নির্যাতিত নারী-শিশুর সহায়তায় পুলিশ ও হাসপাতালের সমন্বয় দরকার

যৌন ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুদের সহায়তা দিতে এবং সহিংসতা প্রতিরোধে পুলিশের কার্যক্রম তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে নির্যাতনের শিকার ব্যক্তির মেডিকো-লিগ্যাল পরীক্ষার ক্ষেত্রে পুলিশ ও হাসপাতালের মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো দরকার।

‘যৌন ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা হতে নারীদের সুরক্ষা ও প্রতিকার প্রাপ্তি: আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ভূমিকা’ শীর্ষক এক অনলাইন মতবিনিময় সভায় শনিবার (৩১ অক্টোবর) এসব সুপারিশ করা হয়।

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্ল্যাস্ট) অনলাইনে ওই সভার আয়োজন করে। সভায় পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ জোট ও ধর্ষণ আইন সংস্কার জোটভুক্ত বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যরা অংশ নেন।

মতবিনিময় সভায় পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ জোট ও ধর্ষণ আইন সংস্কার জোটের সদস্যবৃন্দ যৌন ও লিঙ্গ ভিত্তিক সহিংসতা হতে নারীদের সুরক্ষা ও প্রতিকার প্রাপ্তিতে অনলাইন অভিযোগ দায়ের পদ্ধতি, প্রত্যেক থানায় সার্বক্ষনিক একজন নারী পুলিশ কর্মকর্তা নিয়োগের বিষয়সহ উচ্চ আদালতের অন্যান্য নির্দেশনাগুলো সম্পর্কে আলোকপাত করেন।

অনলাইন সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (ক্রাইম) সেহেলী পারভীন বলেন, নারী ও শিশু প্রতি নির্যাতন প্রতিরোধে বাংলাদেশ পুলিশ গত ১৭ অক্টোবর একযোগে ৬ হাজার ৯১২টি পুলিশিং বিট এ সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করে।

পুলিশের কাছে হটলাইন ও অ্যাপ ভিত্তিক অভিযোগ জানানোর প্রক্রিয়াসমূহ ব্যাখ্যা করার পাশাপাশি তিনি জানান, বাংলাদেশ পুলিশ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নয়টি থানায় পরীক্ষামূলকভাবে জিডি দায়েরের একটি অ্যাপ চালু করেছে এবং আশা করছেন অতিদ্রুত সারাদেশে এই অ্যাপ এর প্রয়োগ ছড়িয়ে দিতে পারবেন।

পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ জোটের সদস্য এবং ব্র্যাক এইচ আর এল এস প্রোগ্রামের পরিচালক ব্যারিস্টার জেনেফা জব্বার বলেন, দেশের অনেক থানায় নারী পুলিশের উপস্থিতি নেই, ফলে থানায় বিভিন্ন পদে নারী পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতি নিশ্চিত করে যৌন ও লিঙ্গ ভিত্তিক সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুদের সেবা প্রদান করতে আরো অধিক নারী পুলিশ সদস্য নিয়োগ করা প্রয়োজন।

ধর্ষণ আইন সংস্কার জোট এবং নারীপক্ষের সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুন নাহার বলেন, যৌন ও লিঙ্গ ভিত্তিক সহিংসতার শিকার নারীদের অভিযোগ গ্রহণে হটলাইন, অনলাইন ও অ্যাপ ভিত্তিক ব্যবস্থাসমূহ সারাদেশের নারীদের জন্য চালু করতে হবে। তাছাড়া বিদ্যমান ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতাসমূহ চিহ্নিত করে তা সক্রিয়ভাবে চালু রাখতে হবে।

জিআইজেড এর ক্যাপাসিটি বিল্ডিং টীম লিডার রিতা দাশ রায় বলেন, যৌন নির্যাতনের শিকার নারীদের মেডিকো-লিগ্যাল পরীক্ষা ফলপ্রসুভাবে ও দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করার জন্য থানা পুলিশ ও হাসপাতালের মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি করতে হবে। কেন্দ্রীয় পর্যায়ে পুলিশ সদর দপ্তর ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মধ্যেও সমন্বয় বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

