আবরার ইয়াসির

‘জিরো এফআইআর’ নিয়ে কিছু কথা

আবরার ইয়াসির: আইন জগতের সবাই এফআইআর (FIR) এই শব্দটির সাথে পরিচিত। FIR এর পূর্ণরূপ হল First Information Report. বাংলায় যাকে এজাহার নামে অভিহিত করা হয়। FIR বা এজাহার একটি লিখিত প্রতিবেদন যা Cognizable Offence বা আমলযোগ্য অপরাধ সংঘঠিত হলে থানায় দায়ের করতে হয়।

উল্লেখ্য যে, Cognizable Offence বা আমলযোগ্য অপরাধ হল সে সকল অপরাধ যেগুলো পুলিশ সংশ্লিষ্ট ম্যাজিষ্ট্রেটের অনুমতি ছাড়াই তদন্ত করতে পারেন। FIR বা এজাহার মামলার ভুক্তভোগী বা অপরাধ সম্পর্কে জ্ঞাত এরূপ যেকোন ব্যক্তি দাখিল করতে পারেন। এইক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট থানায় প্রতিবেদনটি লিখিতভাবে দাখিল করতে হয়। কোন ব্যক্তি যদি মৌখিকভাবে এজাহার দেন তবুও সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারের দায়িত্ব হল তা লিখিত আকারে লিপিবদ্ধ করা। অত:পর, এজাহার বা FIR এর কপিতে একটি সিরিয়াল নম্বর দেয়া হয় এবং পুলিশ তদন্ত কার্য শুরু করেন।

আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সম্প্রতি FIR বা এজাহার সম্পর্কিত কর্মপদ্ধতিতে একটি বিশেষ পরিবর্তন সূচিত হয়েছে যা জিরো এফআইআর ( Zero FIR) নামে পরিচিত।

মূলত যে থানার আঞ্চলিক এখতিয়ারে (territorial jurisdiction) কোন অপরাধ সংগঠিত হয় সে থানাতেই FIR করা লাগে। তবে অনেক সময় একাধিক থানার নিকটবর্তী কোন স্থানের আঞ্চলিক এখতিয়ার আসলে কোন থানাতে পড়বে এটি নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হতে পারে। ঠিক এই ব্যাপারটিতেই Zero FIR এর মাধ্যমে পরিবর্তন সৃজিত হয়েছে। ভারতে আঞ্চলিক এখতিয়ারের জটিলতার কারণে থানাগুলো আর মামলা ফেরত দেবার মতো কোন ব্যবস্থা যদি গ্রহণ না করতে পারে এজন্যই এই অভিনব উদ্যোগের উদ্ভব ঘটেছে।

উল্লেখযোগ্য যে, ১৯৯৩ সালে অন্ধ্র প্রদেশ বনাম পুনাতি রামালু এবং অন্যান্য মামলায় ভারতের মাননীয় সুপ্রীম কোর্টের এক দ্বৈত বেঞ্চ শুধুমাত্র আঞ্চলিক এখতিয়ার না থাকার কারণে মামলা না নেওয়াকে পুলিশের অবহেলামূলক অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছিলেন। এছাড়াও, ১৯৯৯ সালে সাতবিন্দর কর বনাম ন্যাশনাল ক্যাপিটাল টেরিটরি, দিল্লি সরকার মামলায় ভারতের মাননীয় সুপ্রীম কোর্ট ঘোষণা করেন তদন্ত কার্যের কোন পর্যায়ে যদি আবিষ্কৃত হয় অন্য কোন থানার এরূপ মামলা তদন্ত করার এখতিয়ার ছিল শুধুমাত্র এই কারণে উক্ত তদন্ত বাতিল বলে বিবেচিত হবে না এবং আমল নেওয়ার এখতিয়ার সম্পন্ন ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট ভারতীয় ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৯৭৩ এর ১৭০ ধারা মোতাবেক উক্ত তদন্ত সম্পর্কে প্রতিবেদন দাখিল করা যাবে। পরবর্তীতে, ২০১৩ সালে ২০১২ সালের কুখ্যাত ‘নির্ভয়া (ছদ্মনাম) ধর্ষণ ও হত্যা মামলা’ পরবর্তী বিচারপতি ভার্মা কমিশনের রিপোর্টে এই Zero FIR প্রসঙ্গটি আনুষ্ঠানিকভাবে উঠে আসে।

এতে বলা হয়, ধর্ষণ বা হত্যার এর মতো গুরুতর অপরাধের ঘটনা ঘটলে তা যে থানায় অভিযোগ করার জন্য যাওয়া হয়েছে তার আঞ্চলিক এখতিয়ার নেই বা অন্য কোন থানার এরূপ আঞ্চলিক এখতিয়ার আছে এরকম কোন অজুহাত প্রদান করা যাবে না। তাদের এরকম গুরুতর অভিযোগ অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে এবং FIR টিতে সিরিয়াল নাম্বারটি শূন্য হিসেবে লিখে যে থানার মামলাটি নেওয়ার এখতিয়ার রয়েছে তার নিকট হস্তান্তর করতে হবে। এজন্যই এটির নামকরণ Zero FIR হয়েছে।

উল্লেখ্য যে, Code of Criminal Procedure বা ফৌজদারি কার্যবিধি সংক্রান্ত নিয়মকানুন ভারতে Concurrent List এর মধ্যে পড়ে। এর অর্থ হল কেন্দ্রীয়ভাবে ফৌজদারি কার্যবিধি সংক্রান্ত নিয়মকানুন পরিবর্তন করা যায় অথবা রাজ্যগুলি চাইলে তারা আলাদাভাবে নিজেরাই নিজেদের প্রদেশের জন্য ফৌজদারি কার্যবিধি সংক্রান্ত নিয়মকানুন পরিবর্তন করতে পারে। এজন্য ২০১৩ সালে বিচারপতি ভার্মা কমিশনের রিপোর্টের পর ওদের কেন্দ্রীয় সংসদ ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৯৭৩ এ কোন সংশোধন না এনে বরং ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপর দায়িত্ব দেয় ভারতের সকল রাজ্যের উপর Zero FIR এর বিধিবিধান পালনের জন্য নীতিমালা জারি করার যাতে প্রদেশগুলি নিজেরাই নিজেদের ফৌজদারি কার্যবিধি সংক্রান্ত নিয়মকানুন ঢেলে সাজানোর সুযোগ পায়। এহেন উদ্দেশ পূরণে Zero FIR নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অসংখ্য নীতিমালা জারি করার পরেও Zero FIR ভারতের আইন অঙ্গনে ততটা সাড়া ফেলতে পারেনি প্রদেশগুলিতে আইনের মাধ্যমে Zero FIR এর বৈধতা আনুষ্ঠানিকভাবে না দেবার কারণে।

তবে সম্প্রতি Zero FIR এর প্রসঙ্গটি পুনরায় উঠে আসে ২০১৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর কর্ণাটক হাইকোর্টে করা এক PIL বা Public Interest Litigation মামলায় যেখানে মাননীয় কর্ণাটক হাইকোর্ট বিচারপতি ভার্মা কমিশনের রিপোর্টের উপর জোর দিয়ে কর্ণাটক পুলিশকে Zero FIR গ্রহণ করতে বাধ্যবাধকতা আরোপ করেন। শুধু তাই নয়, কর্ণাটক হাইকোর্টের ঐ দ্বৈত বেঞ্চ Zero FIR গ্রহণে ব্যর্থতার জন্য পুলিশ কর্মকর্তাদের এরূপ কার্যাবলি ভারতীয় দন্ডবিধি, ১৮৬০ এর ধারা ১৬৬ক মোতাবেক শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করেন এবং পাশাপাশি বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুপারিশ প্রদান করেন।

অন্যদিকে, Zero FIR এর অপরিহার্যতা তীব্রভাবে ফুটে উঠে যখন ২০১৯ সালে ভারতের হায়দ্রাবাদ শহরে ‘দিশা (ছদ্মনাম) ধর্ষণ ও হত্যাকান্ড’ এর পূর্বে দিশার পরিবার কর্তৃক missing report দাখিল করার জন্য থানায় হাজির হবার পর পুলিশ কর্তৃক আঞ্চলিক এখতিয়ার না থাকার অজুহাত উপস্থাপনের মাধ্যমে মামলা না নেওয়ার সময় গোটা তেলেঙ্গানা এবং অন্ধ্র প্রদেশের মানুষ এ ঘটনায় ফুঁসে উঠে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে অন্ধ্র প্রদেশের সরকার ইতিমধ্যে দিশা বিল নামক একটি বিল পাশ করেছে যা সুনির্দিষ্টভাবে Zero FIR এর আইনী বৈধতা প্রদান করেছে যদিও বিলটি চূড়ান্তভাবে আইনে পরিণত হবার জন্য বর্তমানে ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতির সম্মতির অপেক্ষায় আছে। অন্ধ্র প্রদেশের পাশাপাশি মহারাষ্ট্র সরকারও অনুরূপ বিল পাশের আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

আমাদের বাংলাদেশেও মাঝে মাঝে আঞ্চলিক এখতিয়ারে না থাকার কারণে মামলা না নেওয়ার ঘটনা পরিলক্ষিত হয়। এতে বিশেষ করে হত্যা বা ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ যেখানে ন্যায়বিচারের স্বার্থে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়াটা অত্যন্ত জরুরি তা বাধাগ্রস্থ হয় এবং সাধারণ জনগণ ব্যাপকভাবে শারীরিক, মানসিক এবং ক্ষেত্রবিশেষে আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হন।
এজন্য Zero FIR আমাদের দেশের আইনী প্রেক্ষাপটে পুলিশ কর্মকর্তাদের কর্তৃক আঞ্চলিক এখতিয়ার না থাকার কারণে মামলা না নেওয়ার সেকেলে অজুহাত দূরীকরণে কার্যকরী ভূমিকা যে রাখবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

অবশ্য Zero FIR এর এই বিধানটি সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত নয়। Zero FIR এর আঞ্চলিক এখতিয়ারগত শিথিলতার সুযোগ নিয়ে মিথ্যা মামলা দাখিলের সংখ্যা বেড়ে যেতে পারে। তাই Zero FIR এর বিধান আনয়নের পূর্বে দন্ডবিধি, ১৮৬০ এর ১৮২ এবং ২১১ ধারার কার্যকরী প্রয়োগ সুনিশ্চিতকরণ যে অতীব জরুরী সে বিষয়ে কোন সন্দেহ রাখার অবকাশ নেই।

আবরার ইয়াসির: একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক এবং বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসে সহকারী জজ পদে সুপারিশপ্রাপ্ত