দ্বিতীয় বিবাহ, স্ত্রীর অনুমতি এবং বিবাহের প্রমাণ হিসেবে কাবিননামা

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল- গালিব খান :
আমাদের সমাজে একটা কথা আছে পুরুষ মানুষ ইচ্ছা করলেই চারটা পর্যন্ত বিয়ে করতে পারে। অনেকেই আবার একাধিক বিয়ে করার এই ক্ষমতাকে একচেটিয়া বলে থাকেন। পুরুষের একাধিক বিয়ের ব্যাপারে যে উৎস অর্থাৎ পবিত্র কোরআনের সূরা নিসায় বলা হয়েছে, “যদি তোমরা আশঙ্কা কর যে, (নারী) ইয়াতীমদের প্রতি সুবিচার করতে পারবে না, তবে নারীদের মধ্য হতে নিজেদের পছন্দমত দুই-দুই, তিন-তিন ও চার-চার জনকে বিবাহ কর। কিন্তু যদি তোমরা আশঙ্কা কর যে, তোমরা সুবিচার করতে পারবে না, তাহলে একজনকে কিংবা তোমাদের অধীনস্থ দাসীকে; এটাই হবে অবিচার না করার কাছাকাছি।” (আয়াত নাম্বার ০৩)

যদি কোন পুরুষ একাধিক স্ত্রীর সাথে ন্যায্য ব্যবহার (Just Behaviour) করতে পারে ঠিক তখনই একাধিক বিয়ের অনুমতি রয়েছে। খুব শক্ত শর্তে একাধিক বিয়ের অনুমতি ইসলাম প্রদান করেছে। বোঝা যাচ্ছে পবিত্র কোরআনে সরাসরি বহুবিবাহকে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে, কেবল তখনই বহুবিবাহের অনুমতি রয়েছে যখন শরীয়ার শর্ত গুলো পালন করা হবে অন্যথায় নয়। যদি কোন পুরুষের মনে সকল স্ত্রীর প্রতি ন্যায্য আচরনের বিষয়ে সামান্যতম সন্দেহ থাকে তবে একাধিক বিয়ে ইসলাম সমর্থন করে না।

মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১ এর ধারা ৬ অনুসারে কোন পুরুষ যদি বহুবিবাহ করতে চায় তাহলে “সালিশী পরিষদ” ‘র অনুমতি নিয়ে করতে হবে। এ রকম পূর্ব অনুমতি না নিয়ে বিয়ে করলে সেই বিয়ে নিবন্ধিত হবে না। তবে পরের বিয়ে অর্থাৎ কোন পুরুষ পূর্বের বিয়ে বলবৎ থাকাকালে দ্বিতীয় বিয়ে করলে সে বিয়ে অবৈধ হবে না, এটি হবে একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

আরও একটি মজার বিষয় হল, আমাদের ধারনা দ্বিতীয় বিয়ে করতে প্রথম স্ত্রীর অনুমতির প্রয়োজন হয়। আমরা যদি আইনটির দিকে দেখি তাহলে এটা স্পষ্ট যে, পূর্বের স্ত্রীর অনুমতি দেবার কোন সুযোগ এখানে নেই, বরং দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতি প্রদান করবেন সালিশী পরিষদ।

আইনটির ৬(২) তে বলা হয়েছে, দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতির জন্য নিদিষ্ট ফি সহ নির্ধারিত পদ্ধতিতে চেয়ারম্যানের নিকট আবেদন করতে হবে। এই আবেদনপত্রে বিবাহের কারণ এবং বর্তমান স্ত্রী বা স্ত্রীদের সম্মতি নেয়া হয়েছে কিনা তা উল্লেখ করতে হবে।

সালিশী পরিষদ বিবাহের অনুমতি প্রদানের ক্ষেত্রে বর্তমান স্ত্রীর সম্মতি আছে কিনা সেটাকে একটা ফ্যাক্টর হিসেবে বিবেচনা করবেন। কিন্তু বর্তমান স্ত্রীর অনুমতি প্রদান বাধ্যতামূলক নয়।
যদি সালিশী পরিষদ মনে করেন যে, প্রস্তাবিত আবেদনটি প্রয়োজনীয় এবং ন্যায়সঙ্গত কেবল তখনই বহুবিবাহের অনুমতি প্রদান করতে পারেন।

মুসলিম পারিবারিক আইন বিধিমালা ১৯৬১ এর বিধি ১৪ তে বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করা হয়েছে বহুবিবাহের সমর্থনে। যেমনঃ বন্ধ্যাত্ব, শারীরিকভাবে অসুস্থতা, দাম্পত্য সম্পর্কের জন্য শারীরিকভাবে অসমর্থ, স্ত্রী উন্মাদ ইত্যাদি। এটা একটা গাইডলাইন বলা যায় যদিও তা পর্যাপ্ত নয়।

সালিশী পরিষদের অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিবাহটি অবৈধ হবে না বরং তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং কেউ এমন করলে বর্তমান স্ত্রীর দেনমোহর প্রদান করতে হবে সাথে সাথে দোষী সাব্যস্ত হলে ১ বছরের জেল বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয়দন্ডে দন্ডিত হবে।

প্রসঙ্গত বলতে চাই যাকে দ্বিতীয় বিয়ে করা হচ্ছে তার কাছে যদি বর্তমান স্ত্রী থাকার বিয়ষটি গোপন করা হয় তখন তা দন্ডবিধি ১৮৬০ এর ধারা ৪৯৪-৪৯৫ অনুসারে শাস্তিযোগ্য নয়। সে সাথে স্ত্রী কর্তৃকও বর্তমান স্বামী থাকার বিষয়টি গোপন রাখা শাস্তিযোগ্য।

এখন আমরা খুব ছোট করে বিয়ের প্রমাণ হিসেবে কাবিননামার বিষয়ে আলোচনা করবো। আমরা জানি মুসলিম বিয়ে এক প্রকার সিভিল কনট্রাক্ট। পবিত্র কোরআনে সূরা বাকারাহ তে বলা হয়েছে, যখন তোমরা কোন চুক্তি কর তখন তা বাধ্যবাধকতা স্থির কর, সময় নির্ধারণ কর, লিখে রাখো এবং সাক্ষী রাখো। (আয়াতঃ ২৮২)

বিয়ের ক্ষেত্রে তাই সাক্ষী খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং এটা বড় একটা প্রমাণ। যদি কারো বিয়ে নিবন্ধন করা নাও হয়ে থাকে তবু সাক্ষী যথেষ্ট প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং বিয়েতে সাক্ষীটাই বিয়ের একটি প্রয়োজনীয় উপাদান।

মুসলিম বিবাহ এবং তালাক (নিবন্ধন) আইন ১৯৭৪ এর ধারা ৩ অনুসারে, মুসলিম আইন অনুযায়ী অনুষ্ঠিত (soleminzed) প্রতিটি বিয়ে এই আইন অনুসারে নিবন্ধিত হতে হবে। অর্থাৎ বিয়ে অনুষ্ঠিত হবার পরই নিবন্ধনের বিষয়টি আসে। বিয়ে নিবন্ধন বিয়ের কোন উপাদান নয়, কেউ যদি বিয়ে নিবন্ধন নাও করে তবু বিয়ে অবৈধ হবে তা, তবে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
Abdur Rakib (Md) Shahin vs. Shertaj Khatun & another 2008, 37 CLC (AD) 2749 মামলায় মহামান্য সু্প্রিমকোর্টের আপীল বিভাগ বলেন, অ-নিবন্ধিত বিয়ে বৈধ হবে।

সুতরাং কাবিননামা বা অ-নিবন্ধিত বিয়ের বৈধতা নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই তবে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বলে রাখা ভালো বিয়ে নিবন্ধনের দায়িত্ব বরের।

লেখক: শিক্ষানবিশ আইনজীবী, ঢাকা জজ কোর্ট।