আমার দীক্ষাগুরু; ব্যারিস্টার তানভীর পারভেজ

হাসান তারিক পলাশ :
ব্যারিস্টার তানভীর পারভেজ ছিলেন আইন অঙ্গনের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র। মেধা, মনন, চিন্তাশীলতা, সততা, বাগ্মিতা এবং অকল্পনীয় পড়াশোনা তাকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল। তিনি ছিলেন উচ্চ জীবনাদর্শের একজন পরিপূর্ণ আইনজীবী।

ব্যক্তি তানভীর পারভেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ২০ তম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। আমিও একই বিভাগের অনুজ হওয়ায় তিনি সবসময়ই আমাকে ভালোবাসতেন, স্নেহ করতেন। তার বাবা একজন সিভিল আইনজীবী ছিলেন; আমার বাবাও একজন সিভিল আইনজীবী ছিলেন। সেই সুবাদে আমরা দুইজনেই দ্বিতীয় প্রজন্মের আইনজীবী ছিলাম এবং একই পরিবারভুক্ত মনে করতাম।

বিগত ছয় বছর আমি সার্বক্ষণিকভাবে তার সাথেই ছিলাম। এমনকি বিগত ২৪ মার্চ হাইকোর্ট বিভাগের মেইন বিল্ডিং এর ২৭ নং আদালতে তিনি যখন সর্বশেষ শুনানি করছিলেন, তখনও আমিই জুনিয়র হিসাবে তার পাশে ছিলাম। ২৭ নং আদালতের সর্বশেষ আইটেমটি শুনানি করে আদেশ নিয়ে তিনি, হাবিব ভাই এবং আমি উৎফুল্লতা নিয়ে হেটে বেরিয়ে এসেছিলাম। ব্যাংকের সামনে এসে আমি তাকে রিক্সায় উঠিয়ে দিয়ে কোর্ট চত্বরে থেকে গিয়েছিলাম।

অধিকাংশ দিনেই আদালতের কাজ শেষ করে আমরা একই সাথে বিজয় নগর চেম্বারে যেতাম। যেতে যেতে আমাদের নানা বিষয় নিয়ে কথা হত। আমি প্রশ্ন করতাম এবং তিনি উত্তর দিতেন। সাধারণত আইন এবং আদালতের বাইরে ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন দিক, বিশেষ করে সুফিবাদ, হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর ব্যক্তিত্বের নানা উল্লেখযোগ্য দিক, কোরআনের আয়াত নিয়ে কথা বলতে তিনি পছন্দ করতেন। তিনি অনেকগুলো বড় সূরা মুখস্থ করে ফেলেছিলেন। তিনি আশা করতেন, বড় বড় সূরাগুলো মুখস্থ করার পরে ছোটো সুরা গুলো মুখস্থ করে ফেলবেন।

ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন দিকের বাইরে তিনি জগত বিখ্যাত আইনজীবীদের জীবনীগ্রন্থ পড়তে ভালোবাসতেন। ভারতের অধিকাংশ শ্রেষ্ঠ আইনজীবী; যাদের জীবন নিয়ে কিছু লেখা হয়েছে, সেগুলো তিনি সংগ্রহ করতেন এবং পড়তেন। যেগুলো তিনি পড়তেন, সেগুলো নিয়ে আমাদের সাথে আলোচনা করতে তিনি পছন্দ করতেন।

ব্যাক্তি তানভীর পারভেজকে যারা চিনতেন, তাদের অধিকাংশই তার একটা বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতেন না। তিনি ছিলেন বড় মাপের একজন দানশীল মানুষ। অনেক অভাবগ্রস্থ মানুষকে তিনি নিয়মিত দান করতেন এবং সেই দানের পরিমাণ ছিল বেশ বড়। তিনি দান করতেন গোপনে এবং বলতেন, তার বাবাও গোপনে অনেক দান করতেন। দান করার সময় যিনি সাথে থাকতেন, শুধু তিনিই জানতেন এবং দেখতে পেতেন। রাস্তায় হাটার সময় এমন কোন ভিক্ষুক দেখিনি, যাকে তিনি দান করেন নি। এমনও হয়েছে, দান করার জন্য পকেটে হাত দিয়ে দেখেন আর অবশিষ্ট নেই, তিনি আমার কাছ থেকে নিয়ে দান করতেন এবং চেম্বারে ফিরেই সাথে সাথেই সেটা ফেরত দিতেন।

ব্যারিস্টার তানভীর পারভেজকে খুব কাছ থেকে যারা দেখেননি, তারা কিছুতেই জানবেন না যে একজন মানুষের স্মৃতি এবং স্মরণশক্তি কতটা তীক্ষ্ণ হতে পারে। বিগত ছয় বছরে আইনগত কোন সমস্যা এলেই তাকে প্রশ্ন করতাম এবং তিনি সাথে সাথে সমাধান দিয়ে পৃষ্ঠাসহ রেফারেন্স দিয়ে দিতেন। এটা শুধু আমি নই, যে কেউ প্রশ্ন করতে পারতেন এবং কোন ধরনের বিরক্ত না হয়েই তিনি সবাইকে সহযোগিতা করতেন।

