অ্যাডভোকেট সাব্বির এ মুকীম

পূর্বের আসামীর জামিনের পর পরের আসামীর জামিন : নীতিতে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায়

সাব্বির এ মুকীম:
জামিনে মুক্তির আদেশ-অভিযুক্ত এবং অভিযু্ক্ত পক্ষে নিযুক্তীয় আইনজীবীর পরম আরাধ্য আদেশ। মানুষের আঙ্গুলের ছাপের মতোই প্রত্যেকটা অভিযোগ ই ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা, একটা আরেকটার সাথে ম্যাক্রো লেভেলে মিলে গেলেও মাইক্রো লেভেলে তফাৎ জলের মতো স্বচ্ছ দেখা যায়। তাই জামিন মুক্তির আদেশ কখন হবে আর কখন হবে না তা নিয়ে কোনো জল নিরোধী মাপকাঠি চাওয়া অলসতা। প্রতিদিন নতুন অভিযোগ তৈরী হয়, সাথে সাথে জামিনে মুক্তির আদেশ পাওয়ার নতুন নতুন গ্রাউন্ড তৈরী হয়।
এমন অনিবার্য বাস্তবতায়ও আইন ব্যবস্থাকে সহজবোধ্য করার জন্য মাঝে মাঝে কিছু আউটলাইন একেঁ দেখানো হয়- কখন কখন জামিনে মুক্তির আদেশ বাঞ্চনীয় নয় আর কখন কখন বাঞ্চনীয়। তেমনি এক প্রচেষ্টায় ভারতের সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি এস এ বোবদে তাঁর দেয়া সবশেষ জামিনে মুক্তি সংক্রান্ত দরখাস্ত আদেশে পূণরায় সেসব আউট লাইনের কিছু লিখে দিয়েছেন। ২০২১ সনের ৪৪৮ নং ক্রিমিনাল আপিল মামলার বিগত ২৩শে এপ্রিল, ২০২১ এ দেয়া রায়ে অভিযুক্তকে এলাহাবাদ হাইকোর্টের দেয়া জামিন বাতিলের আদেশ দিতে গিয়ে ৩ সদস্য বিশিষ্ট বেঞ্চের দেয়া রায়ে অথর জাজ হিসেবে বিচারপতি বোবদে রায়ের ১১নং অনুচ্ছেদে প্রশান্ত কুমার সরকার বনাম আশিষ চট্টোপাধ্যায় গং, (২০১০) ১৪ এস সি সি ৪৯৬ নজীরের দোহাই দিয়ে পুনরায় ব্যাক্ত করেন যে-জামিনে মুক্তির আদেশের ক্ষেত্রে বিবেচনা করতে হবে:
i. অভিযুক্ত নালিশী অপরাধটা করেছে সেটার প্রাইমা ফেসি আছে কিনা কিংবা সে অপরাধ টা করে থাকতে পারে তা বিশ্বাস করার যৌক্তিক কারণ আছে কীনা!
ii. অভিযোগের রকম এবং জঘন্যতা।
iii. যদি সাজা হয়, তাহলে কম সাজা হবে- সহজ না কঠোর সাজা হতে পারে।
iv. জামিনে মুক্তি পেলে অভিযুক্তের ভাগার সম্ভাবনা আছে কীনা।
v. চরিত্র, আচার ব্যবহার, কি করে খায়, কেমন ক্ষমতা দেখায়, সামাজিক অবস্থান কি রকম।
vi. মুক্তি পেয়ে ফরিয়াদী বা ঘটনা নিয়ে স্বাক্ষ্য দিবে এমন কাউকে ক্ষতি করার সম্ভাবনা আছে কীনা।
vii. জামিনে মুক্তি দিলে বিচার প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটবে কীনা।

পরের অনুচ্ছেদে বিচারপতি বোবদে লিখেন, যার বাংলা তরজমা আমার কাছে যেমন মনে হয়েছে:

