অ্যাডভোকেট সাব্বির এ মুকীম

বাংলায় আইন চর্চা : চর্চার আগে চিনতে হবে

সাব্বির এ মুকীম:

নতুন ১টা ইংরেজি শব্দ-যুগল শিখলাম ১টা Meme হতে, তা হলো Poseidon’s Kiss.

হাই কমোডে বসে হাগু করছেন, শক্ত হাগু। টেকনিক্যাল কারণে হাই কমোডে সবসময়ই ১টু পানি থাকতে হয়- ময়লা সহজে পরিষ্কার হবে। ধরেন হাগুর শক্ত দলা সে জমা পানিতে পড়ে পানি ছিটকে উঠে আপনার পাছায় লাগতে পারে। এই ঘটনা হতে মুক্ত থাকতে সাবধানতা হিসেবে হাইকমোড ইউজের গ্রামার হচ্ছে কমেডের বসার আগে কমোডের পানিতে কিছু টয়লেট টিস্যু ছেড়ে দিতে হয়, তাহলে আর হাগুর দলাঘটিত পানির ছিটা পাছায় লাগবে না।

এই যে হাগুর দলা কমোডের পানিতে পড়ে পানি ছিটকে এসে পাছায় লাগে, এই ঘটনাটাকে ইংরেজিতে বলে Poseidon’s kiss.

পোসাইডন, গ্রিক মিথোলজিতে সমুদ্রের দেবতা, একটু ঝগরাটে দেবতা; দেবরাজ জিউসের ভাই। বাংলাদেশের মাঝিরা তাঁকে একসময় চিনতেন, “বদর পীর” হিসেবে।

ইংরেজি ভাষীদের চিন্তার বিস্তার দেখা গেলো, টয়লেটে বসতে গেলে পাছায় পানি লাগে সেই ঘটনা কে চিন্তায় অন্তর্ভুক্ত করে তার এমন ১টা নাম দেয়া হলো যাতে মিথ ও ঢুকে গেলো। কেবল চিন্তা করার অভ্যাস থাকলেই এমন চিন্তা বিস্তার সম্ভব।

বাংলা ভাষায় কি এমন চিন্তা বিস্তারের নজীর নাই?  আছে।

ধরা যাক, অগোচরে শব্দ টা। পরিবারের অগোচরে তারা ২জন বিয়ে করে । অগোচরে মানে গোচরের বাইরে। বিষয় টা আমার গোচরে ছিলো না। এই গোচরে শব্দের মানে গল্প টা হলো, গো তথা গরু চরে যেথা। রাখালেরা সকাল বেলা গরু মাঠে নিয়ে চরাতে ছেড়ে দিতো আর উঠে বসতো গাছে। গাছ ছিলো রাখালদের ওয়াচ টাওয়ার। এই ওয়াচ টাওয়ার থেকে যতদূর সীমায় চোখ রাখা যেতো তার নাম ছিলো গোচর। পসাইডনের চুম্বনের মতো গল্পের ঝাঁপি আছে অগোচরে শব্দের ও।

গোচর শব্দের বর্তমান পরিস্থিতিতে আসার ২টা স্তর পেলাম,  ১মত গোচর শব্দের গল্প। সেই গল্প দ্বারা কল্পনায় নতুন গল্প তৈরী করে দেয়া।

ভাষা শেখার মানে হলো ভাষার এই গল্প গুলো কে অনুধাবন করে ধারণ করা এরপর নতুন গল্প তৈরী করা কল্পনা কে কাজে লাগিয়ে। ভাষা শেখার মানেই হলো এই ২টা স্তরে বসবাস করার সুযোগ তৈরী করতে পারা।

আমাদের কল্পনাগুলো সম্পূর্ণ ভাবে গল্প নির্ভর। এই গল্পগুলো কে আয়ত্বে আনতে পারাই ভাষা-সাফল্য।

ভাষা সফলতা সহজপাচ্য হয় মাতৃভাষায়। আর মাতৃভাষা তখনই আয়ত্বে আসে যখন আমরা ভাষার এই গল্পগুলো নিয়ে চেতন হই। যেকোনো ভাষায় গল্পগুলো আয়ত্ব আনার ১টি ফল হলো আমরা অন্য ভাষা আর অপরিচিত থাকে না।

শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ নির্বিশেষে সবাই যেমন ১ই মানুষ প্রাণী, তেমনি ইংরেজি, বাংলা, সোহায়েলি নির্বিশেষে সবই আসলে ১ই জ্ঞানের গল্প। জ্ঞানী হতে হলে ভাষার গল্পগুলো লাগবেই, তা যে ভাষীক ই হোক না কেনো। জ্ঞান অর্জনে ভাষার এই গল্পগুলোই জ্বালানি যোগায়। একারণেই যারা মাতৃভাষা ভালো শিখে, তারা সহজেই অন্য ভাষা শিখতে পারে। ভালো করে শেখা মানেই জ্ঞান কান্ডে প্রবেশ করা।

ভাষার গল্পগুলো জানলে আমরা কল্পনা কে কাজে লাগিয়ে নতুন গল্প (কিংবা গল্পের নতুন রূপ)  তৈরী করতে পারি আর নতুন গল্প তৈরী করার মাধ্যমেই আমরা জ্ঞান কান্ডের নির্মাণ যজ্ঞের ১জন নির্মাতা হই।

একই সুত্র জ্ঞান এর সকল শাখার জন্য প্রযোজ্য। আইন শাখার জন্য ও।

আইন পড়ে আপনি শিখেছেন Every right has corresponding duty and every duty has corresponding right.

একই রকম জিনিস ফিজিক্স পড়ে শিখতেন  এভাবে, For every action, there is an equal and opposite reaction.

Legitimate expectation বলে  আইনে ১টা গল্প আছে। আইনের এই ভাষার গল্পটা পড়ে আয়ত্ব করতে পারলেন কিনা তা প্রমাণ হয় তখনই যখনই এই শব্দ যুগল দিয়ে তিনি নতুন গল্প কল্পনা করতে পারবেন। আপনি ১জন বিপরীত লিঙ্গের ক্লাসমেটের পিছনে পিছনে ঘুরছেন। তাকে সব নোট করে দেন, তার বাড়ীর বিড়াল টার মাছের যোগান নিয়ে মাথা ঘামান। ৩ বছর পরে, সে হুট করে অন্যজন কে বিয়ে করে ফেলে। আপনি বহুবার তাকে ভালোবাসেন বললেও সে কখোনই আপনাকে ভালোবাসি বলে নাই। তবুও হুট করে আপনাকে ছ্যাঁকা দিয়ে উনি যে আইনটা ভাঙ্গলেন, তার সাংবিধানিক আইনে নাম হলো Legitimate Expectation.

আইনের গল্পগুলো চিনে কল্পনা ইউজ করে যখন নতুন গল্প তৈরী করতে পারবেন, তখনই বলতে পারবেন আইনের ভাষাটা আপনি শিখেছেন।

বাংলা ভাষায় আইন চর্চার সবচে বড়ো পিছুটান টা হলো আইনের গল্প গুলো আয়ত্ব না করেই আমরা চর্চা করতে চাই। ফলে গালভরা অনেক কথা বের হয়, কিন্তু আইন চর্চা টা আর হয়ে ওঠে না।

উদাহরণ হিশেবে “ন্যায়-বিচার” শব্দযুগলের গল্পটা আবার বলি।

আগের দিনে রাজ গৃহে নতুন মানব শিশু জন্ম নিলে তার ভাগ্য জানতে গ্রহ নক্ষত্র যাচাই করে সিদ্ধান্ত দেয়া হতো। এই সিদ্ধান্তের নাম গ্রহ নক্ষত্র বিচার। বিচার মানে সিদ্ধান্ত।

ন্যায় বিচার মানে ন্যায় সিদ্ধান্ত। সকল ন্যায় বিচার ই বিচার আবার সকল অবিচার ও বিচার যেহেতু বিচার মান সিদ্ধান্ত তাই বিচার অবিচার ও হতে পারে আবার ন্যায় বিচারও হতে পারে। তথা অবিচার ও ন্যায় বিচার হতে পারে।

এবার আসেন ন্যায় বিচার কি মানে সিদ্বান্ত কখন ন্যায় সিদ্ধান্ত হয়।

আমাদের স্কুল ১টা ট্রান্সলেশন শেখায়, করিম রহিমের ন্যায়। এর ইংরেজি ট্রান্সলেশন হবে Karim is like Rahim.

ইংরেজি Like শব্দের জনপ্রিয় বাংলা মানে পছন্দ হলেও আরও ১টা মানে ন্যায় বা “মতো”।

ন্যায় বিচার মানেই Like বিচার।

রহিম খুন করছে তাই রহিমের ফাঁসির সাজা হয়েছে। করিমও খুন করেছে। রহিমের ন্যায় বিচারে করিমের ও ফাঁসির সাজা হবে।

ন্যায় শব্দটা আসছে জ্যামিতি থেকে,  ন্যায় রেখা মানেই সমান্তরাল রেখা। সমান্তরাল রেখা মানেই হলো ২টি রেখা তাদের সকল অংশে ই দেখতে ১ই রকম।

রহিম সত্য কথা বলছে। সত্য বলার জন্য রহিমকে খুন করা হয়। করিমও সত্য কথা বলছে। রহিমের ন্যায় বিচারে করিমও খুন হবে। সত্য বলার জন্য খুন হওয়া অবিচার হলেও করিমের খুন হওয়া রহিমের ন্যায় বিচার। যেহেতু রহিমও সত্য বলার জন্য খুন হয়েছে। অবিচার ও যে ন্যায় বিচার হতে পারে, সেটা দেখাতে এই উদাহরণ অবতারণা করা হলো।

ন্যায় বিচার শব্দযুগলের অর্থ হলো সমান্তরাল সিদ্ধান্ত আর গল্প হলো, সকল ঘটনায় ১ই মাপকাঠিতে সিদ্ধান্ত দেয়া। সেই মাপকাঠি টাই হলো আইনসভা প্রনয়ণ করা আইন সমূহ।

হাজার বছর বাংলা ভাষায় আইন চর্চা করলেও আইনের এই গল্প গুলো আত্মসাৎ করতে না পারলে অবস্থার অবনতি বৈ আর কিচ্ছু হবে না।

তাই বাংলায় আইন চর্চার জিগির তোলার সময় আইন এর প্রাসংগিকতায় বাংলা ভাষার যে উপনিবেশটুকু আছে, বাংলা ভাষার সে অবস্থানের মানচিত্র পরিষ্কার করে চিনতে হবে, পরিষ্কার করে আঁকতে হবে। তারপর কল্পনায় সে গল্পগুলো কে নতুন করে বলে নতুন গল্প তৈরী করতে হবে। এসবই পরিশ্রমের কাজ। ভাষা চিনতে পারলে চর্চা এমনিতেই হবে। আমাদের যা আছে, সেগুলো খুঁজে বের করতে পারলেই হবে।

ভাষা চর্চা মানে শব্দের চর্চা নয়। শব্দ চর্চা করা মানেই ভাষা প্রেম হলে অভিধান আর হালের গুগুল ট্রান্সলেটর সবচেয়ে বড়ো ভাষা সৈনিক। ভাষা চর্চা মানে ভাষায় চিন্তার চর্চা। ইংরেজিতে চিন্তার চর্চা আছে বলেই সারাবিশ্বে ইংরেজির বুদ্ধিসঞ্জাত উপনিবেশই সবচে বড়ো ভাষিক উপনিবেশ। ইংরেজিতে ভাষা চিন্তায় কতোটা শ্রম ব্যায় হলে পাছায় হাগু ছিটকে পানি লাগার ঘটনাকেও মিথ সংশ্লিষ্ট শব্দের গল্পে মোড়া যায় তা অনুধাবন করতে পারলেও মাতৃভাষা কে কিছুটা ভালোবাসা হবে।

কোম্পানি আইন কে নিগম আইন বলে বা লিখে ভাষা চর্চা হয় না বরং ভাষা ভন্ডামী হয়।

আচ্ছা, আমরা কি জানি বাংলায় “ভাষা” শব্দের পেছনের গল্প টা কি?

সাব্বির মুকীম: এডভোকেট, কুমিল্লা জজ কোর্ট

samukim1@gmail.com