মনিরা নাজমী জাহান

করোনা মানুষকে কতটা শোধরাতে পেরেছে ?

মনিরা নাজমী জাহান :
সম্প্রতি সময়ে আইসিসিডিডিআর,বি একটি উদ্বেগজনক সংবাদ প্রকাশ করেছে। তাদের ওয়েবসাইট থেকে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, আইসিসিডিডিআর,বি সর্বপ্রথম গত ৬ জানুয়ারি ইউকে ভ্যারিয়েন্টের সন্ধান পায়। যদিও আন্তর্জাতিক সংস্থা জিসএইডের তথ্য বলছে, ইউকে ভ্যারিয়েন্ট দেশে ডিসেম্বর মাসেই প্রবেশ করে। এই ভ্যারিয়েন্ট উল্লেখযোগ্য হারে মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। যা শতকরা ৫২ শতাংশ পজিটিভ নমুনার মধ্যে পাওয়া গেছে। আইসিসিডিডিআর,বি র তথ্য বলছে সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট দেশে প্রবেশের পর উল্লেখযোগ্যভাবে একটি পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। যার ফলে মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টকে ছাড়িয়ে সর্বাধিক আধিপত্য বিস্তারের নজির পায় প্রতিষ্ঠানটি। মার্চের চতুর্থ সপ্তাহে দেখা গেছে অন্যান্য যতগুলো ভ্যারিয়েন্ট আছে তার ৮১ শতাংশই সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট। এই খবরটি তে আতংকিত হবার মত যথেষ্ট কারন রয়েছে। কারন আমাদের দেশে করোনা দ্বিতীয় দফায় যে ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে এই ভাবে সংক্রমন বাড়তে থাকলে করোনা মহামারী মোকাবেলা খুবই দুরূহ বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। এমনিতেই আমাদের দেশের জনসংখ্যার ঘনত্ব অনেক বেশী তার উপরে মানুষের রয়েছে স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে উদাসীনতা। সব মিলিয়ে আমাদের কে এই মহামারী মোকাবেলায় দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হবে। তবে করোনার এই সংক্রমন কিন্তু এই প্রথমবার নয় আর আগেও মানুষ করোনায় সংক্রমিত হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত করোনা ভাইরাস বাংলাদেশকেও আক্রমণ করেছে। বাংলাদেশে গত বছরের ৮ই মার্চ প্রথম করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্তের ঘোষণা আসে। তারপর থেকে বাংলাদেশের মানুষকেও এই ভাইরাসের কারণে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়তে হয় সে সাথে করোনার কারনে বহু মানুষকে প্রান হারাতে হয়েছে। এমন কোন সেক্টরের মানুষ পাওয়া যাবে না যেই সেক্টরের মানুষকে করোনার কারনে প্রান হারাতে হয় নি। করোনা আমাদের ভিতর থেকে এমন কিছু মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে যারা ছিলেন এই দেশের প্রথম সারীর রত্ন।
বার বার এই মহামারীর করোনা মোকাবেলায় ভয়াবহ রকম অসহায় হয়ে পড়েছে মানুষ। এক রকম প্রকৃতির কাছে মানুষ আত্মসমর্পন করেছে বলাটাও ভুল হবে না। কিন্তু তারপর ও কি মানুষের মধ্যে বোধোদয় হয়েছে ? মানুষ কি বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়েছে? মানুষের মধ্যে কি মানবিকতা জাগ্রত হয়েছে ?

প্রশ্নগুলোর উত্তর পাবার জন্য প্রথম দফা করোনার ঊর্ধ্ব সংক্রমন থেকে দ্বিতীয় দফার ঊর্ধ্ব সংক্রমন পর্যন্ত ঘটা সকল ঘটনাগুলোর দিকে লক্ষ্য করলেই আমরা দেখবো মানুষের পদস্খলনের নমুনা ।
গত বছর করোনার প্রথম ধাপের উর্দ্ধমুখী সংক্রমণের সময় আমরা দেখেছি করোনার টেস্টের রিপোর্ট নিয়ে কি অমানুষিক কাজটাই না করেছে মানব আকৃতিধারী কিছু দানব। মানুষের এমন দুর্বল মুহূর্তের সুযোগ নিয়ে প্রতারনা করতে তাদের বিন্দু পরিমাণ অন্তর কাপেনি। আমরা দেখেছি করোনার সময় একদল উগ্র সাম্প্রদায়িক মানুষদের করোনাকে কেন্দ্র করে মিথ্যা ও গুজবের পসরা সাজাতে। কখনও বলা হয়েছে করোনা বিশেষ ধর্মের উপরে সৃষ্টি কর্তার পক্ষ থেকে আসা গজব, কখনো বলা হয়েছে কোন বিশেষ ধর্মের মানুষের করোনা হবে না, আবার করোনার সাথে স্বপ্নে কথা বলার মত আষাঢ়ে গল্প শুনিয়ে বিভ্রান্ত করা হয়েছে মানুষদের। যে সময়ে দরকার ছিল মানুষের পাশে দাড়ানোর সেই সময়ে কিছু মানুষ মহামারীকে কেন্দ্র করে বেছে নিয়েছে প্রতারনার পথ ,মানুষকে করেছে বিভ্রান্ত।

করোনা নামক ভয়াবহ ভাইরাস যা স্তব্ধ করে দিয়েছে পুরো বিশ্বকে। এই ভাইরাইসের কবলে পড়ে পৃথিবীর সকল সেক্টরের চাকা থমকে গিয়েছে। তবু এই ভয়াবহ করোনা ভাইরাস পারেনি নারী নির্যাতনকে থামাতে। করোনা নামক মহামারি বাতাসের সাথে ছড়িয়ে নিভিয়ে দিচ্ছে মানবসভ্যতার আলো, মানুষ যখন প্রতিটি মুহূর্তে মৃত্যুর প্রহর গুনছে তখন থেমে থাকেনি নারী নির্যাতন। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) দেয়া তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে বাংলাদেশে ১৫৪৬ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে ৫১ জন এবং ধর্ষনের পর আত্মহত্যা করেছেন ১৪ জন। করোনার মত ভয়াবহ ভাইরাস পৃথিবীর অনেক কিছুর গতিপথ বদলে দিলেও বদলাতে পারেনি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অমানুষিক আচরণকে। নারীর প্রতি এই আচরন যে শুধু ঘরের বাইরে ছিল তাও নয় নারীর প্রতি এই নির্যাতন সমভাবে চলেছে চার দেয়ালের মধ্যেও। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) দেয়া তথ্য অনুযায়ী ২০২০সালে বাংলাদেশে পারিবারিক সহিংসতার শিকার হন ৫৫৪ জন নারী যাদের মধ্যে ২৪০ জনকে তাদের স্বামী হত্যা করে।

করোনাকালীন সময়ে অনলাইনেও নারীকে ব্যাপক হয়রানির মুখোমুখি হতে হয়েছে। গনমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে পুলিশের সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন (পিসিএসডব্লিউ) সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর যাত্রা শুরু করে এখন পর্যন্ত বিশেষ ইউনিটের হটলাইনে প্রায় পাঁচ হাজারেরও বেশি সাইবার অপরাধের শিকার নারী কল করেছেন। এর মধ্যে ফেইক ফেসবুক আইডি সংক্রান্ত অভিযোগ ২৩ শতাংশ, আইডি হ্যাক সংক্রান্ত ১৩ শতাংশ, ব্ল্যাকমেইলিং সংক্রান্ত ৮ শতাংশ, মোবাইল হ্যারাজমেন্ট সংক্রান্ত ৯ শতাংশ, অশ্লীল কন্টেন্ট পাঠানো সংক্রান্ত ৭ শতাংশ, অন্যান্য ৯ শতাংশ এবং অপ্রাসঙ্গিক অভিযোগ আসে ২৭ শতাংশ।

শুধু জীবিত নয় নারীর মৃত দেহ নিরাপদ ছিল না এই করোনার এক বছরে। মুন্না ভগত নামে এক ডোম কে গ্রেফতার করা হয় মৃত নারী ধর্ষনের অভিযোগে। একটি মানুষের মস্তিষ্ক কতটা বিকৃত হলে এই ধরনের বীভৎস ঘটনা ঘটাতে পারে? শুধু নারী নয় শিশুরাও নিরাপদ ছিল না এই করোনা কালীন সময়ে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) দেয়া তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে দেশে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১৬৩৮ জন শিশু।

এবার আশা যাক উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের বিস্তার প্রসঙ্গে। এই করোনাকালীন সময়ে আমরা দেখেছি মহামারী শুরুর দিকে নিজেদের ম্যাগাজিন আল নাবাতে কোভিড-১৯’কে খ্রিস্টান দেশগুলোর জন্য সাজা হিসেবে উল্লেখ করে প্রচারণা চালিয়েছিল আইএস। করোনা নিয়ে বেসামাল থাকা পশ্চিমা বিশ্বে হামলা চালাতে অনুসারীদের আহ্বান জানিয়েছিল তারা। তাদের প্রকাশিত নিবন্ধগুলোতে করোনা পরিস্থিতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করতে দেখা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে নাস্তিকতা ও অনৈতিকতার যে জোয়ার চলছে তার শাস্তি হিসেবে বিশ্বব্যাপী এ মহামারী পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
অপরদিকে আরেকটি আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল কায়দা কোভিড-১৯ নিয়ে ছয় পৃষ্ঠার একটি নির্দেশনা ও বিবৃতি প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়, ‘করোনা গোটা দুনিয়ায় অন্ধকারাচ্ছন্ন, যন্ত্রণাদায়ক ছায়া ফেললেও মুসলিম বিশ্বে ভাইরাসটি প্রবেশ করার কারণ হল মুসলিম দেশগুলোতে পাপ, অশ্লীলতা ও নৈতিক অবক্ষয় বেড়ে গেছে। তারা বলছে, ‘সঠিক ধর্মবিশ্বাসকে ছড়িয়ে দিতে, মানুষকে আল্লাহর পথে জিহাদের আহ্বান জানাতে এবং দমন ও দমনকারীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে করোনা সংকটকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে হবে। বাংলাদেশেও আমরা দেখেছি এই উগ্র সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ শক্তির আস্ফালন। প্রথমে করোনাকে কেন্দ্র করে তারপর করোনার টীকা কে কেন্দ্র করে ভয়াবহ মিথ্যাচার চালিয়েছে এই অশুভ গোষ্ঠী। পরবর্তীতে দেখেছি স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলার বিষয়েও মানুষকে নিরুৎসাহিত করেছে এই অশুভ গোষ্ঠী। ধর্মীয় মাহাফিলের নামে নারীর প্রতি কটূক্তি, উগ্র সাম্প্রদায়িক বার্তা দিয়ে সমাজ কে অস্থিতিশীল করে মিথ্যা তথ্য দিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর জঘন্য হামলা ঘটিয়েছে এই অপশক্তি ।

করোনার প্রথম ধাক্কার পর থেকে দ্বিতীয় ধাক্কা পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়ে এমন কোন কু কর্ম নেই যে মানুষ করেনি। অথচ প্রথমবার করোনার রুদ্র মুর্তি দেখার পর মানুষের উচিৎ ছিল নিজেকে শুধরে নেয়া। নিজের মধ্যে মানবিকতা জাগ্রত করা। যে সমাজ মানুষকে তার সর্বপ্রথম পরিচয় মানুষ না শিখিয়ে ধর্ম, বর্ন, গোত্র প্রভৃতির ভিত্তিতে বিভক্ত করতে শেখায় সেই সমাজ কি সভ্য সমাজ ? যে সমাজের মানুষ বিভিন্ন ইস্যুতে একে অপরের প্রতি এহেন ঘৃণা মনে লালন করে সেই সমাজের মানুষ কি আদতেই সুস্থ মানুষ? এই প্রশ্ন গুলো কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।

করোনার এমন ভয়াবহ রুদ্র মুর্তির সামনে মানুষ নিজের অসহায়ত্ব দেখেও যদি নিজেদের শোধরাতে না পারে তাহলে হয়তো মানুষকে সামনে করোনার চেয়েও কোন ভয়াবহ রুদ্র মুর্তিকে মোকাবেলা করতে হতে পারে ।কারন ভুলে গেলে চলবে না প্রকৃতি খুব বেশী অনিয়ম পছন্দ করে না। তাই ভবিষ্যতে ইতিহাসের বিচারে নিজেদের সভ্য মানুষ হিসেবে পরিগণিত করার স্বার্থে এবং নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থে মানুষের মধ্যে বিবেক বোধ, মানবিকতা বোধ জাগ্রত করার বিকল্প নেই।

লেখিকা : শিক্ষক , আইন বিভাগ , ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়।