সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান
সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান

সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী আজ

সাবেক প্রধান বিচারপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০১৪ সালের ১১ জানুয়ারি তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।

প্রধান বিচারপতি ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা- এই দুটি পরিচয়ের বাইরেও তিনি একজন গবেষক ও লেখক শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ, ভাষা সৈনিক, অভিধানপ্রণেতা- এমন অনেক পরিচয়েই তাকে ভূষিত করা যায়। ১৯৪৯ হতে ৫২ পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনেও সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিলো তার। তিনি ছিলেন কোষগ্রন্থ রচনায় সমগ্র বাংলাসাহিত্যে অদ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব।

হাবিবুর রহমানের জন্ম ১৯২৮ সালের ৩ ডিসেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গীপুর মহকুমার দয়ারামপুর গ্রামে মুহাম্মদ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তার বাবা মৌলভী জহিরউদ্দিন বিশ্বাস জাতীয় যুক্তফ্রন্টের বিভাগীয় নেতা ছিলেন।

ভারত বিভাগের পর ১৯৪৮ সালে মুর্শিদাবাদ ছেড়ে জহিরউদ্দিন বিশ্বাস রাজশাহীতে চলে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে ১৯৪৯ সালে বিএ সম্মান ও ১৯৫১ সালে এমএ পাস করেন মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। পরে ১৯৫৮ সালে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আধুনিক ইতিহাসে বিএ সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন তিনি। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। সেখানে ইতিহাসের রিডার (১৯৬২-৬৪) ও আইন বিভাগের ডিন (১৯৬১) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৬৪ সালে তিনি আইন ব্যবসাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন এবং ঢাকা হাইকোর্ট বারে যোগ দেন। পরে সহকারী অ্যাডভোকেট জেনারেল (১৯৬৯) ও হাইকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্টের (১৯৭২) দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ বার কাউন্সিলেরও (১৯৭২) সদস্য ছিলেন।

১৯৭৬ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত তিনি হাইকোর্টের বিচারপতি ছিলেন। ১৯৮৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে নিয়োগ লাভ করেন। ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত আপিল বিভাগের বিচারপতি ছিলেন। এরপর ১৯৯৫ সালে প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন। অবশ্য একই বছরে অবসরে যান তিনি।

অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন শেষে তিনি ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারেরও প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন প্রণীত হওয়ার পর তিনিই প্রথম এ দায়িত্ব পালন করেন।

উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা প্রবর্তনে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা করেছেন। নির্লোভ ও নির্মোহ স্বভাবের এই মানুষটি ছিলেন অত্যন্ত উঁচুমানের লেখক। নীরবে-নিভৃতে তিনি দু’হাতে লিখে গেছেন।

৭০টির বেশি বইয়ের লেখক বিচারপতি হাবিবুর রহমানের প্রবন্ধ বইয়ের মধ্যে রয়েছে- মাতৃভাষার সপক্ষে রবীন্দ্রনাথ (১৯৮৩), রবীন্দ্র প্রবন্ধে সংজ্ঞা ও পার্থক্য বিচার (১৯৮৩), কোরান সূত্র (১৯৮৪), রবীন্দ্র রচনার রবীন্দ্রব্যাখ্যা (১৯৮৬), রবীন্দ্রবাক্যে আর্ট, সঙ্গীত ও সাহিত্য (১৯৮৬), বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক (১৯৯৬), যথাশব্দ (১৯৭৪), বচন ও প্রবচন (১৯৮৫), বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক (১৯৯৬), তেরই ভাদ্র শীতের জন্ম (১৯৯৬), কলম এখন নাগালের বাইরে (১৯৯৬), আমরা কি যাব না তাদের কাছে যারা শুধু বাংলায় কথা বলে (১৯৯৬), বাংলাদেশের সংবিধানের শব্দ ও খন্ডবাক্য (১৯৯৭), বাংলাদেশের তারিখ (১৯৯৮), বং বঙ্গ বাঙ্গালা বাংলাদেশ (১৯৯৯), সরকার সংবিধান ও অধিকার (১৯৯৯), মৌসুমী ভাবনা (১৯৯৯), মিত্রাক্ষর (২০০০), কোরান শরিফ সরল বঙ্গানুবাদ (২০০০), চাওয়া-পাওয়া ও না- পাওয়ার হিসেব (২০০১), স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন ও বোবার স্বপ্ন (২০০২), রবীন্দ্র রচনায় আইনি ভাবনা (২০০২), বিষন্ন বিষয় ও বাংলাদেশ (২০০৩), প্রথমে মাতৃভাষা পরভাষা পরে (২০০৪), রবীন্দ্রনাথ ও সভ্যতার সংকট (২০০৪), দায়মুক্তি (২০০৫), উন্নত মম শির (২০০৫), এক ভারতীয় বাঙালীর আত্মসমালোচনা (২০০৫), একজন ভারতীয় বাঙালীর আত্মসমালোচনা (২০০৫), কোথায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ (২০০৬), শিক্ষার্থী ও শিক্ষাদাতাদের জয় হোক (২০০৭), বাংলার সূর্য আজ আর অস্ত যায় না (২০০৭), উদয়ের পথে আমাদের ভাবনা (২০০৭), যার যা ধর্ম (২০০৭), বাংলাদেশের তারিখ ২য় খন্ড (২০০৭), রাজার চিঠির প্রতীক্ষায় (২০০৭) এবং জাতি ধর্মবর্ণনারীপুরুষ নির্বিশেষে (২০০৭)। শিক্ষার্থী ও শিক্ষাদাতাদের জয় হোক (২০০৭), বাংলার সূর্য আজ আর অস্ত যায় না (২০০৭) ও স্বাধীনতার দায়ভার (২০০৭)।

তার কবিতাগ্রন্থ চারটি। এগুলো হলো কলম এখন নাগালের বাইরে (১৯৯৭), মনের আগাছা পুড়িয়ে (১৯৯৮), সাফ দেলের মহড়া (২০০৪) এবং মানুষের জন্য খাঁচা বানিও না (২০০৭)।

জীবনে সংবর্ধনা, সম্মাননা ও স্বীকৃতির অভাব নেই তার। তিনি ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও ২০০৭ সালে একুশে পদক অর্জন করেন।

এ ছাড়া দেশি-বিদেশি অসংখ্য খেতাব ও সম্মানে তিনি ভূষিত হয়েছেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস গবেষণা পরিষদ পুরস্কার, ইব্রাহিম মেমোরিয়াল পুরস্কার, অতীশ দীপংকর পুরস্কার, হিউম্যান ডিগনিটি সোসাইটি থেকে সরোজিনী নাইডু পুরস্কার, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য মার্কেন্টাইল ব্যাংক পুরস্কার-২০০৫ ও স্পেশাল কনট্রিবিউশন টু হিউম্যান রাইটস পুরস্কারসহ আরো অনেক পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি।

মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের তার কর্মকাণ্ড ও সৃষ্টির জন্য বাঙালি গণমানসে অনেক অনেক দিন জাগ্রত থাকবেন।