কোর্টরুম (প্রতীকী ছবি)
কোর্টরুম (প্রতীকী ছবি)

সামন্ততান্ত্রিক ধারণা, জমিদারি মনোভাব ও আধুনিক ‘কোর্টরুম ম্যানারস’

হুমায়ূন কবির: মহামান্য হাইকোর্টের অনেক মাননীয় বিচারপতি বিভিন্ন মামলায় প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের অপেশাদার আচরণে বিরক্তি প্রকাশ করে বারংবার হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। অনেক মামলায় তাদের জমিদার সুলভ মনোভাবের জন্য তিরস্কার করেছেন। তাদেরকে নানা উপলক্ষে মনে করিয়ে দেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা জনগণের সেবক মাত্র, লাট সাহেব নন।

কল্যাণ রাষ্ট্রে দেশের সকল শ্রেণি পেশার মানুষ তার উপর অর্পিত দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করে থাকেন সমমর্যাদার ভিত্তিতে। রাষ্ট্রর অঙ্গগুলি একে অপরকে টপকাতে চায় না কিংবা অন্যের উপর প্রভূত্ব করতে চায় না। বরঞ্চ অন্যকে সম্মানিত করে নিজের মর্যদা বাড়িযে নেয় নিভৃতে।

রাষ্ট্রের নানা অঙ্গের মধ্যে বিচার বিভাগ এক অনন্য মর্যদা ভোগ করে থাকে। বিচারিক কার্য চাকরি নয়, তার চাইতেও বেশি- গুরু দায়িত্ব। গুরুত্বের দিক থেকে স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল এক অসাধারণ ভূমিকা পালনকারী রাষ্ট্রীয় সার্বভৌম স্তম্ভ।

বাংলাদেশের সংবিধান ন্যায় বিচারের নিশ্চয়তা উচ্চকিত করে, জঘন্য অপরাধীকে আত্মপক্ষ সর্মথনের সুযোগ দানের মাধ্যমে। বিজ্ঞ বিচারক সেখানে আম্পায়ারের ভূমিকায় থাকেন। বিজ্ঞ বিচারকের চেয়ারটি থাকে কোর্টরুমের ঠিক মাঝ বরাবর। বিষয়টি প্রতীকী হলেও তিনি যে কোন পক্ষের নন তা নির্দেশ করে। উভয় পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন বিজ্ঞ আইনজীবী। এডভারসারিয়াল বিচার ব্যবস্থায় বিজ্ঞ আইনজীবী সত্য উদ্ঘাটনে আর মিথ্যা অপসারণে এক অনবদ্য ভূমিকা পালন করে সমাদৃত ও প্রশংসিত। তাই উভয়পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীকে কোর্ট অফিসার আর বিজ্ঞ বিচারককে প্রিসাইডিং অফিসার হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

বিজ্ঞ বিচারক বিচারিক মনোভাব (Judicious mind set) সম্পন্ন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি হিসাবে কোর্টরুম ব্যবস্থাপনাও করে থাকেন। তাই কোর্ট রুম ব্যবস্থাপনায় বিচার প্রক্রিয়া অনুসরণ, নিয়মানুবর্তিতা ও সময় ব্যবস্থাপনা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এইসব বিষয়ে কোর্টকে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেন বিজ্ঞ আইনজীবী। ন্যায়বিচার নিশ্চিতে কোর্টরুম ব্যবস্থাপনার অংশ হিসাবে কোর্টরুম ম্যানারস অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

কোন মামলা শুনানির জন্য ডাকলে বিজ্ঞ আইনজীবী কোর্টে মামলা শুনানির জন্যে হাজির না থাকলে যেমন বিজ্ঞ আইনজীবীকে আদালতের কাছে, মক্কেলের স্বার্থে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হয় বা জবাবদিহি করতে হয় বা আদালতের মৃদু ভর্ৎসনা মেনে নিতে হয়, তেমনি বিজ্ঞ আদালত সঠিক সময়ে উঠতে না পারলে বিজ্ঞ বিচারকদেরও বিজ্ঞ আইনজীবীসহ বিচার প্রার্থীদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করা উচিত। এটাই কোর্টরুম ম্যানারস। এতে বিচার ব্যবস্থার মর্যদা বৃদ্ধি পায়।

অনেক মাননীয় বিচারপতিকে আদালতে দেরিতে আসীন হলে বিজ্ঞ আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে তার জন্য ‘সর‍্যি’ বলতে শোনা যায় মহামান্য সুপ্রীম কোর্টে।

বিজ্ঞ বিচারক ও আইনজীবী উভয়ই জনগণের স্বার্থে কোর্টরুমে মামলা পরিচালনা করেন। তাই কোর্টরুম পরিচালনায় উভয় পক্ষকে সমান ভূমিকা পালন করা উচিত। কোন পক্ষের অপেশাদার আচরণ যেন বিচার প্রত্যাশী জনগণের ক্ষতি কারণ না হয়। বিচার প্রক্রিয়া ব্যহত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় কোনপক্ষের ভূমিকা কম নয়।

আদালতকে সদয় বিবেচনা করতে হবে যে, একজন বিজ্ঞ আইনজীবীকে একই সময়ে অনেকগুলি মামলা ও কোর্ট ম্যানেজ করতে হয়। বিজ্ঞ আইনজীবীকে প্রত্যেকটি মামলাকে সমান গুরুত্ব দিতে হয় একই সময়ে। অন্যদিকে একজন বিজ্ঞ বিচারককে একই সময়ে একটি কোর্টরুম ব্যবস্থাপনা করতে হয়। তাই কোন বিজ্ঞ আইনজীবীকে যাতে একটি নির্দিষ্ট কোর্টরুমে বসে অপেক্ষা করতে না হয় মামলা শুনানীর সময় সেদিকে বিজ্ঞ আদালদের নজর রাখতে হবে বিচারপ্রার্থীদের স্বার্থে। বিজ্ঞ বিচারক কোন কারণে আদালতে আসীন হতে দেরি হলে তাঁকে নিজ থেকে নতুন একটি সময় নির্ধারণ করে সাথে সাথে কোর্টের পেশকার/বেঞ্চ অফিসারের মাধ্যমে বিজ্ঞ আইনজীবীদের জানিয়ে দেওয়া উচিত।

যারা হাইকোর্ট বিভাগে প্র্যাক্টিস করেন তারা নিশ্চয় জানেন অনেক মাননীয় বিচারপতি কোর্টচলাকালীন সময়ে বিজ্ঞ আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেন তিনি কত নম্বর আইটেম পর্যন্ত মামলা শুনানি করবেন- যাতে উক্ত আইটেমের পরের আইটেমের জন্যে অপেক্ষারত বিজ্ঞ আইনজীবীদের ওই কোর্টরুমে অপেক্ষা করতে না হয়। আবার অনেক বেঞ্চের মাননীয় বিচারপতি কোর্টে উঠতে দেরি হলে বেঞ্চ অফিসারদের মাধ্যমে জানিয়ে দেন যে, তিনি কয়টার সময় কোর্টে উঠবেন।

একজন বিজ্ঞ বিচারকের কাছে এ ধরণের ‘কোর্টরুম ম্যানারস’ প্রত্যাশা করা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। কারণ, একজন বিচারক প্রশাসক নয়। তিনি ন্যায় বিচার নিশ্চিত করেন। তিনি কোর্টরুম পরিচালনায় প্রতিটি পদক্ষেপ বিবেচনা করবেন সুবিবেচনা, জ্ঞান ও বিচক্ষণতা দিয়ে।

কোর্টরুম ম্যানারসের এই সাধারণ নর্মসগুলি আমরা উভয় পক্ষ পালন করতে না পারলে প্রকৃতপক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিচারপ্রার্থী। কোর্টরুম পরিচালনায় কোনপক্ষ প্রশাসক নয় বরং মামলা নিষ্পত্তিতে একে অন্যের পরিপূরক। তাই অনুরোধ করবো, উভয়পক্ষ এ বিষয়গুলি যেখানে অনুপস্থিত সেখানে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে উত্থাপন করে খোলামেলা আলোচনা করে সমাধান করবেন। উভয়পক্ষ তাদের কর্মের মাধ্যমে বিজ্ঞতার পরিচয় দিবেন তা বিজ্ঞ জনের কাছে সাধারণের প্রত্যাশা।

বলা হয়ে থাকে বিচার অঙ্গনের অনেকে সামন্ততান্ত্রিক মনোভাব পোষণ করে থাকেন, যা স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিপরীত। অনেকে আবার নিজেকে ছোটখাট জমিদার ধারণার মধ্যেও আটকে রাখেন। এখানে মনে রাখা দরকার অনেক আইনজীবী আছেন যাদের জুনিয়র হওয়া সম্মানের। অনেক চেম্বারে কাজ করা গৌরবের। আইনজীবীরা অনেক বিচারকের নৈতিক স্খলনের বিষয়টা জেনেও বিচার ব্যবস্থার মর্যাদার স্বার্থে তা নিয়ে উচ্চবাচ্য করা থেকে বিরত থাকেন। এটা আইনজীবীদের দুর্বলতা নয় বরং মহৎপ্রাণের পরিচায়ক। মানুষের আচরণগত সমস্যা নিয়ে গবেষকরা বিশ্লেষণ করে থাকেন বিভিন্ন ভাবে, কেউ বলেন Family is the first institution where we first learn good or bad manners. আবার কারো সামাজিকীকরণ হয় ভিন্নভাবে।

তবে মানুষ যেই পরিবেশ থেকে উঠে আসুক না কেন সে চাইলেই বদলাতে পারে নিজেকে, বদলাতে পারে স্বাভাবগত আচরন, সেই অর্জিত আচরন দিয়ে মুগ্ধ করতে পারে তার পরিজন কে। তাছাড়া একজন মানুষ যদি তার নিজ বলয়ের পরিবৃত্তের জনগোষ্ঠীকে, তার স্বজনদেরকে, তার সহকর্মীকে, অধীনস্থকে কিংবা তার সাথের জনকে আচরণ দিয়ে, ভঙ্গি দিয়ে, ব্যবহার দিয়ে মুগ্ধ করতে না পারে, চিত্ত জয় করতে না পারে বা তার উপস্থিতির ছাপ রেখে যেতে না পারে তবে তার মানব জনমের স্বার্থকতা কোথায়! স্বাধীন দেশে অনেক প্রাস্তিক জনগোষ্ঠী সদস্য রাজনীতিসহ নানাবিধ কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আসনে আসীন হচ্ছে যা দোষের নয়, দোষের তখনই যখন ঐ চেয়ারে বসে জনগণের প্রত্যাশার সাথে সামনঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ করতে ব্যর্থ হয়।

পরিশেষে বলব, মানুষ মানবীয় দোষত্রুটির উর্ধ্বে নয়। আইনজীবী ও বিচারক উভয়ের নামের আগে বিজ্ঞ শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন, তাই আপনাদের প্রতিটি পদক্ষেপ হবে বিজ্ঞজনোচিত, বিজ্ঞতার পরিচায়ক।

হুমায়ূন কবির: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট; লিগ্যাল কনসালটেন্ট, ডেভেলপমেন্ট প্রোজেক্ট; অ্যাক্রিডিটেড আরবিট্রেটর অ্যান্ড নেগোসিয়েটর।