মিল্লাত হোসেন
মিল্লাত হোসেন

একটি ভিনদেশী অভিজ্ঞতার আলোকে আইনগত সহায়তা ও কিছু পর্যবেক্ষণ

মোহাম্মদ মিল্লাত হোসেন:
২০১৮ সালে আমার অস্ট্রেলিয়া সফরের অভিজ্ঞতা হয়েছিলো। আইন ও বিচার বিভাগের “অধস্তন আদালত ব্যবস্থাপনা শক্তিশালীকরণে আইন ও বিচার বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ” প্রকল্পের আওতায় ওয়েস্টার্ন সিডনি ইউনিভার্সিটিতে বাংলাদেশের বিচারকদের জন্য আয়োজিত একটি কোর্সে অংশ নেয়াই ছিলো সফরের উদ্দেশ্য। কোর্সের মধ্যেই একদিন ছিলো অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস প্রদেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টসহ জেলা পর্যায়ের আদালত পরিদর্শন। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, অস্ট্রেলিয়ার সর্বোচ্চ আদালতের নাম হাইকোর্ট, যা রাজধানী ক্যানবেরাতে অবস্থিত। আর, প্রাদেশিক সর্বোচ্চ আদালতের নাম সুপ্রিম কোর্ট। সেখানে বিচার বলতে মূলতঃ জুরি’র বিচার (Jury trial) কেই বোঝায়। ছোটখাট বিরোধের ক্ষেত্রেই কেবল বিচারককেন্দ্রীক বিচারব্যবস্থা চালু আছে। যা আমাদের দেশের একেবারেই বিচারককেন্দ্রীক বিচারব্যবস্থার বিপরীত।

অস্ট্রেলিয়া সফরের বিষয়টি ভাবনায় আসারও অনেক আগে থেকে জুরি’র বিচার দেখার একটা দুর্দমনীয় ইচ্ছা জেগে ছিলো আমার মধ্যে। এমন বাসনার উদ্গম হয় অসংখ্য কোর্টরুম মুভি দেখে দেখে। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা যায় যে, কমন ল’ ব্যবস্থায় (যেখানে মূলতঃ মামলার ০২ পক্ষই লড়াই করে, আর বিচারক আম্পায়ারের ভূমিকায় অবর্তীর্ণ হয়ে সিদ্ধান্ত দেন) সাধারণতঃ গুরুতর বিষয়ের বিচার জুরির মাধ্যমে হয়। এতে মামলার ফলাফল কি হবে, অর্থাৎ আসামি দোষী না নির্দোষ কিংবা বাদী মামলায় জিতলেন না হারলেন- তা নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিচারকের কোন ভূমিকা নেই। ফয়সালা করেন ১২ জন ব্যক্তি। যাদের সমাজের সাধারণ মানুষদের মধ্যে থেকে কিছু মানদ- ধরে বেছে নেয়া হয় দৈবচয়নের ভিত্তিতে। এরাই হলেন জুরি। এই ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত দর্শন হলো- বিচারকেরা হলেন আইনে বিশেষজ্ঞ, তাদের বিচারধারা সমাজের সাধারণের বিচারধারার সমান হবে না, অনেক উচ্চমার্গীয় ধরনেরই হওয়ার কথা। যা কাম্য নয়। সমাজের একেবারে সাধারণ মানুষের চোখে বা বিবেচনায় যিনি বা যারা দোষী বা নির্দোষ বলে গণ্য হবেন, তাদেরই দোষী বা নির্দোষ বলে সাব্যস্ত করাটাই বাস্তবসম্মত। জুরিরা ফলাফল ঘোষণার পর দণ্ডের প্রকৃতি বা সময় ইত্যাদি ঘোষণার দায়িত্ব বিচারকের। ব্রিটিশ আমলে আমাদের দেশেও এই জুরির বিচার চালু ছিলো। পরে সেটা বাতিল হয়ে বর্তমানের বিচারককেন্দ্রীক বিচারব্যবস্থা চালু হয়। এইবার একটি কমন ল’ ব্যবস্থার দেশ অস্ট্রেলিয়ার বিচার-আচার পর্যবেক্ষণের সুযোগ আসার সাথে সাথে আমার একবার স্বচক্ষে জুরির বিচার দেখার পুরনো ইচ্ছা মাথাচাড়া হয়ে উঠলো। নির্দিষ্ট দিনটিতে যথারীতি ধরাচূঁড়া পরে চললাম।