ব্লাস্টের অনারারি নির্বাহী পরিচালক, ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে সমন্বিত সক্রিয় উদ্যেগে নারীর প্রতি সংঘটিত সহিংসতা কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব। তিনি আশা করেন, ভবিষ্যতে এই ধরনের উদ্যোগ আরো সুদৃঢ় হবে।

সভায় সুপারিশসমূহ

  • যৌন ও লিঙ্গ ভিত্তিক সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুদের প্রতিকার প্রদান ও সহিংসতা প্রতিরোধে বাংলাদেশ পুলিশের অনেকগুলো কার্যক্রম রয়েছে, তৃণমূল পর্যায়ে এইসকল কার্যক্রম ছড়িয়ে দেয়া এবং সেগুলো যথাযথভাবে কার্যকর করা প্রয়োজন।
  • নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের প্রতিকার প্রাপ্তিতে অনলাইনে জিডি ও এফআইআর দায়েরের কার্যকর ব্যবস্থা চালূ করা একান্ত আবশ্যক
  • পুলিশ সদর দপ্তর থেকে জারীকৃত সার্কুলার মাঠ পর্যায়ে যথাযথভাবে অনুসরণ করছে কিনা তা মনিটরিং করা প্রয়োজন এবং পুলিশ সদর দপ্তর কর্তৃক জারীকৃত সার্কুলার অনসরণ না করলে দায়ী ব্যক্তিকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা প্রযোজন।
  • মাঠ পর্যায়ে পুলিশের সকল ইউনিট ও থানা পুলিশকে আরো নারীবান্ধব করার জন্য প্রশিক্ষণ, আলোচনা ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন। পাশাপাশি সকল থানায় নারী পুলিশ সদস্যের উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহন করা প্রয়োজন।
  • নির্যাতনের শিকার ব্যক্তির মেডিকো-লিগ্যাল পরীক্ষার ক্ষেত্রে পুলিশ এবং হাসপাতালের মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে নারীর প্রতি যৌন ও লিঙ্গ ভিত্তিক সহিংসতার প্রতিকার প্রাপ্তিতে বিভিন্ন আইন, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা, বিধিমালা ও নীতিমালা রয়েছে। এই সকল আইন ও নির্দেশনাসমূহের আলোকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যবৃন্দ সহিংসতার শিকার নারীদের সুরক্ষা ও প্রতিকার প্রদানে পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন। উচ্চ আদালতের নির্দেশনার মধ্যে অনলাইনে অভিযোগ দায়েরের পদ্ধতি এবং প্রত্যেক থানায় সার্বক্ষণিক নারী পুলিশ সদস্য নিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ। তবে নারীর প্রতি সংঘটিত যৌন ও লিঙ্গ ভিত্তিক সহিংসতায় বাংলাদেশ পুলিশ ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের মাধ্যমে হটলাইন নম্বর চালু করাসহ কিছু বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তাছাড়া ‘পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ জোট’ ও ‘ধর্ষণ আইন সংস্কার জোট’ থেকেও বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শকের নিকট অনলাইনের অভিযোগ দায়ের পদ্ধতি চালু করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আবেদন জানিয়ে আসছে।

এমন প্রেক্ষাপটে পুলিশ সদর দপ্তরের পুলিশ কর্মকর্তার সাথে ‘পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ জোট’ ও ‘ধর্ষণ আইন সংস্কার জোট’ এর সদস্যবৃন্দের মতবিনিময়ের জন্য বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) এই সভার আয়োজন করেছে। সভাটি সঞ্চালনা করেন ব্লাস্টের এডভোকেসী উপদেষ্টা এডভোকেট তাজুল ইসলাম, সভায় স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন ব্লাস্ট সহকারী পরিচালক তাপসী রাবেয়া এবং এ সংক্রান্ত মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন ব্লাস্ট ফরিদপুর ইউনিটের সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট শিপ্রা গোস্বামী।