প্রলোভন নাকি প্রতারণা কি বলে আইন?

কামরুজ্জামান পলাশ : বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, “মানুষ তার ভুল থেকে শিক্ষা নেয়”। কিন্তু এটি তখনই ঘটে, যখন পূর্বের ভুলের কথা মাথায় রেখে সামনে ভুল করা থেকে বিরত থাকা হয়। আর এই ভুল যদি ঘটে আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে তখন অবস্থা হয় মারাত্মক। এইবার আসা যাক মূল কথায়।

আমরা প্রায়শ লক্ষ করি যে বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া ও ডিজিটাল মাস মিডিয়াতে সারাদেশ ব্যাপি ঘটে যাওয়া ক্রাইম বা আপরাধ নিয়ে খবর প্রচারিত হয়। যাতে কিছু অপরাধের ধরন উল্লেখ করা থাকে। ঠিক তেমনি একটি অপরাধের ধরন হলো “বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে একজন নারীর সাথে যৌন বা শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন” যা ধর্ষন হিসেবে গন্য করা হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে,সংবাদে ধর্ষনের অভিযোগে ব্যবহৃত শব্দ “প্রলোভন” এই বিষয়টি কতটুকু জাস্টিফাইড?
আমরা পেনাল কোড ১৮৬০ এর ধারা-৩৭৫ লক্ষ্য করলে দেখতে পাই যে, ধারাটি ধর্ষনের সংজ্ঞা প্রদান করে। যাতে একটি পর্যায়ে বলা হয়েছে যে, যৌন সম্পর্ক স্থাপনের সময় পুরুষটি বিশ্বাস করে যে সে ঐ মহিলাটির স্বামী নয়, কিন্তু মহিলাটিকে বিশ্বাস করানো হয় যে পুরুষটি তার আইন মোতাবেক স্বামী হয়। এইখানে পুরুষটি মহিলাটির সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে।
আবার, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এ ধারা-৯ এর উপধারা-১ এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে, যখন কোন ব্যক্তি ১৬ (ষোল) বছরের অধিক বয়সের কোন নারীর সাথে বিবাহ সম্পর্ক বহির্ভূত নারীটির সম্মতি ছাড়া ভয়, ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারনার আশ্রয় নিয়ে তাহার সম্মতি আদায় করে বা ১৬ (ষোল) বছরের কম বয়সের কোন নারীর সাথে তাহার সম্মতি নিয়ে বা সম্মতি ছাড়া যৌন সম্পর্ক স্থাপন করলে তা ধর্ষন হিসেবে গন্য করা হবে।
পেনাল কোড-১৮৬০ এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ এর যেখানে ধর্ষন এর সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে সেখানে একটি বারের জন্য ও “প্রলোভন” কথাটি উচ্চারন করা হয়নি।
এইবার দেখা যাক “প্রতারনা” ও “প্রলোভন” এক অর্থ বহন করে কিনা। “প্রতারনা” কথাটির ইংরেজি হলো, ডিসিপশন (Deceiption) বাচিটিং(Cheating) যার ইংরেজি আবিধানিক অর্থ দাঁড়ায় “কোন সুবিধা অর্জনের জন্য অসাধুতা বা অন্যায় ভাবে আচরন করা” অর্থাৎ যা সত্য নয় কিন্তু তা সত্য হিসেবে বিশ্বাস করানো যদিও সে বিশ্বাস করে যে তা সত্য নয়। তাছাড়া চিটিং (Cheating) সম্পর্কে পেনাল কোড-১৮৬০ এর ধারা-৪১৫ থেকে ধারা-৪২০ পর্যন্ত বলা হয়েছে। যার মাধ্যমে এটি প্রতিয়মান হয় যে আইনের চোখে চিটিং বা প্রতারনা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কেননা প্রতারনা করার যে উপাধান রয়েছে তা রয়েছে শুধুমাত্র অন্যকোন পক্ষেরহাতে।
এইবার আসা যাক “প্রলোভন” এর সংজ্ঞা নিয়ে। ইংরেজিতে এর অর্থ দাঁড়ায় “The Temptation” যার ক্যাম্ব্রিজ ডিকশনারি মতে অর্থ দাঁড়ায় “কিছু পাওয়ার বা কিছু করার আশা বা আকাঙ্ক্ষা”। প্রলুব্ধ হওয়ার উপাদান অন্যকোন পক্ষের হাতে থাকেনা বরং ব্যাক্তি নিজের মনবাসনা দ্বারা প্রলুব্ধ হয়। যার আইনের চোখে কোন শাস্তিযোগ্য আপরাধ হিসেবে গন্য করা হয় না। তাছাড়া “প্রলোভন” শব্দটি ধর্ষন এর জন্য দেয়া পেনাল কোড-১৮৬০ কিংবা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ এর সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে না। তবুও আমরা আদালত প্রাঙ্গনে অভিযোগ দাখিলের সময় বা যুক্তি তর্ক উপস্থাপন এমন কি সংবাদ প্রকাশের সময়“প্রলোভন” শব্দটি ব্যবহার করি আবার তা ধর্ষন হিসেবে দাবী করি।
In Peter Westen, ‘Some Common Confusion about Consent in Rape Cases’ (2004-2005) it has been narrated that, One of the statutory conceptions of consent is ‘factual consent’ implying a situation where the consenter consents to sexual intercourse (whether in mind or expression) because she unconditionally desires or prefers it for herself, however, that thechoiceof cohabitation itself constitutes a defense to rape’.
অর্থ্যাৎ, এখানে বিবেচ্য বিষয় হলো সম্মতি। যদি কোন নারী যৌন সম্পর্ক স্থাপন করার জন্য সম্মতিপোষন করে পরবর্তীতে ঐ সম্মতি ধর্ষনের অভিযোগের ডিফেন্স হিসেবে কাজ করে।
এইবার দেখে নেয়া যাক, কিছু কেস ডিসিশনঃ
আবেদ আলী বনাম স্টেট; ৩৪ ডিএলআর ৩৬৬ তে বলা হয়েছে ধর্ষনের অভিযোগ আনতে হলে কোন মহিলা প্রমান করতে হবে যে, যৌন সম্পর্ক স্থাপনের সময় পুরুষটি বিশ্বাস করে যে সে ঐ মহিলাটির স্বামী নয়, কিন্তু মহিলাটিকে বিশ্বাস করানো হয় যে পুরুষটি তার আইন মোতাবেক স্বামী হয়। এইখানে পুরুষটি মহিলাটির সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে প্রতারনার আশ্রয় নিয়েছে।আরো প্রমান করতে হবে যে এইক্ষেত্রে যে ধরনের বিয়ে সংঘটিত হয়েছে তা বৈধ বা আইনসম্মত ভাবে হয়নি।
কামাল হোসেন বনাম স্টেট ৬১ ডিএলআর ৫০৫ তে বলা হয়েছে যে নারীটি ধর্ষনের অভিযোগ দায়ের করেছিল, সে নিজের ইচ্ছায় আসামীর সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে সম্মতি প্রদান করে । তাই উক্ত অভিযোগটি ধর্ষনের আওতায় পড়েনা, যেহেতু এইখানে সম্মতি ছিল।
সোহেল রানা বনাম স্টেট ৫৭ ডি এল আর তে ট্রাইব্যুনাল আসামীকে বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষনের অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও ৫০,০০০(পঁঞ্চাশ) হাজার অর্থদন্ড দেয়া হয় যার মধ্যে ৪০,০০০ (চল্লিশ) হাজার মামলার ভিকটিমকে প্রদান করতে বলা হয়। পরবর্তীতে আপীলে হাইকোর্ট বিভাগ আসামীকে খালাস প্রদান করেন, যেহেতু মহিলাটি অর্থাৎ ভিকটিম এই যৌনসম্পর্কে সম্মতি দিয়েছিল। যদিও বিজ্ঞ আদালত মনে করেন যে উক্ত ঘটনায় একটি প্রতিশ্রুতির ভঙ্গ ঘটে, যা ধর্ষন হিসেবে অনুমান করা যায় না।
পরিশেষে বলা যায় যে, ধর্ষনের অভিযোগ দায়ের কিংবা প্রমাণিত করতে হলে আমাদের প্রচলিত আইনের সংজ্ঞা মোতাবেক আইনকে ব্যাখ্যা করতে হবে অর্থাৎ বিয়ন্ড রিসনবল ডাউট তা প্রতারণা হিসেবে প্রমাণ করতে হবে। তাছাড়া, আদালত প্রাঙ্গনে অভিযোগ দায়ের, যুক্তিতর্ক উপস্থাপন কিংবা সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত যাতে আইনের ব্যাখ্যার যথাযথ ব্যাবহার নিশ্চিত হয়। তাহলেই ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে।

লেখকঃ ছাত্র, আইন বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি।