সাব্বির এ মুকীম
সাব্বির এ মুকীম

ভারতের উচ্চ আদালতে শিশুর বিচারিক শ্লীলতাহানি

সাব্বির এ মুকীম:

যৌন হয়রানী

যৌন হয়রানির অভিযোগে গ্রেপ্তারকৃত রাজশাহী শহরের ৬০ বছর বয়স্ক ভিক্ষুক জনাব এনামুল হক বলুর দুর্ভাগ্য তিনি বিচারপতি পুষ্প বীরেন্দ্র গানেড়িওয়ালা কে বিচারক হিসেবে পাবেন না। একইভাবে আব্দুল হালিম প্রামানিক (জবি), আলী রাজন তালুকদার (কুবি), বিষ্ণু কুমার অধিকারি (রাবি), সানোয়ার সিরাজ (জাবি) এবং কামালউদ্দিন (ঢাবি) গয়রহঃরাও জনাব এনামুল হক বলুর দুর্ভাগ্যবান- বিচারপতি পুষ্প বীরেন্দ্র গানেড়িওয়ালা কে বিচারক হিসেবে পাবেন না।

বিচারপতি পুষ্প বীরেন্দ্র গানেড়িওয়ালা

মহিলা বিচারপতি পুষ্প ভারতের বোম্বে হাইকোর্টের বর্তমানে ৫০ নং ক্রমিকের বিচারপতি। ২০০৭ সালে তিনি জেলা জজ হিসেবে নিয়োগ পান এবং মুম্বাই এবং নাগপুরের জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আইনশাস্ত্রের গোল্ড মেডেল পাওয়া এই ছাত্রী মহারাষ্ট্র জুডিসিয়াল অ্যাক্যাডেমি জয়েন্ট ডিরেক্টর হিসেবেও কাজ করেছেন। বোম্বে হাইকোর্টে ২০১৯সালে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি উক্ত হাই কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন।

আলোচ্য আপিলের তথ্য

এ বছরের বিগত ১৯ জানুয়ারি বিচারপতি পুষ্প বোম্বে হাইকোর্টের নাগপুর বেঞ্চের ২০২০ সালের ১৬১ নং ফৌজদারি আপিলের রায় প্রদান করেন। মামলায় অভিযুক্তর নাম সতীশ। ঘটনার সময় তার বয়স ছিলো ৩৯ বছর। রায়ে নালিশকারী নারীর নাম এবং ভিকটিমের নাম বিচারপতি পুষ্প গোপন রেখেছেন।

নালিশ

এই ঘটনাটা ২০১৬ সালের তখন ভিকটিম মেয়ে শিশুটির বয়স ছিল ১২ বছর। মানে বিচারপতি পুষ্প যখন রায় দেন তখনও মেয়েটির নাবালকই রয়ে গেছে। নালিশকারী ছিল বাচ্চাটির মা, বিচারপতি পুষ্প বাচ্চাটির নাম দিয়েছেন “লক্ষ্মী”।

১৪ ই ডিসেম্বর ২০১৬ সাল বেলা অনুমান সাড়ে এগারোটার সময় লক্ষ্মীর মা লক্ষীকে পেয়ারা আনতে পাঠান। কিন্তু অনেকক্ষণ পরও লক্ষ্মী ফেরৎ আসেনি। মা লক্ষ্মী কে খুঁজতে বের হন। খোঁজার সময় তাঁকে এক প্রতিবেশী জানায় যে সে দেখেছে সতীশের সাথে লক্ষ্মী সতীশের ঘরের দিকে গেছে। লক্ষ্মীর মা “লক্ষ্মী! লক্ষ্মী!” বলে ডাকতে ডাকতে সতীশের ঘরের দিকে গিয়ে দেখেন সতীশ ঘর থেকে বের হয়ে আসছে। লক্ষ্মীর মা সতীশ কে জিজ্ঞেস করেন ”লক্ষীকে দেখেছো?“ সতীশ বলে ”না, দেখি নাই।” তবুও লক্ষ্মীর মা সতীশের ঘরে ঢোকেন এবং দেখেন একটি রুমের দরজা বাইরে থেকে আটকানো। সম্ভবত ভিতর থেকে মৃদু আওয়াজও আসছিল। মা ওই দরজা খুলেই দেখেন ভিতরে লক্ষ্মী, কাঁদছে। লক্ষ্মী জানায় পেয়ারা দেবে বলে সতীশ লক্ষীকে সতীশের ঘরে এনে লক্ষ্মীর স্তনমর্দন শুরু করে এবং পাজামা খোলার চেষ্টা করে। তখন লক্ষ্মী চিৎকার শুরু করলে সতীশ তাকে ছেড়ে দিয়ে রুমের দরজা আটকে চলে যায়।

মামলা দায়ের

লক্ষ্মীর মা স্থানীয় থানায় ২০১৬ সালের ৪০৫ নং অপরাধ মামলা দায়ের করেন। মামলায় ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৫৪ ধারা, ৩৬৩ ধারা, ৩৪২ ধারা এবং যৌন নিপীড়ন হতে শিশু সুরক্ষা আইন ২০১২ এর ৮ ধারার অভিযোগ করা হয়।

বিচারিক আদালতের কার্যক্রম ও সাজা

নাগপুরের সংখ্যাতিরিক্ত যুগ্ম অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে ২০১৭ সনের ২৮ নং সুরক্ষা মামলা হিসেবে সে অভিযোগের বিচার হয়।

বিগত ৫ ফেব্রুয়ারী ২০২০ তারিখে অভিযুক্ত সতীশকে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সকল ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে মোট পাঁচ বছর ৬ মাস সশ্রম কারাদণ্ড এবং১৫০০ ভারতীয় রুপী অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরও ৩ মাসের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।

আপিল

সাজার আদেশের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের করে আপিল আদালতের বিচারপতি পুষ্পা সতীশকে শিশু সুরক্ষা আইনের ৮ ধারায় অপরাধী নয় মর্মে ঘোষণা করে তিনি সতীশ এর অপরাধ কে ছিঁচকে অপরাধ তথা “Minor Offence” (রায়ের ২৭অনুচ্ছেদের ৩য় লাইনের ৪র্থ ও ৫ম শব্দ) হিসেবে গণ্য করে নিম্ন আদালতের প্রদত্ত সাজা কমিয়ে ১ বছর ৬ মাসের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ১০০০ ভারতীয় রুপী অর্থদণ্ড অনাদায়ে ২ মাসের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করেন। একই সাথে ২টি আলাদা ধারায় সাজা হওয়ায় একত্রে সাজা ভোগ হিসেবে মূলত তাকে এক বছরের কারাদণ্ড প্রদান করেন।

আপিলের রায়ের ১ম মজা

এটি অনেক মজাদার রায়। ১ম মজা হলো নিম্ন আদালতের রায় এ দণ্ডবিধির ৩৬৩ ধারায় দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ৫০০ টাকা অর্থদণ্ড ছিল। আপিলের রায় ৩য় অনুচ্ছেদের ২য় প্যারা তার উল্লেখ আছে। কিন্তু আপিলের সিদ্ধান্তে এ সম্বন্ধে বিচারপতি পুষ্প কিছুই বলেননি।

আপিলের রায়ের ২য় মজা

২য় মজার বিষয় হলো শিশু সুরক্ষা আইন ৭ ধারায় যৌন নিপীড়নের সংজ্ঞা এবং ৮ ধারায় যৌন নিপীড়নের সাজা তুলে দেয়া আছে। সেসব পাঠ করে যৌন নিপীড়নের যে উপাদান গুলো রায়ের ১৬ অনুচ্ছেদে বিচারপতি পুষ্প পান তা হলোঃ-

(১) অপরাধ করার পেছনে অবশ্যই যৌন লালসা থাকতে হবে

(২) শিশুর যোনী পুরুষাঙ্গ পায়ুপথ বা স্তনের স্পর্শ করতে হবে

অথবা

শিশুটিকে যোনী পুরুষাঙ্গ পায়ুপথ বা স্তনের স্পর্শ করতে বাধ্য করতে হবে

অথবা

সঙ্গম ব্যতীত এমন কোনো শারীরিক আচরণ করতে হবে যাতে যৌনলালসা থাকে।

বিচারপতি পুষ্পার এই বিশ্লেষণ করেই তার পাঞ্চ লাইন পান যে সবচেয়ে প্রধান উপাদান হলো স্পর্শ। এরপর বিচারপতি পুষ্প রায়ের ১৮ অনুচ্ছেদে দেখান যে এমন কিছু প্রমাণ হয় না যে সতীশ স্তন্য মর্দন করার জন্য লক্ষ্মীর কাপড় খুলে স্তন মর্দন করা হয়েছে কিংবা লক্ষ্মীর জামার ভিতরে হাত ঢুকিয়ে লক্ষীর স্তন মর্দন করেছে।

 চামড়ায় চামড়ায় ঘষার গুরুত্ব

বিচারপতি পুষ্পার মতে শিশু সুরক্ষা আইনের ”স্পর্শ” উপাদান তখনই হয় যখন চামড়ায় চামড়ায় ঘষা লাগে।  রায়ের ২৬ অনুচ্ছেদের শেষ লাইন এর শেষ লাইনটা হলো- “As such there is no direct physical contact i.e. skin to skin with sexual intent without penetration

কোনো কোনো ভারতীয় গণমাধ্যম এ্ই রায় এর নাম দিয়েছেন স্কিন টু স্কিন টাচ জাজমেন্ট বা চামড়া চামড়ায় ঘষা রায়।

আরও একটু অন্ধকার, গাঢ়ও

যৌন নিপীড়ন উপমহাদেশের গণ মনস্তত্বের কতোটা গভীরে বাস করে তা এই নারী বিচারপতির এই রায়ে আমি তার আরও ১টি প্রগাঢ় চিহ্ন খুঁজে পেয়েছি। একজন নারী বিচারপতি তার কাছে শ্লীলতাহানীর বিচার চাইতে আসা শিশু “লক্ষী”কে আবারও শ্লীলতাহানি করলেন- এই শ্লীলতাহানীর নাম বিচারিক। লক্ষীর শ্লীলতাহানীর এই রায়ের এই পর্যবেক্ষণ দ্বারা কেবল লক্ষীকেই নয়, বিচারপতি পুষ্পা জুরিসপ্রুডেন্সেরও শ্লীলতাহানি করেছেন বলে আমি অনুভব করি।

সর্বশেষ আপডেট

ভারতের প্রধান বিচারপতি গত ২৭জানুয়ারি ২০২১তারিখে এ রায় কে স্থগিত করেছেন। কিন্তু .. .. .. তাতে কি? ভারতের বিচার বিভাগের ইতিহাসে একটি স্কিন টু স্কিন টাচ জাজমেন্ট নামের কলঙ্ক লেপন হলো।

বিঃদ্রঃ- আলোচ্য রায়টি পেতে ১মে বোম্বে হাইকোর্টের পেজ তথা এই লিংকে যেতে হবে (https://bombayhighcourt.nic.in/index.html  )। এরপর তারপর ১ম সারি ট্যাবগুলোর মধ্যে ৩নং ট্যাব তথা Court Orders এ ক্লিক করলে সাব-ট্যাব কতগুলো আসবে। সেখান হতে ৩ নং সাব-ট্যাব Rep/Judgment/Orders ক্লিক করতে হবে। যে পেজটি ওপেন হবে তাতে Side লেখা বারে ক্লিক করে স্ক্রলকরে নেমে Nagpur-Criminal সিলেক্ট করতে হবে। এরপর From Date এ ১৯ জানুয়ারী ২০২১ এবং To Date Security ২০ জানুয়ারী ২০২১ সিলেক্ট করে Code এর বক্সে প্রদত্ত কোড দিয়ে পূরণ করে ক্লিক করলেই আলোচ্য আপিলের রায়ের পিডিএফ কপি পাওয়া যাবে।

অথবা আমাকে মেইল করলে আমি ফিরতি মেইলে দিয়ে দিতে পারবো। ধন্যবাদ।

সাব্বির এ মুকীম: এডভোকেট, কুমিল্লা জজ কোর্ট; ই-মেইল: samukim1@gmail.com