হাইকোর্টের যুগান্তকারী রায়: ডাক্তারি পরীক্ষা ছাড়াই ধর্ষণ মামলায় আসামির যাবজ্জীবন

ডাক্তারি পরীক্ষা ছাড়াই পারিপার্শ্বিক বিষয়াদি বিবেচনায় নিয়ে ধর্ষণ মামলায় যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সাজা বহাল রেখে যুগান্তকারী রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। রায়ে বলা হয়, ‘শুধুমাত্র ডাক্তারি পরীক্ষা না হওয়ার কারণে ধর্ষণ প্রমাণ হয়নি বা আপীলকারী ধর্ষণ করেনি এই অজুহাতে আসামি খালাস পেতে পারে না।’

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে নিম্ন আদালতে দেয়া যাবজ্জীবন কারাদন্ডাদেশের বিরুদ্ধে আসামির আপীল খারিজ করে চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তী ও বিচারপতি মোঃ রেজাউল হক এ রায় ঘোষণা করেন। সম্প্রতি ওই রায়ের ১৫ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়েছে।

আদালতে আসামিপক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট আমিনুল হক হেলাল ও সৈয়দ আল আহসাফুর আলী রেজা। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জান্নাতুল ফেরদৌসি রুপা ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল জাহিদ আহমেদ হিরো। এছাড়া বাদীপক্ষে অ্যাডভোকেট মোঃ ইছা শুনানিতে অংশ নেন।

এর আগে, খুলনার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল -১ এর বিচারক  ধর্ষণ মামলার একমাত্র আসামি ইব্রাহীম গাজীকে ২০১৯ সালের ১৩ মার্চ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ৯ (১) ধারায় যাবজ্জীবন কারাদন্ডাদেশ দেন। পাশাপাশি আসামিকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ২ বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেন।

ওই রায়ের বিরুদ্ধে আসামি হাইকোর্টে আপীল করে। আদালত আসামির আপীল খারিজ করে নিম্ন আদালতের সাজা বহাল রাখেন।

রায়ের বিষয়টি ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকে নিশ্চিত করে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল জাহিদ আহমেদ বলেন, আদালতে আসামি পক্ষের আইনজীবী ৩টি যুক্তিতে আসামির খালাস চান। প্রথমত, ঘটনার ৮ দিন পর অর্থাৎ বিলম্বে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ভিকটিমের মা একজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হওয়া স্বত্বেও আদালতে সাক্ষ্য দেননি এবং তৃতীয়ত ভিকটিমের ডাক্তারি পরীক্ষা এ মামলায় অতি গুরুত্বপূর্ণ ছিল কিন্তু বাদীপক্ষ তাতে ব্যর্থ হয়েছে।

রাষ্ট্রপক্ষের এই আইনজীবী আরও বলেন, আমি এসব যুক্তির বিরুদ্ধে দেশ-বিদেশের কয়েকটি মামলার নজির আদালতে উপস্থাপন করি। এরমধ্যে স্টেট অব পাঞ্জাব-বনাম-গুরমিত সিং, (১৯৯৬) ২ সুপ্রিম কোর্ট কেসেস ৩৮৪; আল-আমীন ও অন্য ৫ জন –বনাম রাষ্ট্র, ৫১ ডিএলআর ১৫৪; আব্দুস সোবহান বিশ্বাস বনাম রাষ্ট্র, ৫৪ ডিএলআর ৫৫৬ এবং বাদল ও অন্য একজন বনাম রাষ্ট্র, ৪ বিএলসি ৩৮১ মামলার নজির উদ্ধৃত করে আদালতকে বলি ধর্ষণের মত অপরাধের ক্ষেত্রে ভিকটিমের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তার অভিভাবক সহজে থানা পুলিশ করতে চাননা। অনেক চিন্তা ভাবনা করার পরই তারা আইনের আশ্রয় নেন। এক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে।

এছাড়া আসামিপক্ষ প্রভাবশালী হওয়ায় সালিশের মাধ্যমে মীমাংসার অজুহাতসহ থানা-পুলিশকে প্রভাবিত করে অভিযোগ দায়েরের ক্ষেত্রে বিলম্ব ঘটিয়েছে যা ধর্তব্য নয় বলেও আইনজীবী জাহিদ আহমেদ আদালতকে অবহিত করেন।

যুক্তিতর্কে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতে আরও উল্লেখ করেন, ধর্ষণের মত অপরাধের ক্ষেত্রে অন্য কোন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী থাকেনা, তাই ভিকটিমের সাক্ষী ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য দিয়েই অপরাধের বিচার করতে হয়। একজন ১৫ বছরের নাবালিকা, যার সামনে সুন্দর ভবিষ্যৎ সে শুধুশুধু আসামির বিরুদ্ধে নিজের লজ্জার কথা কেন নিজের মুখে বর্ননা করবে? যেহেতু আসামিপক্ষ জেরা করে ভিকটিমের সাখ্যের গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতায় কোন চির ধরাতে পারেনি, কাজেই শুধুমাত্র তার (ভিকটিমের) সাক্ষ্যের উপর ভিত্তি করেই আসামিকে সাজা প্রদান সঠিক হয়েছে।

এছাড়া ট্রাইব্যুনালের আদেশ স্বত্বেও ভিকটিমের ডাক্তারি পরীক্ষা না করার কারণে ঘটনা অপ্রমানিত হয়নি। এমনকি ডাক্তারি পরীক্ষায় ধর্ষণের কোন আলামত না পাওয়া গেলেও শুধুমাত্র ভিকটিমের মৌখিক সাক্ষের ভিত্তিতে আসামিকে সাজা প্রদান যুক্তিযুক্ত ও সঠিক বলেও আদালকে জানান আইনজীবী জাহিদ আহমেদ।

আদালত রায়ে বলেন, স্টেট অব পাঞ্জাব-বনাম-গুরমিত সিং, (১৯৯৬) ২ সুপ্রিম কোর্ট কেসেস ৩৮৪ মামলার অনুচ্ছেদ ৮ এ প্রদত্ত পর্যবেক্ষণ- “ The courts cannot overlook the fact that in sexual offences delay in the lodging of FIR can be due to variety of reasons particularly the reluctance of the prosecutrix or her family members to go to the police and complain about the incident which concerns the reputation of the prosecutrix and the honor of her family. It is only after giving it a cool thought that a complaint of sexual offence is generally lodged” – এই মামলার ক্ষেত্রে হুবহু প্রযোজ্য। সুতরাং এই মামলায় নালিশি দরখাস্ত দায়েরে ৮ দিনের বিলম্ব গুরুতর নয়, বরং স্বাভাবিক বিলম্ব এবং মার্জনীয়।

মামলার রায়টি লিখেছেন হাইকোর্টের বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তী। বিচারপতি মোঃ রেজাউল হক এতে একমত পোষণ করেন।

উল্লেখ্য, খুলনা জেলার দাকোপ থানার লাউডোব স্কুলে নবম শ্রেণীতে পড়াশোনা করতেন তাসলিমা খাতুন। স্কুলে যাওয়ার পথে আসামি মোঃ ইব্রাহীম গাজী প্রায়ই তাঁকে উত্যক্ত করত এবং খারাপ প্রস্তাব দিত। ২০০৬ সালের ১৫ এপ্রিল প্রতিদিনের মত স্থানীয় কালিকাবটি জামে মসজিদে পবিত্র কোরআন শরীফ পড়তে যায়। আনুমানিক ভোর পৌনে ছয়টার দিকে মসজিদ সংলগ্ন পুকুর ঘাটে ওযু করতে যায়। সেখানে আগে থেকে ওঁত পেতে থাকা আসামি পিছন দিক থেকে ভিকটিমকে ওড়না দিয়ে মুখ চেপে ধরে এবং পাঁজাকোলে করে মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানের পাশে বাঁশ বাগানের নির্জন স্থানে নিয়ে যায়। আসামি জোর করে তার মুখ চেপে ধরে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্ষণ করে। ধর্ষণের ফলে ভিকটিমের যোনি থেকে রক্তক্ষরণ হতে থাকে। এরপর আসামি সেখান থেকে পালিয়ে যায়।

ওই  ঘটনায় তসলিমার বাবা শেখ মোঃ আজাহার আলী আসামির বিচার চাইলে সালিশ বসে। সালিশে কোন মীমাংসা হয়নি বরং বলা হয়, ছেলে-মেয়েদের মধ্যে এমন ঘটনা হয়েই থাকে! ঘটনার ৪ দিন পর এ বিষয়ে থানায় অভিযোগ করতে গেলে পুলিশ মামলা নেয়নি। পরে তিনি আদালতে মামলা করেন।

দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০১৯ সালের ১৩ মার্চ আদালত আসামি ইব্রাহীম গাজীকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ৯(১) ধারায় যাবজ্জীবন কারাদন্ডাদেশ দেন। পাশাপাশি আসামিকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ২ বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেন।