধে পুরুষদের দ্বারা সংঘটিত একটি অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করত। ২০১২ সালে তারা ধর্ষণের সংজ্ঞা হিসেবে “কোনো নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বলপূর্বক তার সঙ্গে যৌনসঙ্গম”-এর পরিবর্তে “ভুক্তভোগীর অনুমতি ছাড়া যোনি বা পায়ুতে শরীরের কোনো অংশ বা কোনো বস্তু দ্বারা অনুপ্রবেশ কিংবা অন্য কোনো ব্যক্তির যৌনাঙ্গ দ্বারা মুখে অনুপ্রবেশ”-কে গ্রহণ করে।

বিভিন্ন ধর্ম যৌন কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে বা নির্দিষ্ট যৌন সংক্রমিত কর্ম বা চিন্তাধারার জন্য আদর্শ মান নির্ধারণ করে। সৃষ্টির শুরু থেকেই পুরুষ নারীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে আসছে। প্রত্যেকেই বিপরীত লিঙ্গের দিকে ধাবিত হয়। ইসলাম ধর্মে তা নিষেধ করে নি। তবে এখানে বেশ কিছু নীতিমালা প্রদান করা হয়েছে। পশুদের মত যৌনকামনা পূরণ করার অধিকার দেওয়া হয় নি। এখানে বিবাহের ব্যবস্থা রয়েছে। বিবাহের মাধ্যমে একজন পুরুষ কোন মহিলাকে অধিকার করতে পারবে। অন্যায় ভাবে যৌনক্রিয়া করাকে যিনা বলে। ইসলামে ইহাকে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে এবং কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, “ব্যভিচারের দায়ে অভিযুক্ত পুরুষ ও নারী যারা,- তাদের প্রত্যেককে একশত বেত্রাঘাত প্রদান কর: তাদের বিষয়ে করুণা যেন তোমাদেরকে দুর্বল না করে।” —(সূরা আন-নুর, আয়াত ২)। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন- “তোমরা ব্যাভিচারের কাছে ও যেয়োনা নিশ্চয় তা অশ্লীল কাজ ও মন্দ পথ” (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত-৩২)। তিনি আরো বলেন- “লজ্জাহীনতার যত পন্থা আছে এর নিকটে ও যেওনা তা প্রকাশ্যে হোক বা গোপনে হোক” (সুরা আনআম, আয়াত-১৫১)।

মানুষ কুকুর নয় যে, মেয়ে দেখলেই তাকে ধর্ষণ করবে। তবে মানুষের মধ্যে পশুত্ব আছে। বিখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্ট ফ্রয়েড বলেছিলেন, মানুষের মন মূলত তিনটি সত্ত্বার সমন্বয়ে গঠিত – ইড, ইগো এবং সুপার ইগো। উদাহরণ দিচ্ছি- পর্ণ মুভি দেখতে চমৎকার, অতএব পর্ণ দেখ (ইড); পর্ণ মুভি দেখা নৈতিকতা বিরোধী, মানুষ এটাকে খারাপ বলবে, অতএব দেখা যাবে না (সুপার ইগো); লুকিয়ে পর্ণ মুভি দেখ, অসুবিধা কী? মানুষ তো জানবে না, আর মনের চাহিদা ও মিটল (ইগো, ব্যালেন্স করতেছে দুই দিক) মেয়েটি সুন্দরী, অতএব ওকে ইভটিজিং বা রেইপ করো (ইড) রেইপ, ইভটিজিং অপরাধ, অতএব করা যাবে না (সুপার ইগো) মেয়েটির সাথে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করো, সম্ভব হলে প্রেমের প্রস্তাব দাও, মন পাওয়ার চেষ্টা করো, মন পেলে শরীর কোন এক সময় পাবে (ইগো)
ইড, ইগো এবং সুপার ইগোর আপেক্ষিক তীব্রতা স্থিতিশীল নয় বরং পারিপার্শিকতার সাথে পরিবর্তনশীল। যেমন সুপার ইগো তথা বিবেক অসুস্থ হয়ে গেলে তখন সে তার অন্যায় কাজে বাধা দিতে পারে না। [ধর্ষণ কেন হয়? একটি মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা, ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াস, দৈনিক যুগান্তর, প্রকাশঃ ০৭ এপ্রিল ২০১৮]

ফ্রয়েডের সূত্র ধরে বলা যায় মানুষের বিবেক, নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ এর অবক্ষয়ের কারণে সামাজিক অস্থিরতা বেড়ে চলছে। আজ থেকে ২০-২৫ বছর আগেও দেখা যেত কেউ একজন অনৈতিক কাজে জড়িত থাকলে তাঁকে অনেকেই এড়িয়ে চলছেন। এমনকি যিনি অন্যায় বা অপরাধ করতেন, তিনি নিজেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অন্যদের এড়িয়ে চলতেন। অন্যদিকে গণ্যমান্য ব্যক্তি, শিক্ষক কিংবা বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ ভালো হওয়ার পরামর্শ দিতেন। বয়স্ক ব্যক্তি, শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি, আইন কর্মকর্তাদের সবাই সম্মান করতেন। কিন্তু ২০২০ সালে এসে আমাদের খুঁজতে হয় সম্মান ও নীতির ব্যাপারটার আদৌ কোনো অস্তিত্ব আছে কি না। অথবা এর প্রয়োজনীয়তা ও ব্যবহারের ক্ষেত্র কোনটি। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ার প্রথম ধাপ ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র, যেখানে প্রত্যেকের একটা নির্দিষ্ট ভূমিকা থাকে। একসময় পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি নৈতিকতা, আদর্শ, আচার-আচরণ শেখানো হতো। এখন প্রায়ই দেখা যায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থীর যৌন হয়রানি ঘটনা। শিক্ষক যখন এ রকম কুকর্মে লিপ্ত থাকেন, সেই শিক্ষকের কাছ থেকে নৈতিকতা শেখার কোনো সুযোগ নেই। অভিভাবক যখন তাঁদের ছেলেমেয়েকে অনৈতিক পন্থায় পরীক্ষায় পাস বা সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার জন্য সমর্থন করেন, তখন ছেলেমেয়েদের মধ্যে নৈতিকতার কোনো বিকাশ হবে না, এটাই স্বাভাবিক। একটা সময় ছিল যখন মানুষের মত মানুষ হওয়ার জন্য মানুষ পড়াশোনা করতো এখন শুধু সার্টিফিকেটের জন্য মানুষ শুধু পড়াশোনা করে। যখন থেকে মানুষ, মানুষের প্রযোজিত ভণ্ডামি, প্রতারণা, শক্তি ও ক্ষমতা সত্য ভাবা শুরু করেছে তখন থেকেই মানুষের বিবেক, নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ ক্ষয় হয়েছে।

বাংলাদেশ এখন সবচেয়ে ধর্ষণপ্রবন সমাজের একটি; ধর্ষণের সব সংবাদ অবশ্য জানা যায় না; সামাজিক কলঙ্কের ভয়ে ধর্ষিতারাই তা চেপে রাখে; কিন্তু যতটুকু প্রকাশ পায় তাতেই শিউরে উঠতে হয়। বাংলাদেশে ধর্ষণ সবচেয়ে বিকশিত সামাজিক কর্মকান্ড, পৃথিবীতে যার কোনো তুলনা মেলে না। বাংলাদেশে এককভাবে ধর্ষণ করা হয় এবং দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করা হয়; এবং ধর্ষণের পর ঠান্ডা মাথায় খুনও করা হয়। এখানে পিতা ধর্ষণ করে কন্যাকে (কয়েক বছর আগে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফিরে এক পিতা ধর্ষণ করে তার তিন কন্যাকে), জামাতা ধর্ষণ করে শাশুড়ীকে, সহপাঠি ধর্ষণ করে সহপাঠিনীকে, আমলা ধর্ষণ করে কার্যালয়ের মেথরানিকে, গৃহশিক্ষক ধর্ষণ করে ছাত্রীকে, ইমাম ধর্ষণ করে আমপারা পড়তে আসা কিশোরীকে, দুলাভাই ধর্ষণ করে শ্যালিকাকে, শ্বশুর ধর্ষণ করে পুত্রবধুকে, দেবর ধর্ষণ করে ভাবীকে; এবং দেশ জুড়ে চলছে অসংখ্য অসম্পর্কিত ধর্ষণ। বর্তমানে নারীর পরিচয় হচ্ছে, সে একটি ভোগ্যপণ্য। টিভি বিজ্ঞাপন, পত্রিকা বিজ্ঞাপন, অনলাইন বিজ্ঞাপন- সবকিছুতে নারীকে পণ্যায়িত করা হচ্ছে। নারী ছাড়া যেন বিজ্ঞাপন হয় না। তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর জিনিসে নারী শোভা পাচ্ছে। মোবাইল কোম্পানির সিম বিক্রি থেকে শুরু করে জুস, আচার, কোল্ড ড্রিঙ্কস, পেস্ট, সাবান, চেয়ার, টেবিল, গাড়ি সব বিজ্ঞাপনে নারীকে উপস্থাপন করা হয়। পত্রিকার কাটতি বাড়ানোর জন্য সুন্দরী মডেলের ছবি প্রচারিত হয়। নৌকায় দেওয়ার জন্য আলকাতরা কিনলেও তাতে একটি নারীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাবে। শিল্পের নামে নারীকে পরিণত করা হচ্ছে ‘আইটেম গার্ল’-এ। রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা চলছে নারীর ‘উন্মুক্ত প্রদর্শনী’।

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী ধর্ষণের ঘটনার পেছনের কারণ সম্পর্কে বলেন, …সবকিছুর মূলে আছে মূল্যবোধের অভাব। অবাধ পর্নোগ্রাফির বিস্তার, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্বল্প পরিচয়ের পর ওই ছেলের সঙ্গে বাছবিচার না করে মেলামেশা, বিভিন্ন চ্যানেল, বিশেষ করে পাশের দেশের বিভিন্ন চ্যানেলে যা দেখানো হয়, তাও ধর্ষণের মত অপরাধকে উসকে দিচ্ছে। বিজ্ঞাপন দেখে একটি ছোট ছেলেও জানতে পারছে, শরীরকে উত্তেজিত করতে হলে কী খেতে হবে। ছেলে-মেয়েরা ইন্টারনেটে কোন্ সাইট দেখছে, তাও অভিভাবকেরা কখনো নজরে আনছেন না। [প্রথম আলো, ২৪ মে ২০১৭]
মধুমিতা পাণ্ডে ইংল্যান্ডের অ্যাংলিয়া রাস্কিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অপরাধবিজ্ঞান বিষয়ে পি.এইচ.ডি করছেন। ভারতের সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে মধুমিতা লক্ষ্য করলেন এখনও ভারতীয় গৃহস্থালী গুলোতে স্বামীকে নাম ধরে ডাকা রীতিবিরুদ্ধ। গবেষণার অংশ হিসেবে নিজের বেশ কয়েজন বন্ধুর সঙ্গে কথা বলেন মধুমিতা, জিজ্ঞেস করেন তাদের মায়েরা নিজেদের স্বামীদের কী বলে ডাকেন। উত্তরে প্রায় সবাই বলেছেন, ‘এই শুনছো’, ‘শোনো’ কিংবা ‘ রওনকের বাবা’ (সন্তানের নাম) ইত্যাদি নামেই তাদের মায়েরা ডাকেন নিজেদের স্বামীদের। এভাবে ছোটবেলা থেকেই পৌরুষত্বের ভুল ব্যাখ্যা শেখেন আমাদের সমাজের পুরুষরা, আর নারীরা শেখেন কি করে পুরুষদের অধীনে থাকতে হয়। মধুমিতা পাণ্ডে বলেন, “সব ঘরেই এমনটা হচ্ছে। আমরা মনে করি এই ধর্ষকদের হয়তো জন্মগত কোন ত্রুটি আছে । কিন্তু না, এরা বাইরের দুনিয়া থেকে আসা কোন এলিয়েন নয়। বরং এই পৃথিবীর সমাজেই এরা বেড়ে উঠেছে।” মধুমিতা তার গবেষনায় আরো দেখিয়েছেন, অত্যন্ত রক্ষণশীল সামাজিক পরিস্থিতির দেশ ভারত। স্কুল শিক্ষার কারিকুলামে কোথাও ‘সেক্স এডুকেশন’ বা যৌন শিক্ষার পাঠ নেই। নীতি নির্ধারকরা মনে করেন এতে করে অবক্ষয়প্রাপ্ত হবে তরুণ সমাজ আর ধর্মীয়-সামাজিক প্রথার অবমাননা করা হবে। গবেষণা করতে গিয়ে মধুমিতা দেখলেন, ‘শিশ্ন বা পেনিস, জরায়ু বা ভ্যাজাইনা, সেক্স , ধর্ষনের মতো শব্দগুলো অভিভাবকরা সন্তানদের সামনে উচ্চারণ পর্যন্ত করতে চান না। তারা নিজেরাই যদি এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারেন, তবে নিজের ছেলে সন্তানকে কী করে শিক্ষা দেবেন তারা?” [সূত্রঃ ওয়াশিংটন পোষ্ট]

আমাদের সাহিত্য, নাটক, শিল্পকলা, বিজ্ঞাপন, সংস্কৃতি একটা ছেলের মনে একটা মেয়ে সম্পর্কে কি ধরনের ইমেজ দিচ্ছে? এই একটা বিশেষ ছাঁচেই ছেলেদের চেতনা গড়ে উঠছে, এটাই ব্রেইনের স্মৃতিভাণ্ডারে জমা হচ্ছে। আসলে ব্রেইনের প্রি-কনসেপশনে বা স্মৃতিভাণ্ডারে নারী মানেই এমন একটি সত্তা যাকে দিয়ে দেহের এবং মনের ক্ষুধা মেটানো যায়। একটা শিশু প্রথম প্রথম ২৪ ঘন্টাই পরিবারের মধ্যে থাকে, ক্রমান্বয়ে পরিবারের সাথে থাকার সময় কমে যায় আর বাইরে সময় কাটানো বেড়ে যায়। এখন বাইরের জগতে আমরা প্রতিনিয়ত যেসব সার্কেলে মিশি, সেখানে নারী প্রসঙ্গে কী আলাপ করে পুরুষেরা। বন্ধুদের আড্ডায় বান্ধবীদের নিয়ে বা বান্ধবীদের আড্ডায় বন্ধুদের নিয়ে যেই আলাপ হয় সেই আলাপ দিয়ে পুরুষের মস্তিষ্কে কী নারীর ব্যাপারে কী ধরণের চিত্রকল্প তৈরি হয়?

আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ-সংসারে সন্তানের সামনেই বাবা মাকে প্রহার করছে। অশ্লীল ভাষায় গালাগালিসহ শারীরিক নির্যাতনও প্রায় রুটিন কাজ। পান থেকে চুন খসলেই নারীর ওপর পুরুষের নির্যাতন- এই শিক্ষাটা পরিবার থেকেই প্রথমে পেয়ে আসছে। অন্যদিকে নারীকে কন্ট্রোলে রাখতে হবে, তাদের বুদ্ধি-সুদ্ধি কম, তাদের শারীরিক শক্তি কম, নারী পুরুষের সেবাদাসী, স্বামীর পায়ের নীচে স্ত্রীর বেহেস্ত, স্ত্রী থাকার পরেও অন্য নারীর সাথে মেলামেশা, আকার-ইঙ্গিত প্রদর্শন করে নিজেদের উদ্দেশ্য সাধন করার জন্য কথা বলাবলি, একটা নারী গেলে দশটা আসবে, পুরুষের জন্যেই নারী, পুরুষ ইচ্ছে করলেই দশটা বিয়ে করতে পারে-এই ধরনের পারিবারিক কথোপকথন বা কলহের মাঝেই ধীরে ধীরে যে ছেলেটি শিশু-কিশোরের বয়স পেরিয়ে যুবক হয়, তখন তার মাঝে নারীর প্রতি সম্মান-শ্রদ্ধাবোধ ঠিক তেমনটা প্রতিফলন দেখা যায় না।

আমাদের শিক্ষা, সঙ্গ এবং পরিবেশ, কোনটি নারীকে মানুষ হিসেবে চিন্তা করতে শেখাচ্ছে? বরং ভোগের সামগ্রী হিসেবে চিন্তা করতে শেখায়। আমাদের ‍শিক্ষা যদি যুগোপযোগী এবং আধুনিক না হয়, আমাদের শিক্ষা যদি আমাদের প্রকৃত মানুষ হতে না শিখায়, আমাদের শিক্ষায় সঙ্গ দোষের প্রভাব পড়বেই। আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং রাষ্ট্রীয় পরিবেশ সাথে যুক্ত হয়েছে ভার্চ্যুয়াল পরিবেশ যদি আমাদের অনুকূলে না আসে, তাহলে এ ধরনের ঘটনা ঘটবেই! আমরা ফেসবুকে লিখবো কিন্তু তার কোন সমাধান আসবেনা।

অনেকে ধর্ষণের জন্য শুধু নারীর পোষাককেই দায়ী করেন। এটা আসলেই কোন যুক্তিসঙ্গত কথা হতে পারেনা। পোষাক দায়ী হলে ৩ বছরের বাচ্চা থেকে শতবর্ষী বৃদ্ধা কেন ধর্ষণের স্বীকার হবে। আমাদের মননে-মগজের সমস্যা। আমরা সকলেই জানি ভারতে ধর্ষণের চিত্রটা শোচনীয়, তবে সুখের কথা এই যে, তারা এজন্য পোষাক কে দায়ী করে না, বিচারহীনতা এবং ধর্ষকের কুরুচি কে দায়ী করে এবং বিচারের দাবীতে লক্ষ লক্ষ ভারতীয় রাস্তায় নেমে আন্দোলন করে, পুলিশ-প্রশাসন কে বিচারের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে প্রবল চাপ প্রদান করে। আমাদের এখানে চিত্রটা সম্পূর্ণ আলাদা, এখানে পুলিশ মামলা নেয় না, মামলা নিলেও সুষ্ঠু সঠিক তদন্ত ও বিচার হয় না। আর ধর্ষিতা মানেই এই অঞ্চলে অপরাধী, বেশ্যা, মাগী তাই বিচার নিয়েও কেউ যেতেও চায় না, মুখ খুলতেও চায় না।

ধর্ষণের জন্য পোষাক দায়ী নয়, নারীর চামড়া দায়ী নয়, ধর্ষকের মানসিকতা দায়ী, বিচারহীনতা দায়ী। শরীর জেগে উঠলেই ধর্ষণ হয় না, ধর্ষণ হয় যখন বিবেক মরে যায়। সন্তান মাকে হত্যা করছে, মা সন্তানকে হত্যা করছে, স্বামী স্ত্রীকে হত্যা করছে, স্ত্রী স্বামীকে হত্যা করছে– আইন এখানে কী ই বা করবে? পাহারা দিয়ে, আইন করে অন্যায় বন্ধ করা যায় না; যদি না মূল্যবোধ জাগ্রত হয়। ধর্ষণরোধে সবার মাঝে সুশিক্ষা ও মূল্যবোধ জাগ্রত হউক।

লেখকঃ মোঃ জিশান মাহমুদ, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।

সহযোগিতা ও গবেষণাঃ তাসনুভা কায়সার, আইনজীবী, ঢাকা জজ কোর্ট।
সুনয়না নিঝুম শান্তা, ছাত্রী, আইন বিভাগ, বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী।