আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যুর বিরুদ্ধে প্রতিকার ও পুলিশের অভিব্যক্তি

 

শ্রীকান্ত দেবনাথ :
পুলিশসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সার্বক্ষণিক জনগণের নিরাপত্তায় কাজ করে গেলেও কিছু অপেশাদার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নির্যাতন বা হেফাজতে মৃত্যুর অভিযোগ নতুন কোন বিষয় নয়। যে কোন পুলিশ, র‌্যাব বা অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তা কর্তৃক আটক হওয়া, আটক হওয়ার পর তথ্য বা স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য নির্যাতনের শিকার হওয়া, অর্থ আদায়ের চেষ্টা করা অনাদায়ে নির্যাতনের মতো কিছু ঘটনা শুনতে পাওয়া যায়। কখনো কখনো নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মারা যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে থাকে।

বর্তমানে যে কোন ব্যক্তি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক যে কোন প্রকার নির্যাতনের শিকার হলে বা নির্যাতনের কারণে মৃত্যুবরণ করলে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি নিজে বা অপর কোন ব্যক্তি উক্ত ঘটনার বিচার দাবী করে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ এর অধীন মামলা করতে পারবে।

নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণের উদ্দেশ্যে এবং নির্যাতনকারীকে শাস্তির আওতায় আনার জন্য ২০১৩ সালে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ প্রনয়ন করা হয়।

১৯৮৪ সালের ১০ ডিসেম্বর নিউইয়র্কে নির্যাতন এবং নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর ব্যবহার অথবা দন্ড বিরোধী একটি সনদ স্বাক্ষরিত হয়েছে। বাংলাদেশ ১৯৯৮ সালের ৫ অক্টোবর উক্ত সনদে স্বাক্ষর করে।

যেহেতু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান এর ৩৫(৫) অনুচ্ছেদে নির্যাতন এবং নিষ্ঠুর, অমানবিক ও লাঞ্ছনাকর ব্যবহার ও দন্ড মৌলিকভাবে নিষিদ্ধ করেছে এবং জাতিসংঘ সনদের ২(১) ও ৪ অনুচেছদ অনুযায়ী আইন প্রনয়নের দাবী করে। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ এই আইনটি প্রনয়ন করে। বিবিসি বাংলা প্রতিবেদনে জানা যায়, এই আইনের অধীন গত বছর পর্যন্ত মাত্র ১৭ টি মামলা চলমান রয়েছে।

ইতোমধ্যে উক্ত আইনে করা মামলার প্রথম রায় প্রদান করা হয়। গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর এ রায় প্রদান করা হয়। ২০১৪ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারী ইসতিয়াক হোসেন জনি ও ইমতিয়াজ হোসেন রকি নামে দুই ভাইকে আটক করে পুলিশ। ঐ ‍দিন রাতেই পুলিশী নির্যাতনে ইসতিয়াক হোসেন জনির মৃত্যু হয়। উক্ত ঘটনায় মামলা আনয়নের পর দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া শেষ করে বিগত বছরের ৯ই সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে উক্ত মামলার রায় প্রদান করা হয়। ঐ মামলার রায়ে ৩ জন এসআই এর প্রত্যেককে যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং ১ লক্ষ টাকা করে অর্থদন্ড প্রদান করে। এছাড়াও তাদের প্রত্যেককে বাদীপক্ষকে ২ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়। উক্ত মামলার অপর দুই আসামী পুলিশের দুইজন সোর্সকে ৭ বছর করে কারাদন্ড দেওয়া হয়।

এখন নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যুর বিরুদ্ধে মামলা করার এবং মামলায় দোষীদের শাস্তির নজিরও রয়েছে। কিন্তু তারপরও নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যুর বিরুদ্ধে মামলা করার আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা এত বেশি থাকা সত্ত্বেও মাত্র ১৭ টি মামলা চলমান থাকার কারণ হিসেবে মনে করা হয়, এখনো অনেকে আইনটি সম্পর্কে জানে না, জানে না কিভাবে, কোথায় এই মামলা দায়ের করতে হয়।

নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩-এ বলা আছে, কে, কিভাবে, কোন আদালতে মামলা করতে পারে।

উক্ত আইনে নিযাতন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়, ‘নির্যাতন’ অর্থ কষ্ট হয় এমন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। এর অর্থ হলো মানসিক নির্যাতনের বিরুদ্ধেও প্রতিকার রয়েছে। তথ্য বা স্বীকারোক্তী আদায়ে বা শাস্তি প্রদানে বা ভয় দেখানোর জন্য নির্যাতন করা হলে মামলা করা যাবে।

‘হেফাজতে মৃত্যু’ বলতে বোঝানো হয়েছে, সরকারী কর্মকর্তার হেফাজতে মৃত্যু অথবা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক গ্রেফতার কালে মৃত্যু অথবা জিজ্ঞাসাবাদকালে মৃত্যু অন্তর্ভুক্ত হবে।

উক্ত আইনের ১৪ ধারায় বলা হয়েছে, এই আইনের অধীন কোন অপরাধের বিচার দায়রা জজ আদালতে হবে। উক্ত আইনের ধারা ২(৬) এর সংজ্ঞানুসারে কেউ নির্যাতনের বা ধারা ২(৭) এর সংজ্ঞানুসারে কেউ হেফাজতে মৃত্যুবরণ করলে মামলা করা যাবে। শুধুমাত্র যে নিযাতনের শিকার হবে সেই ব্যক্তি যে মামলা করতে হবে এমন কিন্তু না। অত্র আইনের ৬ ধারা অনুযায়ী কোন ব্যক্তি অপর কোন ব্যক্তিকে নির্যাতন করেছে জানলেও তৃতীয় ব্যক্তি আদালতে অভিযোগ করতে পারবে।

অনেকে অনেক সময় বলে থাকে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে কি নিরাপত্তা পাওয়া যাবে? এ বিষয়ে অত্র আইনের ১১ ধারা বলা হয়েছে। ১১ ধারা মতে, অভিযোগকারী অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে নিরাপত্তার জন্য দায়রা জজ আদালতে দরখাস্ত দিতে পারবে। আদালত অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ৭ দিন পযন্ত অন্তরীন আদেশ দিতে পারে। এছাড়াও কোন বিশেষ এলাকায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারিসহ নিরাপত্তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারে।

উক্ত আইনে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যুর জন্য ১৫ ধারায় শাস্তির বিধান করা হয়েছে।

কোন ব্যক্তি নির্যাতন করিলে সে ব্যক্তি অন্যূন ৫ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদন্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে এবং অতিরিক্ত ২৫ হাজার টাকা ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তিকে প্রদান করবে।

যদি নির্যাতনের ফলে মৃত্যু হয় তবে যাবজ্জীবন কারাদন্ড অথবা ১ লাখ টাকা অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে এবং অতিরিক্ত ২ লাখ টাকা ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তিকে প্রদান করবে।

এছাড়াও কোন ব্যক্তি যদি নির্যাতনে উদ্যোগী হয় বা সহায়তা বা প্ররোচিত করে বা ষড়যন্ত্র করে তবে উক্ত দোষী ব্যক্তি অন্যূন ২ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদন্ডে বা অন্যূন ২০ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে।

তবে উক্ত আইন পাশের পর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পুলিশের পক্ষ থেকে উক্ত আইন বাতিল বা সংশোধনের অনুরোধ করা হয়। উক্ত আইনে মানসিক কষ্টকেও নির্যাতন হিসেবে উল্লেখ করা হলেও উক্ত আইনে মানসিক কষ্টের কোন সংজ্ঞা প্রদান করা হয়নি। মামলা আনয়নের পর তদন্তের জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তাকে তথ্য উদঘাটনের জন্য মামলার সংশ্লিষ্ট পক্ষ বা সাক্ষীকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হয়। কিন্তু উক্ত আইনে মানসিক কষ্টকে সংজ্ঞায়িত না করায় এবং মানসিক কষ্টের অজুহাতে তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারে এমন আশঙ্কায় তদন্তকারী কর্মকর্তা অভিযুক্তকে জিজ্ঞাসাবাদে আগ্রহ হারাবে। ফলে মামলার প্রকৃত রহস্য উদঘাটনে ব্যাহত হবে। পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার বিভিন্ন বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, “নির্যাতন বলতে মানসিক কষ্ট” সংশ্লিষ্ট অংশ সংশোধনের প্রত্যাশা করছেন।

২০১৫ সালে পুলিশের পক্ষ থেকে উক্ত আইনের ১৪টি ধারা ও উপধারা সংশোধন চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। ২০১৭ সালের পুলিশ সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর কাছে উক্ত আইনটি বাতিলের দাবী জানালে প্রধানমন্ত্রী এ দাবি নাকচ করে দেন। ২০১৮ সালের কল্যাণ প্যারেডে উক্ত আইনটি বাতিল না করে সংশোধনের প্রস্তাব করেন এক পুলিশ কর্মকর্তা। (৯ই জানুয়ারী, ২০১৮ – যুগান্তর)

 

লেখক : প্রতিবেদক, ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম।