কামরুন নাহার হেনা
কামরুন নাহার হেনা

দেশদ্রোহ নাকি রাষ্ট্রদ্রোহ: বাংলাদেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে বাকস্বাধীনতা

কামরুন নাহার হেনা: দেশ বলতে বোঝায় মানুষ, দেশ বলতে বোঝায় গণতান্ত্রিক অধিকার, দেশ হল বাকস্বাধীনতা ও সেই সমস্ত রকম স্বাধীনতা যেখানে মানুষ নিজের বুদ্ধি ও আবেগকে নির্দ্বিধায় সর্বসম্মুখে তুলে ধরতে পারে, নিজেই নিজেকে ইচ্ছামত প্রয়োগ করতে পারে, অর্থাৎ দেশ হল মানুষের জাগরণ মঞ্চ।

রাষ্ট্র বলতে বোঝায় আন্তর্জাতিক, বানিজ্যিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় সমারহে গঠিত ইট, বালি, পাথরের কতগুলো শহরের সমষ্টি।

ম্যাক্স ওয়েবারের প্রভাববিস্তারী সঙ্গানুযায়ী রাষ্ট্র হচ্ছে এমন এক সংগঠন যা নির্দিষ্ট ভূখন্ডে আইনানুগ বলপ্রয়োগের সব মাধ্যমের উপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ রাখে, যাদের মধ্যে রয়েছে সশস্ত্রবাহিনী, নাগরিক, সমাজ, আমলাতন্ত্র, আদালত এবং আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী।

ভূগোল মতে দেশ হল একটি ভৌগোলিক অঞ্চল। এই দেশ শব্দটি প্রায়সই রাজনৈতিক বিভাগ বা সার্বভৌমিক রাষ্ট্র অঞ্চল বা সাবেক রাজনৈতিক বিভাগের ভৌগোলিক অঞ্চলকে সূচিত করে।

বাংলাদেশ একটি একক, স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র, যাহা “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ” নামে পরিচিত।
স্বাধীন দেশ বাংলাদেশে শুনা যায়, অনেক মানুষের উপর দেশদ্রোহ করার মামলা হয়। কিন্তু কেউ দেশদ্রোহীতা করলে, তারা জেলের ভিতরে নেই কেনো, এইরকম প্রশ্ন উঠেই?

সুতরাং, এই দেশে আদৌও কি দেশদ্রোহ বলতে কোন আইন আছে!

না, নেই, আছে রাষ্ট্রদ্রোহ। দন্ডবিধি ১৮৬০ এ দেশদ্রোহ বলতে কোনো অপরাধ নেই। দন্ডবিধি ১৮৬০ সাল যখন পরিচিত হয়,তখন বাংলাদেশের অস্তিত্ব ছিল না।
দন্ডবিধি বা পেনাল কোড ১৮৬০ আইনটি পাস হওয়ার পর ইন্ডিয়ান পেনাল কোড ১৮৬০ নামে পরিচিত হয়, পরবর্তীতে এটি ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান বিভক্তির পর পাকিস্তান পেনাল কোড ১৮৬০ নামে গ্রহণ করে। বাংলাদেশ পাকিস্তানের অধীনে ছিল বিধায় পাকিস্তান পেনাল কোড ১৮৬০ নামে এটি ব্যবহৃত হয়েছে।

সতের শতাব্দীতে ব্রিটেন অর্থাৎ ইউনাইটেড কিংডম, অরিজিনালি যখন ইন্ডিয়ান পেনাল কোড লিখেছিল তখন সেটাতে রাষ্ট্রদ্রোহ নামের এই ধারা ছিল না, ১০ বছর পর ১৮৭০ সালে (Wahabi revolt) এ ব্রিটিশ সরকার এই ধারা নিয়ে আসেন,
পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ৩০শে জুন ১৯৭৩ সালে পাকিস্তান শব্দটি বাদ দিয়ে পেনাল কোড বা দন্ডবিধি ১৮৬০ করা।