প্যারাম্যাটায় আদালত চত্বরে গিয়ে দেখি সব আদালত এক জায়গাতেই অবস্থিত। আমাদের যিনি আতিথ্য দিয়েছেন মার্ক কার্টিস মারিয়েন, এসসি হলেন জেলা জজ পদমর্যাদার বিচারক। তিনি আবার আমাদের ওয়েস্টার্ন সিডনি ইউনিভার্সিটির এডজাঙ্কট প্রোফেসরও, স্বয়ং নেমে এলেন। এসেই ছোটখাটো একটা ব্রিফিং দিলেন। তাতে অন্যান্য কথার মধ্যে কাজের যে কথাটি বললেন তা হলো- এক সাথে ৪০ জন দর্শনার্থী বসার মতো ব্যবস্থা এজলাস গুলোতে নেই। তাই দু’টি দলে ভাগ হয়ে আমাদের এক দলকে নিয়ে যাবেন সুপ্রিম কোর্টের জুরির বিচার দেখাতে, আর আরেকদলকে নিয়ে যাবেন অন্য আদালতে। আমাদের যিনি দলনেতা তিনি এবার ছড়ি নিয়ে উদয় হলেন। তিনি হুকুম দিলেন- জোড়-বিজোড় রোল নং অনুসারে ডানে-বামে ভাগ হয়ে ডানের দল যাবে জুরি বিচারে আর বামের দল অন্য আদালতে। বিধি বাম! আমি পড়লাম বামের দলে! এতোদূর এসে জুরির বিচার চোখ ফসকে যাবে! তা আর হয় নাকি! আলগ্যেছে পক্ষত্যাগ করে জুরির বিচারের দলে ভিড়ে গেলাম। কিন্তু, বিধি যে অলক্ষে অতিবাম হয়ে বসে আছেন তাই বা কে জানতো!

কয়েক স্তরের অত্যন্ত কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনী পার হয়ে আমরা এজলাসে পৌঁছলাম। সেখানে শুনশান নিরবতা। আমরা ছাড়া মাত্র দু’জন নারী সাংবাদিক আর ৪/৫ জনকে দেখলাম দর্শক সারিতে। অতি কোলাহলপ্রবণ এজলাসে অভ্যস্ত আমাদের সবারই কেমন যেনো লাগলো এই রাজ্যের নিরবতা! আমাদের হোস্ট এসে অত্যন্ত নিচু গলায় আবার ব্রিফিং করলেন। এই আদালতে আজ অত্যন্ত আলোচিত ও গুরুতর একটি মামলার বিচার হবে। এরপর কিছুটা কুণ্ঠিত অবস্থায় মামলার একমাত্র আসামি ও তার বিরুদ্ধে অভিযোগের যে বয়ান তিনি দিলেন তাতে আমাদের মাথাই হেঁট হয়ে গেল। অভিযুক্ত একজন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসিতে পড়ুয়া বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত তরুণ ইহসাস খান (২৫)! তার বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো- তিনি ছুরি হাতে আল্লাহু আকবার বলে একজন নিরীহ অস্ট্রেলীয় পথচারী ওয়েইন গ্রিনহালজ (৫৭) এর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ক্রমাগত ছুরিকাঘাত করতে থাকেন! এই সময় তিনি ইরাকে বোমা হামলার প্রতিশোধ হিসেবে তাকে হত্যা করছেন বলেও চিৎকার করতে থাকেন। গুরুতরভাবে জখম হলেও পাশের একটি চুল কাটার দোকানে ঢুকে যেতে পারায় ভিকটিম প্রাণে বেঁচে যান। তাকে অস্ট্রেলিয়ার চলমান সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপটে সবচে’ গুরুতর অপরাধ বলে চিহ্নিত সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সাথে হত্যাচেষ্টার দায়ে অভিযুক্ত করা হলো। অভিযুক্ত জবাবে এর সবই স্বীকার করেন। তবে, তার ডিফেন্স ছিলো- তিনি এই সময় মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন।

এজলাসে উইগ পরা ব্যারিস্টার, প্রসিকিউটর, তাদের সহকারী, মার্শাল ও আদালতের কর্মকর্তারা ব্যস্তসমস্ত হলেও বিচার শুরু হতে দেরি হচ্ছিলো। আমরাও উশখুশ করছিলাম দেখে হোস্ট মহোদয় আবার আসলেন। এসে যা বললেন তাতে আমরা আবার- জিভ কাটি লজ্জায়! অভিযুক্ত মহাশয় নাকি সেদিনই আদালতে আসার আগে নিরাপত্তারক্ষীদের মারধর করেছেন, সেজন্যই দেরি হচ্ছে এবং বিচার আজকের জন্য মুলতবিও হয়ে যেতে পারে!

কিছুক্ষণ পর এজলাস থেকে অন্য সবাইকে বের করে দিয়ে আমাদের কাছে আসলেন স্বয়ং বিচারপতি জেফ্রি জন বেলো। এসে তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বললেন- যে আজকে বিচার মুলতবি করতে হচ্ছে। কারণ নিরাপত্তারক্ষীদের মারধরের ঘটনায় একদিকে যেমন আদালতের নিরাপত্তা (অভিযুক্তের আবারো সহিংস হয়ে উঠার আশঙ্কা) নিয়ে সমস্যা হতে পারে; অন্যদিকে, তেমনি আসামিপক্ষের ব্যারিস্টার সাহেবও আজকে শুনানি করতে ইচ্ছুক নন। কারণ, তার মতে, আজ অভিযুক্তের মানসিক অবস্থা বিচারের মুখোমুখি হওয়ার মতো নয়। তার আরো আশঙ্কা যে, জুরিদের সামনে বিচারের সময় যদি তার মক্কেল অসংযত বা হিংসাত্মক আচরণ করেন তাহলে বিচার ফয়সালার সময় জুরিদের মতামত তাতে অভিযুক্তের বিপক্ষে প্রভাবিত হয়ে যেতে পারে। অত্যন্ত বিরসবদনে বলতেই হচ্ছে- আমার জুরির বিচার দেখার “সাধ না মিটিলো; আশা না পুরিলো”!

এরপর বিচারপতি বেলো আমাদের বিভিন্ন জিজ্ঞাসার জবাব দিলেন। তিনি জানালেন যে, অভিযুক্তের পক্ষে যে ব্যারিস্টার লড়ছেন তিনি সেরা আইনজীবীদের একজন। তার ফি সবচেয়ে বেশি। বিপরীতে যিনি সরকারপক্ষের প্রসিকিউটর, তিনিও অত্যন্ত উচ্চমানের ব্যারিস্টার। তখন স্রেফ কৌতুহলবশতঃ আমি প্রশ্ন করলাম যে, অভিযুক্ত যদি মানসিকভাবে অসুস্থতারই দাবি করেন তবে তার পক্ষে এতো উচ্চব্যয়ের ব্যারিস্টার নিয়োগ করলেন কে, তার পরিবার কী খুব অবস্থাসম্পন্ন? এক বাক্যে জবাব এলো- না, তার পরিবার তার পক্ষে দাঁড়ায়নি; প্রাদেশিক আইনগত সহায়তা সংস্থাই আসামির পক্ষে এই দামি কৌঁসুলিকে নিয়োগ করেছে। আমাদের সবার তখন ভিরমি খাবার যোগাড়! নিজেরাই বিচারক হবার সুবাদে আমাদের রাষ্ট্রীয় আইনগত সহায়তা সম্পর্কে আমাদের সবারই প্রত্যক্ষ ধারণা ছিলো। তাছাড়া, রাষ্ট্রের এই একটি বিষয় আইনগত সহায়তার কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দিতে হয় বিচারকদেরকেই। তাই, সেদেশের বিবেচনায় সবচে’ জঘন্য অপরাধ (দোষীসাব্যস্ত হলে সর্বোচ্চ সাজা হতে পারে) অভিযুক্তের জন্য সবচে’ দামি ব্যারিস্টার নিয়োগ দিলেন আবার তারা যারা আবার তারই বিচার চান, সেই খোদ রাষ্ট্রই- জেনে আমরা বেশ চমকিত হয়েছিলাম। আমাদের আরো অবাক করে দিয়ে তিনি জানালেন যে, এখানে এটাই না কি সাধারণ ঘটনা!

এই একটি কথাতেই সে দেশের সাথে আমাদের আইনগত সহায়তার ধরন ও ব্যপ্তির পার্থক্য বেরিয়ে এলো। আমাদের আইনগত সহায়তা দেবার যে ধরন-ধারন তাতে দেখা যায় যে, বার সমিতিগুলোর আইনজীবীদের মধ্যে যারা দক্ষতা-যোগ্যতায় সেরা তারা আইনগত সহায়তা কার্যক্রমের সাথে জড়িত থাকেন না বললেই চলে। এর কারণ অনেক। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো-

– এই কাজের জন্য যে ফি সরকারিভাবে বরাদ্দ থাকে তা অতি সামান্য। সেরা আইনজীবীর ফি তার অনেকানেক গুণ বেশি;

– জেলা আইনগত সহায়তা কমিটি ইচ্ছা করলেই প্রয়োজনীয় ফি দিয়ে উচ্চমানের আইনজীবীকে নিয়োগ দিতে পারেন না। তাদের একটি বিশেষ আইনজীবী প্যানেল থেকেই নিয়োগ দিতে হয়। কম ফি’র জন্য সেরা আইনজীবীরা এই প্যানেলেও অন্তর্ভুক্ত হতে চান না;

– মক্কেল যদি কোন আইনজীবীকে পছন্দ করেন তাহলে তাকে নিয়োগ দেয়ার বাধ্যবাধকতা আছে জেলা আইনগত সহায়তা কমিটির। সাধারণতঃ দেখা যায় যে, একজন আইনজীবীই মামলা নিয়ে আসেন যাতে পরোক্ষে মক্কেল তাকেই আইনজীবী হিসেবে পছন্দ করতে দেখা যায়। বলাই বাহুল্য যে, সেরা আইনজীবীদের এই প্রক্রিয়ায় দেখা যায় না। কারণ, তাদের উচ্চ ফি দিয়ে নিযুক্ত করার মক্কেল এতো বেশি থাকে যে, তারা আইনগত সহায়তার মামলার মতো “ঝুটঝামেলা/বাধ্যবাধকতা”য় আসতে অনিচ্ছুক থাকেন;

সর্বোপরি, আমাদের আইনগত সহায়তায় মূলতঃ আইনজীবীর খরচ বাবদ অর্থ দেয়া সম্ভব হয়। সাক্ষীদের যাতায়াত ভাতা দেয়ার সুযোগ নেই। প্রয়োজনীয় দলিলপত্র তোলার সময় কিছু ক্ষেত্রে অর্থ পাওয়া সম্ভব হলেও তার প্রক্রিয়া দীর্ঘ ও জটিল। ফলে, মক্কেলরা তাতে উৎসাহিত হন না। অর্থাৎ একজন ব্যক্তি আইনগত সহায়তা পাওয়ার পরও দেখা যায় যে, তাকে মামলার অনেক খরচ বহন করতে হয়।

জেলা আইনগত সহায়তা কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন ও বিচারক হিসেবে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে আরো কিছু বিষয় জানা যায়। যেমন-
• ফৌজদারি বিচারে কেবল জামিন শুনানি আর দেওয়ানি ক্ষেত্রে কিছু পারিবারিক মামলায় আইনজীবীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। মূল বিচার প্রক্রিয়ায় প্যানেল আইনজীবীদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য নয়;
• কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিচারপ্রার্থীদের কাছ থেকে এমন অভিযোগ আসে যে, নিযুক্ত প্যানেল আইনজীবী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেন না;
• কখনো দেখা যায় কম দক্ষ আইনজীবী নিয়োগের ফলে তার অভিজ্ঞতার অভাবে মামলার মেরিট নষ্ট হয় বা প্রার্থী ইপ্সিত প্রতিকার পান না;
• আবার, প্যানেল আইনজীবী থাকার পরও মক্কেলরা ব্যক্তিগতভাবে আইনজীবী নিয়োগ দিচ্ছেন, এমন ঘটনা আকছারই ঘটতে যখন দেখা যায়;
• প্রচলিত আইন-বিধি-নীতিমালায় সহায়তা প্রার্থীর প্রকৃত আর্থিক সামর্থ নিরূপণের ব্যবস্থা না থাকায় ঢালাও ভাবে আইনগত সহায়তা দিতে হয়, এক্ষেত্রে জেলা কমিটির তেমন কিছু করার থাকে না;
• মাঝেমাঝে দেখা যায়, সক্ষম ব্যক্তিরাও ‘লিগ্যাল এইডের মামলা’ হিসেবে নিছক আদালতের সহানুভূতি পাওয়ার উদ্দেশ্যেও আইনজীবী নিয়োগের প্রার্থনা করেন। বিচারাধীন বন্দিদের ক্ষেত্রে এই ঘটনা বেশি ঘটতে দেখা যায় ইত্যাদি।

এটা অস্বীকার করার জো নেই যে, অস্ট্রেলিয়ার মতো একটি আর্থিকভাবে উন্নত দেশের আইনগত সহায়তা কর্মসূচির সাথে বাংলাদেশের মতো নিম্মমধ্যবিত্ত রাষ্ট্রের তুলনা চলে না। তাছাড়া, সেই দেশটা বাংলাদেশের চেয়ে আয়তনে ৫০ গুণ বড় হলেও এর জনসংখ্যা আমাদের ১/৮ অংশমাত্র। ফলে, তারা আইনগত সহায়তায় অনেক বেশি অর্থ-মেধা-শ্রম ব্যয় করার সামর্থ রাখেন।

আবার, সেখানে মামলার সংখ্যাও আমাদের তুলনায় অত্যন্ত কম। আমাদের পরিদর্শনের দিন সুপ্রিম কোর্টে কেবল ০১ টি মামলাই বিচারের জন্য তালিকাভুক্ত ছিলো। কম মামলা থাকার অন্য কারণও অবশ্য আছে। সেখানকার নাগরিকদের মধ্যে আইন মেনে চলার উচ্চমানের সংস্কৃতি রয়েছে। অপরাধ স্বীকার করা ও আপোষে মামলা নিষ্পত্তির হারও অনেক বেশি। সেখানে আবার মিথ্যা ফৌজদারি মামলা করার সুযোগ নেই বললেই চলে। কারণ রাষ্ট্রপক্ষে কেবল পুলিশই মামলা দায়ের করতে পারে। যে কোন অভিযোগ পেলেই পুলিশ তা আমলে নিয়ে তদন্ত করতে বাধ্য থাকে। আবার, অকাট্য প্রমাণ ছাড়া আদালত পুলিশের মামলাও বিচারে নেন না। আর দেওয়ানি, ফৌজদারি বা পারিবারিক যে কোন মামলাতেই পরাজিত পক্ষকেই মামলার সম্পূর্ণ খরচ বহন করতে হয়। এই খরচ অনেক অনেক বেশি। অনেকক্ষেত্রে মামলার খরচ বহন করতেই মানুষ ফতুর হয়ে যান। ফলে, পক্ষদেরও যেমন মামলা দায়েরের ব্যাপারে চরম সতর্ক থাকতে হয়; তেমনি, সলিসিটর/ব্যারিস্টাররাও জেতার ভালো সম্ভাবনা নেই- এমন মামলা হাতে নেন না। কারণ, হারলে তাদের সুনাম ক্ষুণ্ণ হয়, যা তাদের পরবর্তী ব্রিফ পেতে অসুবিধার সৃষ্টি করে। স্পষ্টতঃই কম মামলা থাকার সাথে উচ্চমানের আইনগত সহায়তা দেয়ার সম্পর্ক ওতপ্রোত।

এটাও সত্যি যে, অত্যন্ত অল্প সময় ও অপ্রতুল অর্থ বরাদ্দ নিয়েও আমাদের জাতীয় আইনগত সহায়তা সংস্থা দেশে আইনগত সহায়তার ধারণাটিকে জনারণ্যে পরিচিত, প্রতিষ্ঠিত ও অনেক ক্ষেত্রেই কার্যকর করে তুলতে পেরেছে। তবে, আমাদের আরো উন্নতি করার সুযোগ আছে। অস্ট্রেলিয়ার মানে না হলেও আমাদের বিদ্যমান আইনগত সহায়তা কার্যক্রমকে আরো কার্যকর ও অর্থবহ করা সম্ভব। এর জন্য কিছু আইন ও কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। সেই রকম কিছু পর্যবেক্ষণ হলো-

১.জেলা কমিটির আওতায় দেওয়ানি ও ফৌজদারি প্লিডার/প্রসিকিউটরের স্থায়ী পদ সৃষ্টি করা, যারা নিজেরাই মামলা পরিচালনা করবেন। তাদের নিয়োগ হবে, জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে। তারা প্রয়োজন মনে করলে কমিটির মতামত নিয়ে মামলার গুরুত্ব বুঝে দক্ষ আইনজীবী নিয়োগ করবেন। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন সেবার মান বাড়ানো সম্ভব হবে; অন্যদিকে, জবাবদিহিতাও নিশ্চিত করা যাবে;

২.বর্তমানে আইনগত সহায়তার কার্যক্রমের ব্যপ্তি ঘটেছে নানাভাবে। নিয়মিত কাজের বাইরে মামলা দায়েরপূর্ব পরামর্শ থেকে আরম্ভ করে বিচারাধীন মামলায় মধ্যস্ততাসহ অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয়। ফলে, কেবল ০১ জন এবং তাও আবার সিনিয়র সহকারী জজ পদমর্যাদার বিচারকের পক্ষে এই গুরুদায়িত্ব পালন করা অত্যন্ত দুরুহ। তাই একজন জেলা জজ অথবা কমপক্ষে অতিরিক্ত জেলা জজ পদমর্যাদার বিচারকের অধীনে একজন করে যুগ্ম জেলা জজ ও সিনিয়র সহকারী জজ বা সহকারী জজ নিয়োগ করলেই ইপ্সিত ফলাফল পাওয়া যেতে পারে;

৩.আইনজীবীর ফি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ঊর্ধসীমা তুলে দিয়ে তা আলোচনা সাপেক্ষ রাখতে হবে;

৪.সাক্ষী ভাতা ও মামলার প্রয়োজনীয় খরচ নির্বাহের জন্য যথেষ্ট বরাদ্দ রাখতে হবে;

৫.আইনগত সহায়তা প্রার্থীর প্রকৃত আর্থিক সামর্থ নিরূপণ ও মামলার মেরিট বিবেচনার জন্য কিছু কার্যকর পদ্ধতি সৃষ্টি করার মাধ্যমে সহায়তার পরিধি ও আর্থিকসীমা বাস্তবসম্মত করে সেবার মান উন্নত করার ব্যবস্থা করতে হবে;

৬.যেহেতু মামলার সংখ্যার সাথে আইনগত সহায়তা সেবার উচ্চমানের বিষয় জড়িত সেহেতু মামলা দায়েরের হারই কমিয়ে দেয় এমন কিছু তাৎপর্যপূর্ণ আইনগত সংস্কার আনতে হবে। যেমন,

– পরাজিত পক্ষকেই মামলার প্রকৃত খরচ বহন করার বিধান করা;
– ভূমি, জরিপ ও নিবন্ধন ব্যবস্থাপনার পুনর্গঠন করা;
– বিচার বিভাগের অধীনে পৃথক ও জবাবদিহিপূর্ণ তদন্ত সংস্থা গঠন করা;
– সম্পূর্ণ বিচারব্যবস্থার ডিজিটালাইজেশন করা;
– স্বাভাবিক কার্যক্রমের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ভার্চুয়াল মাধ্যমেও মামলার কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার আইন, ২০২০ এর পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার নিশ্চিত করা ইত্যাদি।

পুনশ্চঃ
বিচার শেষে ইহসাস খানের “তিনি ঘটনার সময় মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন আর একটা জ্বীন তাকে হত্যা করার হুকুম দিয়েছিলো”- এই বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে জুরি তাকে দোষীসাব্যস্ত করে। এরপর প্রাগুক্ত বিচারপতি বেলো তাকে ৩৬ বছরের কারাদণ্ডের সাজা দেন যার মধ্যে ২৭ বছর তিনি জামিন লাভের যোগ্য হবেন না।

লেখক : যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ, সিলেট।