সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠায় অভিন্ন পারিবারিক আইন দাবি

সম্পদ-সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। পাশাপাশি এ আইন প্রণয়নে আইনজীবীদের ভূমিকা রাখার আহ্বান জানানো হয়েছে।

‘ধর্ষণ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, আসুন নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলি’ স্লোগানকে সামনে রেখে সারা দেশের আইনজীবীদের সাথে অনলাইনে মতবিনিময় সভায় শনিবার (৫ ডিসেম্বর) এ দাবি জানানো হয়।

সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য জেড আই খান পান্না।

এতে আলোচনা করেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের আইন সংস্কার বিষয়ক বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য অ্যাড. জেয়াদ-আল-মালুম; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুদা এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এ. কে. রাশেদুল হক। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ৪০টি জেলা শাখার প্যানেল আইনজীবীগণ প্রস্তাবিত অভিন্ন পারিবারিক আইন (ইউএফসি)-র আলোকে সম্পদ-সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমঅধিকারের সম্পর্কে তাঁদের সুপারিশ উত্থাপন করেন।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সহসাধারণ সম্পাদক অ্যাড. মাসুদা রেহানা বেগমক তাঁর স্বাগত বক্তব্যে বলেন, প্রস্তাবিত অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রতিষ্ঠা বর্তমান সময়ের দাবি। যতদিন পর্যন্ত নারীরা তাঁদের সম্পদ ভোগ করতে না পারবে ততদিন পর্যন্ত নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না। এই আইন প্রণয়ন ও প্রতিষ্ঠার জন্য সংবিধানের ২৭, ২৮ ও ২৯ নং অনুচ্ছেদ আমাদের মূল শক্তি বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি অসম আইন পরিবর্তন করে অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নে আইনজীবীদের ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান।

অভিন্ন পারিবারিক আইন (ইউএফসি)-র আলোকে প্রস্তাবিত অভিন্ন উত্তরাধিকার আইনে সম্পদ-সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমঅধিকারের প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন লিগ্যাল অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড লবি পরিচালক অ্যাড. মাকছুদা আখতার। প্রস্তাবনায় প্রচলিত পারিবারিক আইনে উল্লেখ করা হয়, ধর্মে প্রচলিত ভিন্ন ভিন্ন আইনের মাধ্যমে নারীদের সম্পদ-সম্পত্তি উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে বৈষম্য ও বঞ্চিত করা হয়। এই বৈষম্য দূর করে সবার জন্য সমতাপূর্ণ একই আইন প্রণয়ণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ১৯৮৯ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছে। ১৯৯২ সালে প্রস্তাবনা পেশ। বিবাহ ও বিবাহ-বিচ্ছেদ, ভরণ-পোষণ, অভিভাবকত্ব, দত্তক এবং উত্তরাধিকার পারিবারিক আইনের মধ্যে আজকের মতবিনিময় সভায় কেবলমাত্র উত্তরাধিকার আইনের সংস্কার ও প্রস্তাবনা উপস্থাপন করা হয়েছে এবং প্রস্তাবনা আইনে পরিণত হলে এই আইনে সম্পত্তিতে নারী-পুরুষ সকলে সমান অধিকার লাভ করবে।

বিশেষজ্ঞ ও সারাদেশের আইনজীবীরা সম্পদ-সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের নায্যতার বিষয়ে তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ মতামত ও অবস্থান তুলে ধরেন এবং এ সম্পর্কিত আইনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোচনা করেন।

সভার সভাপতি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকার নেই, এমনকি নিজের উপার্জিত সম্পদও নারী নিজে ভোগ করতে পারে না। আর এসব সমস্যার মূল কারণ নারীর শ্রমের মূল্যায়ন করা হয় না। তাঁরা সব জায়গায় উপেক্ষিত। কোথাও নারীকে অংশীদার করার চেষ্টা ও চিন্তা থাকে না। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ শুধু নারীর জন্য নয়, নারী-পুরুষ এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য সম্পদ-সম্পত্তিতে সমান অধিকার দাবি করে এবং নারী সমাজের জন্য নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করতে চায় বলে তিনি উল্লেখ করেন। নারী-পুরুষের সমন্বিত কাজের মাধ্যমেই সমাজের মঙ্গল নিহিত। নারীর অংশীদারত্ব নিশ্চিত করতে না পারলে অধিকার নিশ্চিত করা যাবে না। আর অধিকার নিশ্চিত করতে প্রয়োজন যুগোপোযোগি আইন ও তার প্রয়োগ।

তিনি বলেন, ইতোমধ্যে অনেক মুসলিম দেশেও পারিবারিক আইন পরিবর্তন হয়েছে। এর জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রের সক্রিয় ভুমিকা। বাংলাদেশের বাস্তব সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মীয় অনুশাসন মেনেও আইন পরিবর্তন করা সম্ভব। কারণ আইন জনগণকে এগিয়ে নিয়ে যাবে জনগণকে পিছিয়ে নিয়ে যাবে না। অভিন্ন পারিবারিক আইন একটি আইনগত বিষয়। ফলে এই আলোচনায় সারাদেশের আইনজীবীদের সম্পৃক্ত করা হয়েছে। তিনি তাদের সুপারিশগুলো বিবেচনায় নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন এবং অংশগ্রহনকারী আইনজীবীদের এই আইনের প্রচার ও প্রয়োগে কাজ করার আহ্বান জানান।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য জেড আই খান পান্না বলেন, অভিন্ন পারিবারিক আইনের সাথে দ্বিমত প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই। অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নে বাধা আসলে সেই বাধা অতিক্রমের জন্য জনমত গঠন প্রয়োজন। তবে ইতোমধ্যে এ সম্পর্কে জনমত তৈরি হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। এই প্রস্তাবনা আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠিত করা জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য তিনি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদকে ধন্যবাদ জানান।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের আইন সংস্কার বিষয়ক বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য অ্যাড. জেয়াদ-আল-মালুম বলেন, প্রস্তাবিত অভিন্ন পারিবারিক আইনের খসড়া প্রণয়নের সময় সংবিধান বিশেষজ্ঞ, আইনজ্ঞ, অধিকার কর্মী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মতামত নেওয়া হয়। বাংলাদেশের সংবিধান, ১৯৪৮ সালের জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র, সিডও সনদ ও অন্যান্য মানবাধিকার দলিলের অনুসরণে এই প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়। তিনি সংবিধানের বিভিন্ন ধারা ও মৌলিক অধিকারের আলোকে এই আইনের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। তিনি আরও বলেন, সন্তান হিসাবে পিতা-মাতার সম্পদ-সম্পত্তিতে সকল সন্তান সমান অধিকার পাবে। সংবিধান প্রদত্ত নারী-পুরুষের সমান অধিকাররের ভিত্তিতে এই আইন প্রণয়নে কোনো বাধাই থাকতে পারে না বলে তিনি মত দেন।

বিভিন্ন ধর্মীয় আইনের বিধি-বিধান উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুদা বলেন, ধর্মীয় চেতনা থেকেও নারীকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। পাশাপাশি সম্প্রতি পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইনে পুত্র ও কন্যাকে সমান দায়িত্ব দেওয়া হলেও সম্পত্তিতে কন্যাকে সমান অধিকার দেওয়া হয়নি। তিনি ১৮৮২ সালের বিশেষ বিবাহ নিবন্ধন আইনে পরিবর্তন করে সকল ধর্মের নারী-পুরুষের বিবাহ রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করেন যাতে স্বামী-স্ত্রী অভিন্ন পারিবারিক আইনের আওতাভূক্ত হবেন। পাশাপাশি, তিনি অভিন্ন পারিবারিক আইনের প্রয়োগ ঐচ্ছিক রাখার প্রস্তাব রাখেন যেখানে কেউ ইচ্ছা করলে পুত্র-কন্যাকে সমান উত্তরাধিকার দান করতে পারবেন।

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এ. কে. রাশেদুল হক বলেন, পারিবারিক আইন ধর্মীয় আইন দ্বারা নির্ধারিত। কিন্তু এই সব আইনে সমঅধিকারের বিষয় সঠিকভাবে নির্ধারিত হয়নি। যদিও আমাদের সংবিধানে সবার সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। কাজেই ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-লিঙ্গনির্বিশেষে একটি অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন ও সম্পদ-সম্পত্তিতে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের দেশে একটি আইন দরকার।

মতবিনিময় সভাটি সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাড. দীপ্তি সিকদার। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ৪০টি জেলা শাখার প্যানেল আইনজীবী, আইন বিশেষজ্ঞ প্রস্তাবনা বিষয়ে সহমত প্রকাশ করে তাদের বক্তব্য তুলে ধরেছেন। মতবিনিময় সভায় ৪০টি জেলা শাখার নেতৃবৃন্দ, প্যানেল আইনজীবী, আইন বিশেষজ্ঞ এবং মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ ও কর্মকর্তাসহ মোট ৯০ জন অনলাইন মতবিনিময় সভায় অংশগ্রহণ করেন।

-সংবাদ বিজ্ঞপ্তি