“অপরাধে অভিযুক্তের মুক্তি দরকারী বিষয় তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নাই। তবে একই সাথে ভিক্টিম বা স্বাক্ষীর জীবন ও জীবনের মুক্ত যাপনের প্রতি হুমকীর দিকেও নজর রাখতে হবে।”
অন্য দিকে কিছু দিন আগে ঘটা দিল্লী লাল কেল্লা রায়টির অভিযোগে গ্রেপ্তারকৃত হাজতী আসামী সন্দীপ সিং সাধু ওরফে দিপ সাধুর বিরুদ্ধে করা মামলায় দরখাস্তকারী হাজতি সাধুর জামিনে মুক্তির দরখাস্ত মঞ্জুর করে অনুমান ৩ হাজার শব্দের আদেশে গতকাল ২৬শে এপ্রিল, ২০২১ ইং তারিখে দিল্লী হাইকোর্ট লেখেন, যার বাংলা তরজমা আমার কাছে যেমন মনে হয়েছে:

“উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম যে, দরখাস্তকারীকে আরও কিছুদিন হাজতে রাখা অন্যায্য কারণ হাজতে রাখলে নতুন কোনো ফল আসবে না। তদূপরী মুক্তি পেলে দরখাস্তকারী পুলিশের চলমান তদন্তে কোনো ক্ষতি করবে বলেও মনে হয় না।”

এমন ধরণের প্রেক্ষিগুলোতে অনেক সময়ই দেখা যায় কোনো মামলায় একজন অভিযুক্ত জামিনে মুক্তির আদেশ পেলে পরের অভিযুক্তদের জন্যও জামিনে মুক্তির আদেশ পেতে উকিল সাহেবগণ সাবমিশন রাখেন- আগের আসামী জামিনে পেয়েছে, তাই পরের আসামীরও জামিন চাই; সাবমিশন মঞ্জুরও হয়। এমনও খুব বিরল ঘটনা নয় যে, দেখা যায় শুনানীর সময় সাবমিশন হয়- আগের মিসকেইসে জামিন দিছেন তাই আমার মিসকেইসেও জামিন দেন।
এমন সাবমিশনগুলো উপমহাদেশে বেশ চর্চিত। কাস্টম এর মর্যাদা পাবে কীনা সেটা আইন বিশারদেরা কষ্ঠি করে দেখবেন। তবে আমরা এই আলাপে ”আগের আসামীর জামিনে তাই পরের আসামীর জামিন হবে” নীতি নিয়ে ভারতের সুপ্রীম কোর্টের কয়দিন আগের মানে বিগত ২০শে এপ্রিল, ২০২০ তারিখে কি আলাপ করেছেন তা নিয়ে আলাপ করবো।
আলোচ্য মামলার নম্বর ২০২১ সালে ৪২২ নম্বর, এটি ক্রিমিনাল আপিল। দ্বৈত বেঞ্চের সিনিয়র বিচারপতি ডক্টর ধনঞ্জয় ওয়াই চন্দ্রচূড় এই রায় লিখেছেন। মামলার অভিযোগ হত্যাকান্ড। জমিজমা নিয়ে বিরোধের জের ধরে সুযোগ পেয়ে এক গোষ্ঠির লোক গণপিটিুনী দিয়ে আরেক গোষ্ঠির পাঁচ জনকে হত্যা করেছে মর্মে অভিযোগ।
নিম্ন আদালতে জামিন না পেয়ে অভিযুক্তরা গুজরাট হাইকোর্টে ক্রিমিনাল মিসকেইস করে। ২২ অক্টোবর, ২০২০ ইং তারিখে ১৩ নম্বর আসামী গুজরাট হাইকোর্ট থেকে জামিনে মুক্তির আদেশ পায়। এরপর সেই ”আগের আসামীর জামিনে তাই পরের আসামীর জামিন হবে ” নীতিতে ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২০ তারিখে ১৫নং, ১০ নং ও ৬নং অভিযুক্ত, ১৯ জানুয়ারী, ২০২১ তারিখে ১৬ নং অভিযুক্ত, ২০ জানুয়ারী, ২০২১ তারিখে ১৭ নং অভিযুক্ত জামিনে মুক্তির আদেশ পায়। সকলের জামিনে মুক্তির আদেশে লেখা ছিলো, যার বাংলা তরজমা আমার কাছে যেমন মনে হয়েছে:

