অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

তালাক প্রদানের সাথে দেনমোহর পরিশোধের সম্পর্ক কি?

সিরাজ প্রামাণিক :

আইনজীবী বিধায় অনেকে জানতে চান স্ত্রীকে তালাক দেয়ার সময় দেনমোহর পরিশোধ করার প্রয়োজনীয়তা আছে কি-না? সহজ উত্তর, না। তালাক প্রদান এবং দেনমোহর পরিশোধ দুটি ভিন্ন জিনিস। আবার অনেকে জানতে চান, স্ত্রী তালাক দিলে দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে কি-না? সহজ উত্তর- যে পক্ষ থেকেই তালাক দেয়া হোক না কেন, দেনমোহরের টাকা অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে।

আপনার স্ত্রীকে তালাকের পর কিংবা তালাকের আগে দেনমোহর পরিশোধ করতে পারবেন। কারণ দেনমোহর স্বামীর ঋণ, যা স্বামী তাঁর স্ত্রীকে পরিশোধ করতে বাধ্য। ‘সহবাসের আগে এবং পরে স্ত্রী স্বামীর কাছে দেনমোহর দাবি করতে পারে এবং স্বামী পরিশোধে ব্যর্থ হলে স্ত্রী সহবাসে যেতে অস্বীকার করতে পারেন বলে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত রয়েছে।’

বিয়ের পর স্বামী তার স্ত্রীকে অনেক কিছুই দিতে পারে। স্বামী যদি দেনমোহর হিসেবে স্ত্রীকে কিছু দেয়, তবেই তা দেনমোহর বলে বিবেচিত হবে। এক্ষেত্রে ‘দেনমোহর বাবদ’ কথাটি লেখা থাকতে হবে। যেমনঃ জমি হস্তান্তর দলিলে ‘দেনমোহর বাবদ’ কথাটি লেখা না থাকলে এরূপ জমি প্রদান দেনমোহর হিসেবে ধরা হবে না। যা রওশন আরা বেগম বনাম মাসক আহমেদ মামলায় ২৩ বি.এল.ডি. পৃষ্ঠা- ৩০২ এ উল্লেখ রয়েছে। তবে মোহরানার পরিবর্তে হিবা বিল এওয়াজের রীতিও রয়েছে। ১৯৫৫ সালে ঢাকা হাইকোর্ট সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে, মোহরানার পরিবর্তে হিবা-বিল-এওয়াজ তখনই বৈধ হবে যখন স্ত্রী কোনো প্রতিদান ছাড়াই স্বামীকে মোহরানা দান করে দেয় এবং পরে স্বামী স্ত্রীর দানের ‘এওয়াজ’ স্বরূপ কোন সম্পত্তি আলাদাভাবে দান করে। কারন এটা মুসলিম আইনে একটি বিশুদ্ধ হিবা বিল এওয়াজ। এমনকি স্বামী যদি স্ত্রীকে কোন কিছু দান করেন এবং স্ত্রী স্বামীর বরাবরে প্রতিদান স্বরূপ অন্য কোন দলিল মূল্যে মোহরানার অধিকার ছেড়ে দেয় তবে তা আধুনিক প্রকৃতির একটি হিবা বিল এওয়াজ বলে গন্য হবে বলে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত রয়েছে।

দেনমোহরের পরিবর্তে স্ত্রীর বরাবর সম্পত্তি হস্তান্তর একশত টাকা মূল্যের অধিক হলে অবশ্যই রেজিস্ট্রি দলিল দ্বারা হস্তান্তর করতে হবে। বিয়ের সময়ে দেয়া শাড়ী, গয়না ইত্যাদি কখনো দেনমোহরের অংশ হিসাবে বিবেচিত হবেনা। অনেক ক্ষেত্রে বিয়ের সময় গয়না, শাড়ি ইত্যাদির মূল্য দেনমোহরের একটি অংশ ধরে উসুল লিখে নেয়া হয়। আসলে বিয়েতে দেয়া উপহার বা উপঢৌকন দেনমোহর নয়। এগুলোকে দেনমোহরের অংশ বলে ধরা যাবে না এবং উসুল বলা যাবে না বলে আঃ কাদের বনাম সালিমা, ৮ ইন্ডিয়ান ল রিপোর্টস. পৃষ্ঠা-১৪৯ এ উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত রয়েছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে স্ত্রী আগে তালাক দিলে কি দেনমোহর দিতে হয় কি-না? স্ত্রী যেহেতু নিজ ইচ্ছা থেকে এবং নিজে উদ্যোগী হয়ে তালাক দিচ্ছেন, তাই তাঁর দেনমোহরের টাকা না দিলেও চলবে এটি ভুল ধারণা। মনে রাখতে হবে, স্বামী বা স্ত্রী যিনিই তালাক দিন না কেন, দেনমোহরের টাকা অবশ্যই স্ত্রীকে দিতে হবে। তবে বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দাম্পত্য জীবনযাপন না হলে কিংবা স্বামীর মৃত্যু হলে দেনমোহরের অর্ধেক পরিশোধ করা যাবে। স্ত্রী আগে মারা গেলেও দেনমোহর মাফ হয় না। স্ত্রীর উত্তরাধিকারীরা এই দেনমোহরের হকদার। তারাও মামলা করার অধিকার রাখে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে তালাকের পর কিভাবে দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করবেন। সহজ উত্তর, আপনি সরাসরি তাকে দেনমোহরের টাকা দিয়ে পরিশোধ লিখিয়ে নিতে পারবেন অথবা পোষ্ট অফিসের মাধ্যমে মানি অর্ডার যোগে আপনার স্ত্রীর বসবাসরত ঠিকানায় টাকা পাঠিয়ে দিতে পারবেন। আরেকটি পথ হচ্ছে, তালাকের পর চেয়ারম্যান যখন শালিশী পরিশোধে সমঝোতার ব্যবস্থা করবে, তখন সমঝোতার ভিত্তিতেও দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করিয়ে দিতে পারবেন। আর যদি তালাকের পর আপনি দেনমোহর পরিশোধ না করেন, তাহলে স্ত্রী কিন্তু দেনমোহর চেয়ে পারিবারিক আদালতে আপনার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারবেন। এ মামলায় আপনি নোটিশ প্রাপ্তির পর একজন আইনজীবীর মাধ্যমে মামলায় প্রতিযোগিতা চালিয়ে যেতে পারবেন নতুবা টাকা দেয়ার সদিচ্ছা থাকলে আদালতকে বলে দেনমোহরের টাকা স্ত্রীকে পরিশোধ করিয়ে দিতে পারবেন। অনেকের সদিচ্ছা না থাকায় মামলা প্রতিযোগিতা করে এবং মামলার ডিক্রির টাকা বেশী হলে সাধারণতঃ জেলা জজ আদালতে আপিল করে থাকেন। এখানে উল্লেখ্য যে, জেলা জজ আদালতের রায় হলেও আপনি আদালতের অনুমতিক্রমে দেনমোহরের টাকা কিস্তিতে পরিশোধ করতে পারবেন। তবে এতে তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীর দেনমোহরের টাকা তুলতে সময় ও কষ্ট দুটোই লেগেই যায়।

লেখক: আইনজীবী। বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক।