আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল

আইসিসিতে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের রায় ঘোষণা

২০১৮ সালে ময়মনসিংহের ১১ জনের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত মানবতা বিরোধী অপরাধে অভিযোগ গঠন করে আন্তজার্তিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

এদের মধ্যে কারাগারে আছেন- ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার পাগলা থানার নিগুয়ারী ইউনিয়নের সাধুয়া গ্রামের মো. খলিলুর রহমান মীর (৬২), একই গ্রামের মো. সামসুজ্জামান ওরফে আবুল কালাম (৬৫), একই গ্রামের মো. আব্দুল্লাহ (৬২), মো. রইছ উদ্দিন আজাদী ওরফে আক্কেল আলী (৭৪)। এছাড়া আসামি আব্দুল লতিফ স্বেচ্ছায় ট্রাইব্যুনালে হাজির হন।

গ্রেফতারের পর বিচারচলাকালে মো. আব্দুল মালেক আকন্দ ওরফে আবুল হোসেন ওরফে আবুল মেম্বার (৬৮) মারা যান। আর পলাতক অবস্থায় মারা যান নুরুল আমীন শাজাহান। এখন পর্যন্ত পলাতক আছেন- এএফএম ফায়জুল্লাহ, মো. আব্দুর রাজ্জাক মণ্ডল, সিরাজুল ইসলাম ও মো. আলীম উদ্দিন খান।

আজ বৃহস্পতিবার (১১ ফেব্রুয়ারি) মামলায় অভিযুক্ত ৯ জনের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করবেন ট্রাইব্যুনাল।

তাদের বিরুদ্ধে হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগসহ চারটি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে রয়েছে চারজনকে হত্যা, ৯ জনকে অপহরণ ও নির্যাতনের অভিযোগ।

প্রথম অভিযোগ

১৯৭১ সালের ১৬ অগাস্ট (৩০ শ্রাবণ ১৩৭৮ বাংলা) বেলা আনুমানিক ১২টার দিকে গ্রেফতার ও অভিযুক্ত অন্যান্য আসামিসহ ১০/১২ জন রাজাকাটরা সাবেক গফরগাঁও উপজেলার পাগলা থাকা এলাকায় নিগুয়ারী ইউনিয়নের সাধুয়া গ্রামের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সাহাবুদ্দিন ওরফে খোকা খান, স্বাধীনতার সপক্ষের নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালি হাশেম খান, আনিসুর রহমান খানের বাড়ি ঘেরাও করে।

রাজাকারদের দেখে ভয়ে পালানোর সময় আবুল হাশেম খান ও আনিছুর রহমান খানকে ধরে নির্যাতন শুরু করে। রাজাকাররা তাদের বাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে এবং আসামিরা সাহাবুদ্দিন ওরফে খোকা খানকে অপহরণ করে আটক করে নিগুয়ারী ইউনিয়ন পরিষদের পাশে ত্রিমোহনী বাজারে স্থাপিত রাজাকার ক্যাম্প নিয়ে ৭ (সাত) দিন ক্যাম্পে আটক রেখে নির্যাতন করে ২৩ আগস্ট ১৯৭১ (বাংলা ৬ ভাদ্র ১৩৭৮) রাতে হত্যা করে লাশটি সুতিয়া নদীতে ফেলে দেন।

দ্বিতীয় অভিযোগ

১৯৭১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর (৫ আশ্বিন ১৩৭৮) দিবাগত রাতে আসামিরা এবং পাকিস্তানি সেনা সদস্য পাগলা থানার টাঙ্গাব ইউনিয়নের রৌহা গ্রামের মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং প্রাপ্ত নূর হোসেন ব্যাপারীর বাড়ি ঘেরাও করে। তারা বাড়ি এবং সামনের দোকান লুটপাট করে নূর হোসেন ব্যাপারীসহ আটজনকে নির্যাতন করতে করতে বারইহাটি বাজারে রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। টাকা নিয়ে কয়েকজনকে ছেড়ে দিলেও নূর হোসেন ব্যাপারীকে আটক রেখে ওই রাতে কালিবানার ব্রহ্মপুত্র নদের ঘাটে (চরহী ঘাট) নিয়ে গুলি করে হত্যার পর লাশ নদীতে ফেলে দেয়।

তৃতীয় অভিযোগ

১৯৭১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর (৭ আশ্বিন ১৩৭৮) আছরের নামাজের পর আসামিরা পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর ৪/৫ জন সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে পাগলা থানার সাধুয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মজিদের (মৃত) বাবা জৈধর খান ওরফে তারু খাঁর বাড়িতে লুটপাট চালানোর পর অগ্নিসংযোগ করে। জৈধর খাঁ ও তার ভাই জমধর খাঁকে ত্রিমোহনী বাজারে রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। ক্যাম্পে আটকে রেখে নির্যাতনের পর ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে তাদের গুলিতে হত্যা করে লাশ সুতিয়া নদীতে ফেলে দেয়।

চতুর্থ অভিযোগ

১৯৭১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর (১০ আশ্বিন ১৩৭৮ বাংলা) সকাল ৯/১০ টার দিকে আসামিরাসহ আরও ১০/১২ জন রাজাকার পাগলা থানার সাধুয়া গ্রামের ধনাঢ্য ব্যক্তি তৈয়ব আলী সরকারের বাড়ি ঘেরাও করে তাকে ও তৈয়ব আলীর ছেলেকে খোঁজে না পেয়ে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। দুদিন পর তৈয়ব আলী সরকারসহ তিনজনকে ধরে পাত্থার বিলে রাখা রাজাকারদের নৌকায় তোলা হয়। তখন ৪ হাজার টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে একজনকে ছেড়ে দেয়, একজনকে নির্যাতন করে মৃতপ্রায় অবস্থায় বিলের পাড়ে ফেলে দেয়।

আর তৈয়ব আলী সরকারকে সাধুয়া পাত্থার বিলের পানিতে চুবানো হয়। মৃতপ্রায় অবস্থায় নৌকায় তুলে রাজাকাররা অস্ত্র দিয়ে পিটিয়ে তাকে জখম করে। এরপর লাথি মারতে মারতে নৌকা থেকে বিলে ফেলে দেয়। তিন দিন পর বিলে তৈয়ব আলী সরকারের লাশ ভেসে উঠলে স্থানীয়রা লাশ পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করে।

২০১৪ সালের ১৬ অক্টোবর মামলার তদন্ত শুরু হয়ে ২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি শেষ হলে ২০ ফেব্রুয়ারি প্রসিকিউশনে জমা হয়েছে। তদন্তে ৬০ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হলেও ২৯ জনকে সাক্ষী করা হয়েছিল। এছাড়া জব্দ তালিকার সাক্ষী ছিলেন আরও দুজন। তবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাসহ (আইও) মোট ১৮জন সাক্ষী দেন আদালতে।

অভিযোগ গঠনের পর ২০১৮ সালের ১০ মে থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ ও শুনানি শুরু হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তাসহ (আইও) মোট ১৮ জন সাক্ষী তাদের জবানবন্দি পেশ ও সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে ২০১৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর যুক্তিতর্কের সমাপ্তির মধ্য দিয়ে ২০২০ সালের ২৬ জানুয়ারি মামলাটি রায়ের জন্যে সিএভি অপেক্ষমাণ রাখেন।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মনোয়ারা বেগম জানান, আসামিরা স্বাধীনতার পর গফরগাঁও থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে বসবাস শুরু করে এবং এক পর্যায়ে ওই সব এলাকাতেই স্থায়ী হন।