”উভয় পক্ষের আইনজীবীদের শুনলাম। নথী পর্যালোচনা করলাম। সার্বিক দিক বিচার বিশ্লেষণে নালিশ, অপরাধের ধরণ, গভীরতা, দরখাস্তকারীর ভূমিকা বিবেচনায় এবং বিস্তারিত স্বাক্ষ্যপ্রমাণে না ঢুকে অত্র দরখাস্তকারীর জামিনে মুক্তির দরখাস্ত মঞ্জুরযোগ্য।
সবগুলো আদেশেই মূলত ১৩ নম্বর আসামীর ২২ অক্টোবর, ২০২০ তারিখের জামিনে মুক্তি সংক্রান্ত আদেশ তথ্য বিবরণ যুক্তি হিসেবে লেখা হয়। একই সাথে প্রত্যেকটা জামিন আদেশে মোটামুটি একই ভাষায় লেখা ছিলো: কোনো পক্ষের আইনজীবীই আদেশে অধিকতর যুক্তিতর্কের সন্নিবেশ প্রার্থনা করেন নাই। ” অর্থাৎ আগের আসামীর জামিনের ফলেই অন্য আসামীদের জামিনে মুক্তির আদেশ হচ্ছে আর কোনো সুনিদৃষ্ট যুক্তি লেখা হয় নাই কারণ বিদ্যমান পক্ষ নিযুক্ত আইনজীবীগণ বিজ্ঞ আদালতে আর অন্য কোনো যুক্তির আদেশে লেখা হোক তা চান নাই।
এই পয়েন্টেই ভারতীয় সুপ্রীম কোর্ট আলোচ্য রায়টি দিয়ে জামিনে মুক্তির পরের সবগুলো আদেশ বাতিল করেন। বিজ্ঞ সর্বোচ্চ ভারতীয় আদালত হাইকোর্ট থেকে জামিনে মুক্তির আদেশ প্রাপ্ত প্রত্যেকটা আসামী সংশ্লিষ্ট তথ্যাদী চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখান যে কেনো সে জামিনে মুক্তির আদেশ পাওয়ার হকদার নয়।
নিম্ন আদালতের আদেশ নিয়ে সুপ্রীম কোর্ট এই রায়ের ২০ নং, ২৭ নং অনুচ্ছেদে অভিযুক্ত অপরাধের রকম ও গভীরতা সংক্রান্ত বয়ান না করার, ২২ নং অনুচ্ছেদে অভিযোগের এবং সম্ভ্যাব্য শাস্তি সংক্রান্ত বয়ান না করা, ২৩নং, ২৪নং, ২৫নং,৩৩নং অনুচ্ছেদে প্যারিটি নীতি তথা আগের জামিন পাওয়া আসামী আর এই আসামী সেইম ফুটিং নীতি প্রয়োগ করার সমালোচনা করেন। ৩৭নং অনুচ্ছেদে হাইকোর্ট আদেশের “বিস্তারিত স্বাক্ষ্যপ্রমাণে না ঢুকে” বয়ানের সমালোচনা করে সর্বোচ্চ ভারতীয় আদালত বলেন- এটা সত্য জামিনে মুক্তি সংক্রান্ত আদেশে দরখাস্তকারী দোষী না নির্দোষ সে আলাপ উঠবে না- সেসব বিচারের কালের জন্য তোলা থাকবে । তাই বলে জামিনে মুক্তির দরখাস্ত মঞ্জুরে একবারেই কোনো যুক্তি দেয়া হবে না তা হতে পারে না- হাইকোর্টের তা দেয়া উচিৎ ছিলো। সেশন কোর্টগুলোতো ঠিকই তাদের নামঞ্জুরের আদেশগুলোতে সেসব যুক্তি বিস্তারিত আকারে লিখেছে- কিন্তু হাইকোর্ট সেসব লিখলো না বলে সর্বোচ্চ আদালত উষ্মা প্রকাশ করেন।
রায়ের ২৬ অনুচেছদে আদালত সুস্পষ্টভাবে লেখেন যে আগের আসামী জামিন আদেশ পাওয়ার গ্রাউন্ডেই মূলত পরের জামিনে মুক্তির আবেদনগুলো করা হয় এবং আদেশগুলো হয়ও। ৩২ অনুচ্ছেদে বিজ্ঞ আদালত সন্দেহাতীতভাবে এই উপসংহারে আসেন যে, নিম্ন আদালত পরের আদেশগুলোতে নিম্ন আদালত মূল ঘটনাগুলো তুলে ধরতে ব্যর্থ, অপরাধের গভীরতা ধরতে ব্যর্থ, অভিযোগের গুরুতর স্তর অনুধাবন করতে ব্যর্থ। বিজ্ঞ সর্বোচ্চ ভারতীয় আদালত দ্বিধাহীন ভাষায় হাইকোর্টের আদেশ কে বিকৃতি দোষে দুষ্ট বলে মন্তব্য করেন।
