শেখ শাহীনুল ইসলাম
শেখ শাহীনুল ইসলাম (ছবি: মানবজমিন)

বিচারকের কাছে ২ কোটি টাকা ঘুষ দাবি রাজউক পরিচালকের

সরকারি প্রকল্পে বরাদ্দ পাওয়া প্লটের কাগজপত্র ঠিক করে দেয়ার বিনিময়ে একজন বিচারকের কাছে দুই কোটি টাকা ঘুষ দাবি করেছেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পরিচালক (এস্টেট) শেখ শাহীনুল ইসলাম।

দীর্ঘ সময় চেষ্টা করেও দাপ্তরিক কাজ সম্পন্ন করতে না পারায় ওই বিচারক রাজউক চেয়ারম্যান, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অভিযোগ দায়ের করেছেন। এতে তিনি স্পষ্টতই রাজউক পরিচালকের ঘুষ দাবির বিষয়টি উল্লেখ করেন।

রাজউক’র ওই পরিচালকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের আরো অনেক অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া গোল্ডেন মনিরের প্লট বাণিজ্যের সঙ্গেও নাম এসেছে এই পরিচালকের। অবৈধভাবে অর্থ অর্জন করে তা সুদের কারবারে খাটানোরও অভিযোগ রয়েছে শাহিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে।

বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা ড. আবুল হোসেন খন্দকারের দেয়া অভিযোগ অনুযায়ী ২০০২ সালে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে প্লট বরাদ্দের জন্য আবেদন করেন তিনি। দেড় লাখ টাকা পে-অর্ডারসহ রাজউক’র শর্ত মেনে ফরম পূরণ করে জমা দেন তিনি।

২০০৫ সালের ২১শে মে দশ কাঠা পরিমাণের ওই প্লটটি তার নামে বরাদ্দ করে রাজউক। এক বছর পর প্রথম কিস্তির টাকা হিসেবে সাড়ে ছয় লাখ টাকা জমা দেন বিচারক ড. আবুল হোসেন খন্দকার। কিন্তু দ্বিতীয় ও তৃতীয় কিস্তির টাকা জমা দিতে না পারায় রাজউক’র কাছে সময় বাড়ানোর আবেদন করেন তিনি।

এরই মধ্যে ১৯৯৭ সালে রাজউক’র তৃতীয় প্রকল্পের জন্য আবেদন করা ৫ কাঠার প্লটটিও ২০০৭ সালে বরাদ্দ পান ড. আবুল হোসেন খন্দকার। সে অনুযায়ী ওই বছরের ৩১শে আগস্ট সাত লাখ টাকা জমা দেন। কিছুদিন পরে তিনি জানতে পারেন রাজউকে তার ৫ কাঠার পরিমাণের প্লটের ফাইলটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

পরবর্তীতে একাধিক আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ২রা এপ্রিল ফাইলটি খুঁজে পাওয়া যায়। তবে এখানে আরেক ঘটনা ঘটে ওই বিচারকের সঙ্গে। রাজউক’র বরাদ্দ করা পাঁচ কাঠার প্লটটির ফাইল খুঁজে পাওয়া গেলেও ড. আবুল হোসেন খন্দকারের অজান্তে সেটি বাতিল করা হয়।

এই বিচারকের দাবি, তার কোনো রকম অনুমতি না নিয়ে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের প্লটটিতে আগের ৫ কাঠার প্লটটি সমন্বয় করে ফাইল গোপন রাখে রাজউক।

ড. আবুল হোসেন খন্দকার জানান, বাতিল হওয়া প্লটের জমাকৃত সাড়ে সাত লাখ টাকার সঙ্গে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের প্লটটি সমন্বয় করে দখলভার ও রেজিস্ট্রির জন্য রাজউকে আবেদন করেন তিনি। পরবর্তীতে ২০১৯ সালের ২৩শে মে ফাইলটি জমা হয় রাজউক পরিচালক শাহীনুল ইসলামের দপ্তরে।

বিচারক ড. আবুল হোসেন খন্দকারের অভিযোগ, শাহীনুলের সঙ্গে দেখা করার জন্য চেষ্টা করলেও তিনি ব্যস্ততার কথা বলে ফাইলে হাত দেননি। ২০ মাস অপেক্ষা করেও ফাইলটির নিষ্পত্তি করা যায়নি।

ড. আবুল হোসেন খন্দকার ২০ মাস ঘুরে রাজউক পরিচালক শাহীনুলের দপ্তরে সবশেষ গেল বছর ১১ই নভেম্বর আবার দেখা করতে যান। এদিন শাহীনুল তাকে ফাইলে কিছু ঝামেলা আছে, কাজ করতে হবে বলে জানান। ইনিয়ে-বিনিয়ে নানাভাবে বোঝানোর পর ড. আবুল হোসেনকে ‘খামের ব্যবস্থা’ করতে বললেন। সেদিন খামের অর্থ বোঝেননি বলে পরবর্তীতে আবার যেতে বলেন শাহীনুল।

ড. আবুল হোসেন গত ১০ই ডিসেম্বর আবারো যখন রাজউক’র এই পরিচালকের দপ্তরে হাজির হন তখন তার কাছে ২ কোটি টাকা ঘুষ দাবি করেন শাহীনুল। শাহীনুল ড. আবুল হোসেন খন্দকারকে বলেন, আপনি যদি ২ কোটি টাকা খরচ করতে না পারেন তাহলে আমি পাঁচ কোটি টাকায় প্লটটি বিক্রি করে দেবো।

ওই বিচারক বলেন, সচিবালয়ের নির্দেশমালায় কোনো ফাইল কত সময় কোন টেবিলে থাকবে তা স্পষ্ট উল্লেখ আছে। কিন্তু একদিন না দু’দিন না, ২০ মাস একটি ফাইল তার দপ্তরে ঘুরেছে। এটা কেমন কথা! আর আমার ফাইল দেখার জন্য তো তাকে সরকার টাকা দিচ্ছে। আমাকে কেন দিতে হবে।

তিনি আরো বলেন, আমি রাজউক ছাড়াও দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) সংশ্লিষ্ট সব জায়গায় এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু এখনও কোনো প্রতিষ্ঠানকে পদক্ষেপ নিতে দেখছি না।

অভিযোগের বিষয়ে রাজউক পরিচালক শেখ শাহীনুল ইসলামের সঙ্গে যোগোযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। বক্তব্য নেয়ার জন্য তার মোবাইল ফোনে বার বার কল দেয়া হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।

এদিকে শাহীনুলের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ বিভিন্ন দপ্তরে আগে থেকেই রয়েছে। সরকারি চাকরির পাশাপাশি অবৈধ উপায়ে অর্জিত টাকা সুদে খাটানোর অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, সুদের টাকা দিতে ব্যর্থ হলে ঋণ গ্রহীতাকে নিজ কার্যালয়ে ডেকে মারধর করার ঘটনাও ঘটিয়েছেন তিনি।

গত বছরের জানুয়ারিতে একটি কেমিক্যাল কোম্পানির নির্বাহী পরিচালককে সুদের টাকা দিতে দেরি হওয়ায় মারধর করেন শাহিনুল। একই কোম্পানির আরেক ব্যক্তিকে গত ২০শে সেপ্টেম্বর মারধর করার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।

জানা যায়, ২০১৬ সালের জুলাই মাসে ৩০% সুদে তারা শেখ শাহীনুল ইসলামের কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকা নেন ওই কেমিক্যাল কোম্পানির তিন মালিক। এর চুক্তিপত্র তাদের কাছে রয়েছে। এই টাকার সুদ পরিশোধের পর আরও ৫০ লাখ টাকা তাদের ধার দেন শাহীনুল। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত ৩২ লাখ ৫০ হাজার টাকা তারা পরিশোধ করেছেন।

কিন্তু মার্চ থেকে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে তাদের ব্যবসা ভালো চলছে না। টাকা ফেরত দিতে দেরি হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে রাজউকের প্রধান কার্যালয়ে নিজের দপ্তরে ডেকে নিয়ে তাদের পৃথকভাবে মারধর করেন শাহীনুল।

রাজউকের এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। র‌্যাব’র হাতে গ্রেপ্তার হওয়া গোল্ডেন মনিরের সঙ্গে সম্পৃক্ততার ইস্যুতেও তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে দুদকে। এ অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে গত ৯ই ডিসেম্বর তলব করে দুদক। এদিন হাজিরা দেয়ার কথা থাকলেও শাহীনুল সময় চেয়ে আবেদন করেন।

পরবর্তীতে ২৩শে ডিসেম্বর দুদকের সেগুন বাগিচার প্রধান কার্যালয়ে হাজির হন তিনি। ওইদিন সকাল দশটা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত দুদকের উপ-পরিচালক সামছুল আলমের নেতৃত্বে একটি দল শাহীনুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সেদিন সাংবাদিকরা কথা বলার চেষ্টা করলেও তিনি তা এড়িয়ে গিয়ে দ্রুত দুদক কার্যালয় ত্যাগ করেন।

সূত্র জানায়, রাজউকে কর্মরত থেকে ঘুষের টাকায় অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন শাহীনুল। তিনি ঢাকার উত্তরাতেই গড়েছেন ১০ তলা ভবন। যার নাম সুফিয়া ভবন।

এছাড়া নিজ গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় রয়েছে একাধিক ইটভাটা। যা তার ভাই দেখাশোনা করেন। পাশাপাশি গ্রামের বাড়িতেই একটি ডুপ্লেক্স ভিলা গড়েছেন এই রাজউক কর্মকর্তা। এছাড়া ঢাকায় আরো একটি ফ্ল্যাটের মালিক শাহীনুল।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের একজন কর্মকর্তা জানান, শাহীনুলের ব্যাপারে অনুসন্ধান চলছে। অনুসন্ধান শেষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

পরিচালক শাহীনুল ইসলামের বিরুদ্ধে দেয়া অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মো. সাঈদ নূর আলম বলেন, তার বিষয়ে অভিযোগ আমরা পেয়েছি। তদন্তের অনুমোদনের জন্য নোট দেয়া হয়েছে। অনুমোদন পেলে তার বিষয়ে অসুন্ধান শুরু হবে।

সূত্র: মানবজমিন