তার স্মরণ শক্তির ব্যপ্তি নিয়ে একটা উদাহরণ দেই; আমার বাবার চেম্বারের মামলা করতে আমি মাঝে মধ্যে বরগুনা যেতাম। সেখানেও শুনানির ক্ষেত্রে কোন রেফারেন্স প্রয়োজন হলে তাকে ফোন দিয়ে রেফারেন্সটি জেনে নিতাম। ২০১৫ সালে এমন একটা সিভিল মামলার শুনানির সময় তার কাছে থেকে একটা রেফারেন্স নিয়েছিলাম। সেই মামলায় আমি জিতলে অপরপক্ষ হাইকোর্টে সিভিল রিভিশন করেন। গত দুইমাস পুর্বে সেই মামলাটি শুনানির তালিকায় এলে আমি ফাইল নিয়ে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছি কিন্তু এই মামলাটি নিয়ে এর আগে তার কাছ থেকে রেফারেন্স নিয়েছিলাম, সেটা আমি ভুলে গিয়েছিলাম। সেই ফ্যাক্টটা বলে রেফারেন্স চাওয়ার সাথে সাথে তিনি বললেন, এই একই কেসের প্রাসঙ্গিক আইন কয়েকবছর আগে তোমাকে দিয়েছি। আমি অবাক হয়ে ফাইল খুজে ঠিকই রেফারেন্সটি খুজে পেলাম। এই রকম তুখোড় স্মৃতি ছিল তার। আমরা তাকে “জীবন্ত এনসাক্লোপিডিয়া” বলতাম।

ব্যক্তি জীবনে তিনি কতটা নিরহংকারী এবং বিনয়ী ছিলেন, সেটা সবাই কমবেশি জানেন। কিন্তু তিনি কতখানি ক্ষমাশীল মানুষ ছিলেন, সেটা অনেকেই জানেন না। তার সাথে কেউ অন্যায় করলে তিনি ভুলে যেতে চাইতেন এবং ক্ষমা করে দিতেন। তার কোন অগ্রজ বা অনুজ তার সাথে দৃশ্যমান অন্যায় করে পরবর্তীতে তার সাহায্য চাইলেও তিনি উদার ভাবে তাকে সহযোগিতা করতেন। এই বিষয়ে তিনি বলতেন, সে আমার প্রতি অন্যায় যদি করেও থাকে সেটার ন্যায়বিচার আল্লাহ করবেন; আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম এবং উপকার করলাম। তিনি প্রকাশ্যে না হলেও গোপনে লজ্জিত হবেন।

বই কেনা, বই পড়া এবং বই গিফট করা ছিল তার একমাত্র নেশা। অবসরে নিউমার্কেটের বইয়ের দোকানগুলো ঘুরে দেখা ছিল তার শখ। তার সাথে বইয়ের দোকানগুলো ঘুরলে বোঝা যেত তিনি কতখানি পড়ুয়া মানুষ। কোন বইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে কৌতুহল হলেই তিনি বইটি নাড়াচাড়া করে দেখে প্রাথমিক একটা আইডিয়া নিতেন। পছন্দ হলেই কিনে ফেলতেন। তার বাসায় এবং চেম্বারে বই রাখার জায়গায় সংকুলান হত না। তিনি শুধু নিজের জন্য কিনতেন না, বই গিফট করতে তিনি ভালোবাসতেন। বিশেষ করে বই কেনার সময় যিনি তার সাথে থাকতেন, তিনি যেটা পছন্দ করতেন; সেটাই কিনে দিতেন। বই কেনার সময়ে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তার জ্ঞানগর্ভ আলোচনা এবং বই পাবার বাসনায় তার সাথে বইয়ের বাজার ঘুরে দেখা আমারো শখের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। বিগত ২/৩ বছরে তিনি প্রচুর মানুষকে কোরআন শরীফ গিফট করেছেন। বাংলাদেশে প্রচলিত প্রায় সকল তাফসীরে কোরআন তিনি কিনেছিলেন।

ব্যক্তি তানভীর পারভেজকে খুব ছোট পরিসরে লেখার সুযোগ নেই। প্রচার বিমুখ এই মানুষটি সম্পর্কে তারাই ভালো জানেন, যারা সার্বক্ষণিকভাবে তার পাশে ছিলেন। বিগত ছয় বছরে সকাল সাড়ে দশটা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত তার একান্ত সান্নিধ্যে থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। আমি তাকে কথা দিয়েছিলাম, আমি সারাজীবন তার সাথেই যুক্ত থাকব। তিনি বলেছিলেন, সিনিয়রের সাথে যুক্তও থাকতে হবে এবং পাশাপাশি আত্মনির্ভরশীলও হতে হবে। যে আইনজীবী আত্মনির্ভরশীল নন, তিনি আইনজীবীই নন। আত্মনির্ভরশীল করতে তিনি তার মামলাগুলো শুনানি করতে একা একাই পাঠিয়ে দিতেন।

মাত্র ৪৭ বছর বয়সে বিদায় নিলেও তার উন্নত চিন্তা, মানবিক মূল্যবোধ এবং তীক্ষ্ণ মেধার কারণে আইন অঙ্গনে একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসাবে আবির্ভাব হয়েছিল। অকালে তাকে হারালেও তার জীবন এবং কর্ম যেকোনো প্রজন্মের আইনজীবীর জন্য চলার পথের পাথেয় হতে পারে। তার জীবন এবং কর্ম নিয়ে একটা স্মৃতিচারন মুলক বই লেখার ইচ্ছা আমার কাছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আইনজীবীদের জন্য তার অনেক কিছু করার ইচ্ছা ছিল।

আইন পেশায় একজন ভালো সিনিয়র পাওয়াকে একজন জুনিয়র আইনজীবীর জন্য সৌভাগ্য বলা হয়। কিন্তু সেই মানুষটি যদি উচ্চ মানবিক আদর্শের হয়ে থাকেন, তবে তার চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কিছুতেই হতে পারে না। আল্লাহর অসীম রহমতে আমি এমন একজন সিনিয়রের জুনিয়র, যিনি প্রচন্ড মেধাবী আইনজীবী এবং অসাধারণ একজন ভালো মানুষ ছিলেন। এমন কম্বিনেশন আর আসবে কিনা আমার জানা নেই।

লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।