”আগের আসামী জামিন পাওয়ায় পরের আসামী জামিন হবে” এই নীতির সমালোচনা করে রায়ের ৩৪ অনুচেছদে বিজ্ঞ সর্বোচ্চ ভারতীয় আদালত লিখেন, যার বাংলা তরজমা আমার কাছে এমন মনে হয়েছে:
“আগে আসামীর জামিনে মুক্তির আদেশ পরের আসামীর দরখাস্তের কোনো গ্রাউন্ডই হতে পারে না। শুধু এবং কেবল মাত্র প্যারিটি বা একই ধারার অভিযোগ গ্রাউন্ডেরও কোনো বিচারিক যৌক্তিকতা নাই।… প্যারিটি নীতি বিবেচনায় নিতে হলে কেবল অস্ত্রে মিল থাকলেই চলবে না, অভিযুক্তের সুনিদৃষ্ট ভূমিকা ও বিবেচনায় নিতে হবে।””
এরপর রায়ের ৩৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়, জামিন অযোগ্য অভিযোগের ক্ষেত্রে জামিন সংক্রান্ত মঞ্জুর বা না-মঞ্জুর আদেশ দেয়া আদালতের সহজাত ক্ষমতা। কিন্তু আদেশ কেনো দেয়া হলো সে যুক্তি দেখালেই কেবল- সে সহজাত ক্ষমতা নিরাপেদ থাকে- তার বৈ নয়। যুক্তিগুলো আদেশে লিপি করলে নিশ্চিত হয় যে চিন্তার কোর ধারার ফলশ্রুতিতে এমন আদেশ হলো। এই জবাবদিহিতাটুকুই যুক্তি এবং ন্যায় বিচারের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করে।
এই রায়ের সবচে চুম্বক বলে মনে হওয়া ৩৫ অনুচ্ছেদে বিজ্ঞ আদালত লিখেন, যার বাংলা তরজমা আমার কাছে যেমন মনে হয়েছে:
“জামিনে মুক্তির আদেশের সাথে কেবল আদেশ প্রাপ্ত অভিযুক্তই নয়, রাষ্ট্রর স্বার্থ জড়িয়ে যায়, ভিক্টিম এর স্বার্থ জড়িয়ে যায়। এটা ঠিক যে জামিনে মুক্তির প্রার্থনা সম্বলিত দরখাস্ত বিবেচনায় পুরো ঘটনা মালা টানা যাবে না, সেজন্য বিচার কাল আছে। জামিন সংক্রান্ত আদেশের যুক্তিগুলো মূল বিচারে কোনো প্রভাবও ফেলে না। তবে জামিন সংক্রান্ত আদেশ দেয়ার সময় আদালত অবশ্যই তার বিচারিক মন প্রয়োগ করতে বাধ্য, এবং আদেশের যুক্তিগুলো সংক্ষিপ্ত আকারে হলেও লিখতে বাধ্য। উকিলে রা চায় নাই, উকিলে রা বলে নাই, উকিলে রা আপত্তি তোলে নাই এটা এই দায় হতে আদালত কে মুক্তি দেয় না।”
বিজ্ঞ আদালত তীব্র ক্ষোভের সাথে লিখেন:
এ ধরণের কারণ না লেখার এই বাগাড়াম্বর এমন আদেশগুলোকে আগপাশতলা যাচাই এর হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না।
পুরো রায়টি পড়লে অনুধাবন করা যাবে, আগের আসামী জামিনে আছে তাই পরের আসামীর জামিন হবে, আগের মিস কেইস এলাও হইছে তাই পরের মিসকেইসও এলাও হবে নীতিগুলো ফালতু, বোগাস নীতি হিসেবে চিত্রায়িত করা আছে ভারতে।

লেখক : আইনজীবী, কুমিল্লা জজ কোর্ট।