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুসারে স্বাধীন দেশ বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের সাপেক্ষে ১৯৭১, ২৫ মার্চ সময়ের কার্যকর আইনগুলো বাংলাদেশের আইন হিসেবে কার্যকর হবে।
Retrospective effect এর মাধ্যমে বাংলাদেশ সংবিধানের বিধানাবলী সাপেক্ষে সকল প্রচলিত আইনের কার্যকরতা অব্যাহত থাকিবে, তবে অনুরূপ আইন এই সংবিধানের অধীন প্রণীত আইনের দ্বারা সংশোধিত বা রহিত হইতে পারিবে।

সুতরাং দন্ডবিধি ১৮৬০ এর ১২৪ক অনুসারে; যে ব্যক্তি কথিত বা লিখিত শব্দাবলীর দ্বারা অথবা চিহ্নাদি দ্বারা বা দৃশ্যমান প্রতীকের দ্বারা অথবা প্রকারান্তরে আইনবলে গঠিত সরকারের প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা করার উদ্যোগ করে অথবা বৈরিতা সৃষ্টি করে বা করার উদ্যোগ করে, সে ব্যক্তি যাবজ্জীবন বা এমন যে কোন কম মেয়াদের করাদন্ডে দন্ডিত হবে, যার সঙ্গে অর্থদন্ড যোগ করা যাবে অথবা এমন তিন বছর মেয়াদি কারাদণ্ডে দন্ডিত হবে যার সঙ্গে অর্থদন্ড যোগ করা যাবে বা অর্থদন্ডে দন্ডিত হবে।

যেমন বলেছি  এটা দেশদ্রোহ না, উক্ত ধারাটি রাষ্ট্রদ্রোহ। এখানে দেশ সম্পর্কে কিছু বলা হয় নি, বলা হয়েছে আইনবলে গঠিত সরকারের কথা।
এই ধারায় দুটো বিষয় নজর দেওয়ার মতন, যেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথমত, দেশে স্থাপিত সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না, দ্বিতীয়ত দেশের বিপক্ষে কিছু বলা এই ধারায় অপরাধ নয়।

সুতরাং এই ধারাটা সরকারের সংশোধন করা প্রয়োজন, কারণ যে ডেমোক্রেসিতে আমরা আছি এখানে সরকারের সমালোচনা করা আমাদের অন্যতম অধিকার। সরকারের আলোচনা করা আমাদের অধিকার থাকা উচিত কিন্তু দেশের বিপক্ষে কিছু বলা অপরাধ হওয়া উচিত, যেটা দেশদ্রোহীতার অন্তর্গত আনা দরকার।
সুতরাং এই ধারাকে সংশোধন ও সংযোজন করার প্রয়োজন।

আচরণ /ভাষণে মানুষকে উস্কানি দেয়া যেমন তার আচরণে রাষ্ট্রীয়/রাষ্ট্রের সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা, এটা রাষ্ট্রদ্রোহ (Sedition) ১২৪ক এর মধ্যে পড়ে, এটা একধরনের নন-বেইলেবল ওফেন্স, এই অপরাধে কোনো রকম বেইল দেওয়া হবে না।
এই আর্টিকেল কোন রাজনৈতিক আলোচনা বা বিতর্ক না বরং রাষ্ট্রদ্রোহ নিয়ে খুঁটিনাটি লেখার চেষ্টা মাত্র।

রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা যে কেউ ব্যক্তিগতভাবে দায়ের করতে পারেন না। এর উত্তর ফৌজদারী কার্যবিধির ১৯৬ ধারাতে উল্লেখ্য আছে। ঐখানে দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারার কথা বলা আছে যেগুলো সরকার নিজে না করলে বা সরকারের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন ছাড়া দায়ের করতে গেলে আদালত তা আমলে নেবেন না।
ঐ ধারাগুলির মধ্যে দণ্ডবিধির 124A অর্থাৎ রাষ্ট্রদ্রোহের মামলাও আছে।

কোথায় মানে কোন আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করা যায় এটি বলা আছে ফৌজদারী কার্যবিধির ২ নম্বর তফসিলে।

চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট অথবা চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট অথবা সরকার হতে বিশেষ ক্ষমতা প্রাপ্ত প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এই মামলা সরকার দায়ের করতে পারে বা সরকারের আনুষ্ঠানিক অনুমতি পেলে দায়ের করা যায়।

কারো বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা পরিচালনার অনুমতি সরকারের কোন অফিস থেকে নিতে হয়? পুলিশ বা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট কি এই অনুমতি দিতে পারে?

উত্তর না। সরকারের অনুমতি বলতে এই সব সরকারি কর্মকর্তার অনুমতিকে বোঝায় না।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সচিব বরাবর লিখিত আবেদন করে এই অনুমতি নিতে হয়।

উদাহরণ স্বরূপ: বেগম খালেদা জিয়া একবার বলেছিলেন যে, ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ লোক শহীদ হবার বিষয়ে যেটি বলা হয়, সেটি একটি আনুমানিক সংখ্যা, কারণ এই ৩০ লাখ শহীদের তালিকা কোথাও নেই।
এই কথা বলার জন্য ওনার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক জনাব মমতাজ উদ্দিন মেহেদী লিগ্যাল নোটিশ পাঠান এবং ওনাকে ক্ষমা চেয়ে এই বক্তব্য প্রত্যাহার করতে বলেন। বেগম খালেদা জিয়া সেই বক্তব্যটি প্রত্যাহার না করায় এডভোকেট জনাব মমতাজ উদ্দিন মেহেদী ওনার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করার জন্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন। সেই আবেদন মঞ্জুর হয়।
এর বাইরে কি আর কোনো বুদ্ধি বা পদ্ধতি আছে সরকারের কাছ থেকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার অনুমতি আদায় করার?
জ্বি আছে;
পূর্ববর্তী ঘটনা থেকে একটা উদাহরণ:

বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা।

হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে বিচারপতি জনাব শামসুদ্দিন মানিক বসা।
এএজি জনাব এবিএম আলতাফ একটি জাতীয় দৈনিকের কপি নিয়ে হাজির হয়ে বললেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক শিক্ষক একটি কমেন্ট করেছে। সেটি ছাপা হয়েছিলো একটি পত্রিকায়। সেটি পড়ে বিচারপতি জনাব শামসুদ্দিন মানিক রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে একে ধরে নিয়ে সুয়ো মোটো রুল জারি করে বসলেন। সেই রুলে সরকারের কাছে জানতে চাওয়া হলো যে কেনো সরকার ঐ শিক্ষকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করবেনা।

ঐ শিক্ষক তখন অস্ট্রেলিয়াতে উচ্চশিক্ষার জন্য অবস্থান করছিলেন। ওনাকে অবিলম্বে দেশে আসার নির্দেশ দেওয়া হলো।

পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র সচিব, বাংলাদেশের পুলিশের আইজি, অস্ট্রেলিয়ার পুলিশ প্রধান সহ সবার কাছে নোটিশ পাঠানো হয় সেই শিক্ষককে গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনার জন্য। সরকারকে উক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে জরুরী ভিত্তিতে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করার আদেশ দেওয়া হয়।
বিশেষ পরিস্থিতিতে হাইকোর্ট চাইলে সরকারকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করার আদেশ দিতে পারে। রাষ্ট্রদ্রোহীতায় ইন্ডিয়ায় বেশ কিছু উল্লেখ যোগ্য মামলা চোখে পড়ার মতন।

বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৯নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রতিটি নাগরিকের “চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক্ স্বাধীনতার

অধিকার রয়েছে, কিন্তু বাক্ স্বাধীনতাতেও কিছু প্রয়োজনীয় বাঁধা-নিষেধ আছে, সব অধিকারেই কিছু বাঁধা নিষেধ রয়েছে, অনেকের ধারণা অনুযায়ী ধারা ১২৪ক সংবিধানের ৩৯নং অনুচ্ছেদের বিপক্ষে কথা বলে, সুতরাং ধারা ১২৪ক তে কিছু বাঁধা নিষেধ দেওয়া হয়, এবং এগুলো বিখ্যাত কিছু মামলার দরুন সামনে আসে।

যখন Constitution Assemble তে বির্তক চলছিল এই ধারা নিয়ে, সে সময় বেশ চর্চা করা হয়েছিল ১২৪ক ধারার, যে এদেশে রাষ্ট্রদ্রোহর মতন কোন আইনের প্রয়োজন নেই, যেহেতু এটা ব্রিটিশদের আইন, এটা বাদ দেওয়া যায়, কিন্তু ইন্ডিয়ান সরকার এই ধারাটি দন্ডবিধি থেকে বাদ দেয় নি, ফলস্বরূপ ধারা ১২৪ক ইন্ডিয়ার ২টা হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ হয়েছিল, যখন ইন্ডিয়া সবেমাত্র স্বাধীন হয়েছে, ১৯৫১ সালে পাঞ্জাব হাইকোর্ট এই ধারাকে অসাংবিধানিক বলে রায় দেয়।
তারকিছু দিনপর এলাহাবাদ হাইকোর্ট এই ধারাকে অসাংবিধানিক বলে বাদ দিয়ে দেয়।
কিন্তু তার কিছুদিন পর ইন্ডিয়ান সরকার এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে যায় এবং এই ধারা বহাল রাখার নির্দেশ দেন। ইন্ডিয়ান সুপ্রিমকোর্ট এই রায়ে বলে- প্রতিটি নাগরিকের সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকার রয়েছে ঠিক ততক্ষণ অবধি যতক্ষণ না সে সরকারের বিরুদ্ধে হিংসা, বিদ্বেষ বা সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করতে না চায়, আর যদি তার কর্মকান্ড এসবের মধ্যে আসে তবে সেটা রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে ধরে নেওয়া হবে, তাছাড়া সরকার/ সরকারের কাজকর্ম নিয়ে সমালোচনা করা যাবে।

কিন্তু এই রায়ের আগে রাষ্ট্রদ্রোহর মামলা যে কারও উপর হয়ে যেতো, পত্রিকায় কিছু লিখলে, সোসাল মিডিয়ায় কিছু সমালোচনা করলেই সেটা রাষ্ট্রদ্রোহর অন্তর্ভূক্ত করা হতো কিন্তু এই রায়ের পর এখন সেটা সম্ভব না।

সুতরাং সংবিধানের অনুচ্ছেদে কারণে যে চ্যালেঞ্জ হয়েছে সেটা সঠিক এবং এই ধারাটা সম্পূর্ণ সাংবিধানিক।

আমরা ১৯৭২ সালেই সংবিধানের ৩৯(২) অনুচ্ছেদ ভারতের ওই সংশোধিত ১৯(২) অনুচ্ছেদটিকে অবিকল গ্রহণ করেছিলাম।

এই ধারা বাদ দেওয়া হয় নি কিন্তু এটার ব্যবহারের কিছুটা লিমিট করে দেওয়া হয়েছে।

ইন্ডিয়ান সুপ্রিমকোর্টের রায় অনুযায়ী; “Casual raising of slogans, once or twice by two individuals alone cannot be said to be aimed at exciting or attempt to excite hatred or disaffection by the Government”

উক্ত মামলার পর ধারা ১২৪ক তে কিছু বাঁধা নিষেধ দেওয়া হয়, যেগুলো ব্যাখ্যা হিসেবে সংযোজন করা হয়েছে।

ব্যাখ্যা ১: “বিদ্বেষ” বলতে অআনুগত্য ও সর্বপ্রকারের শত্রুতার ভাব বুঝাবে।

ব্যাখ্যা ২: ঘৃণা, বিদ্বেষ বা বৈরিতা সৃষ্টি বা সৃষ্টির উদ্যোগ না করে আইনসম্মত উপায়ে সরকারি ব্যবস্থাদির পরিবর্তন আনয়নকল্পে সরকারি ব্যবস্থা অসমর্থনমূলক অভিমত বা মন্তব্য প্রকাশ এ ধারার অধীনে কোন অপরাধ বলে গণ্য হবে না।

ব্যাখ্যা ৩: ঘৃণা, বিদ্বেষ বা বৈরিতা সৃষ্টি বা সৃষ্টির উদ্যোগ না করে সরকারের প্রশাসনিক বা অন্যবিধ ব্যবস্থা অসমর্থন মূলক অভিমত বা মন্তব্য প্রকাশ এ ধারার অধীনে কোন অপরাধ বলে বিবেচিত হবে না।

মহাত্মা গান্ধী ১৯২২ সালে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায় স্বীকার করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘এই আদালতের কাছে আমার এটা লুকানোর কিছু নেই যে বিদ্যমান সরকার ব্যবস্থার প্রতি আমার বিরাগ প্রকাশ করাটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।’

রাষ্ট্রদ্রোহর প্রথম মামলা হয়েছিল ইন্ডিয়ান মুক্তিযোদ্ধার উপর।

ইন্ডিয়ায় তখন করোনার মতন একরকম ব্যাকটেরিয়া বিস্তার করেছিল। ব্রিটিশ সরকার সেসময় যেভাবে ওই মহামারির সাথে পাল্লা দিচ্ছিল সেটার উপর প্রশ্ন তুলে ইন্ডিয়ান মুক্তিযোদ্ধা তিলাক। সেই প্রশ্ন থেকেই তার নিজস্ব পত্রিকা “কেসরি” তে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আর্টিকেল প্রকাশ করে। এতে করে ব্রিটিশ সরকার তার উপর রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলা করে।

তিলাক কি দেশদ্রোহী ছিলেন নাকি রাষ্ট্রদ্রোহী, ব্রিটিশ সরকারের কাছে রাষ্ট্রদ্রোহীই ছিলেন।
যেমনটা কথায় আছে -ইতিহাস নিজেই নিজের পুনরাবৃত্তি করে।

ঠিক ২০২০ এই সময় দেশে আবার মহামারী দেখা দিয়েছে। চিকিৎসকদের আদেশ দেওয়া হচ্ছে পিপিই এর ব্যাপারে বেশি প্রশ্ন না করতে, নিউজ রিপোর্টারদের কোনো তথ্য না দিতে। এই মহামারীর সময় একদিকে চিকিৎসকরা অভিযোগ করেছেন যে তারা যথেষ্ঠ পরিমানে পিপিই (পারসোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্ট বা ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম) পাচ্ছেন না, এতে স্বাস্থ্যঝুকিতে পড়েছেন চিকিৎসকরা।
সরকার চাচ্ছে করোনা মহামারীতে বেশি গুরুতর/ নেগেটিভ তথ্য যেনো জনগণের কাছে না পৌঁছায়, মৃতদের সঠিক সংখ্যা যেনো বাইরে না জানা যায়, সরকার যা বলবে তাই যেনো প্রিন্ট করে দেওয়া হয়। এর অর্থ সরকার যতটুকু জানাবে, আমরা শুধু ততটুকুই জানতে পারবো।
রাষ্ট্রের জনগণের মুখ, হাত, পা, শিকলে বাঁধার সহজ উপায় হলো জনগণকে রাষ্ট্রদ্রোহীতা বানিয়ে দেওয়া, এই দেশে খুনের জন্য যতটা না তাড়াতাড়ি FIR হয়, তার চেয়েও বেশি তাড়াতাড়ি হয় রাষ্ট্রদ্রোহর মামলা।

সম্প্রতি বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ও সাংবাদিক ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করা হয়েছিল একের পর এক। তাঁর বিরুদ্ধে ৬৭টি মামলা হয়েছে, এর মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে ১৯ টিই রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা। বাকিগুলো মানহানির মামলা।

কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের মিথ্যা অভিযোগ করে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করায় প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনের রাষ্ট্রদ্রোহ করা মামলার আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন আদালত।

ইন্ডিয়ার একটি জরিপ অনুযায়ী, ২০১৫ এবং ২০১৮ এর মধ্যে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দ্বিগুণ হারে বেড়েছে।
২০১৭ সালে ৩৫টা মামলা ফাইল করা হয়েছে, ২০১৮ সালে তা দ্বিগুণ হয়ে ৭০ হয়েছে, কিন্তু গত পাঁচ বছরে শুধু ৪৩টা মামলার ট্রায়াল শেষ হয়েছে, যারমধ্যে শুধুমাত্র ৪টা মামলায় রাষ্ট্রদ্রোহ প্রমাণ হয়েছে। আইনজীবীদের ভাষ্যমতে এটা দন্ডাদেশ দেওয়াতে কোন সমস্যা নেই, সমস্যা হচ্ছে যখনই কারও উপর রাষ্ট্রদ্রোহর মামলা হয়, তখনই তাকে দেশদ্রোহী হিসেবে মিডিয়া, অনলাইন, সংবাদপত্র, সমাজে পরিচিতি দেওয়া হয়, কিন্তু যেখানে দেশদ্রোহীতা নিয়ে কোনো আইনই নেই দন্ডবিধিতে, আছে রাষ্ট্রদ্রোহ।

যদি ডেমোক্রেসি/Freedom এর পয়েন্ট থেকে দেখতে যাই তবে, রাষ্ট্রদ্রোহ এই আইনটার উপর প্রভাব ফেলে, যে কোনো ডেমোক্রেসির ভিতরে ব্যক্তির নিজস্ব সতন্ত্রতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু রাষ্ট্রদ্রোহের মতন আইন আমাদের বাক-স্বাধীনতায় বাঁধা নিষেধ দিয়ে দেয়। এবং প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো বাঁধাগুলো সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে আলোচনা করা আছে। অতএব বাংলাদেশের মতন স্বাধীন দেশে রাষ্ট্রদ্রোহর মতন আইন থাকাটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত, এই বিষয়ে আলোকপাত করতে গেলেই বলতে হবে; যারা অধিকার কর্মী (Rights Activist) তারা প্রথম থেকেই বলে আসছে, এই আইনটা ভুল এবং শুরু থেকেই এটার অপব্যবহার হয়ে আসছে। রাষ্ট্রদ্রোহকে বলা হয় -বিতর্ককারীদের হয়রান করার সরঞ্জাম। কারণ কোর্ট যখন রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা নেয়, সেটা বেশ সাংঘাতিক ভেবেই নেয়, আবার এটাতে যেহেতু জামিন পাওয়া যায় না এবং বাংলাদেশ জুডিশিয়ারির রাষ্ট্রদ্রোহের ট্রায়াল লম্বা হয়। অতএব এখানে ট্রায়ালই একপ্রকার শাস্তি স্বরূপ।
কিন্তু এই ধারার যেমনটা অপব্যবহার হয়ে থাকে পাশাপাশি এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন। সত্যিকার অর্থেই রাষ্ট্রের জনগণ যদি সরকারের বিরুদ্ধে আলোচনা বা সমালোচনা করে এবং সেটার দরুণ সমাজে হিংসা, বিদ্বেষ, মারামারি, বিশৃঙ্খলা পরিবেশ সৃষ্টি হয় ঠিক তখন ১২৪ক ধারার প্রয়োজন অনুভব হবে।

লেখক: কামরুন নাহার হেনা। শিক্ষার্থী নর্দান ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ।