পর্যাপ্ত বিচারক ব্যতীত নতুন মাদক আইনের অভিনব বিধান যে কারনে অকার্যকর

বাংলাদেশের জনগনের স্বাধীনসত্তার সমৃদ্ধি লাভ করার জন্য এবং মানব জাতির প্রগতিশীল আশা আকাঙ্খার সাথে সংগতি রক্ষা করার জন্য জনগনের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি অক্ষুন্ন রাখার নিমিত্তে আমাদের পবিত্র সংবিধান রচিত হয়। সে কারনেই সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৮তে জনগনের জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনকে রাষ্ট্রের অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলে গণ্য করা হয়েছে। তাতে আরোগ্যের প্রয়োজন কিংবা আইনের দ্বারা নির্দিষ্ট অন্যবিধ প্রয়োজন ব্যতীত মাদক নিষিদ্ধ করার জন্য রাষ্ট্রকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। এমনকি মৌলিক অধিকার স্বরুপ আইনের কর্তৃত্ব ব্যতীত কোন মানুষের জীবনের অধিকার হতে বঞ্চিত করা যাবেনা মর্মে অনুচ্ছেদ ৩২ এ নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। মাদক মানুষের জীবন নষ্ট করে। সে প্রক্ষাপটে মাদকদ্রব্যে নিয়ন্ত্রণ, সরবরাহ ও চাহিদা হ্রাস, অপব্যবহার ও চোরাচালান প্রতিরোধে যুগোপযোগী করার জন্য নতুন মাদক আইন, ২০১৮ প্রণয়ন করা হয়। ১০ই ডিসেম্বর ২০১৮ ইং তারিখে উক্ত আইনের কার্যকারিতা দেওয়া হয়েছে।
মাদক অপরাধের গুরুত্ব অনুধাবনে দেশের যুবসমাজ ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে রক্ষার জন্য বঙ্গবন্ধুর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখহাসিনা ‘মাদকের বিরুদ্ধে, চলো যাই যুদ্ধে’ এই স্লোগানে এই দেশ ও জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেন এবং উপরোক্ত আইন প্রণয়ন করেন। আইনে সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ এ যা কিছু থাকুক না কেন কোন ব্যক্তি বা তদন্তকারী সংস্থার কোন সদস্য বা অন্য কোন ব্যক্তি মাদক অপরাধ বা ক্ষতিসংঘটন বা সংঘটনের প্রস্তুতি গ্রহণ বা তা সংঘটনে সহায়তা সংক্রান্ত কোন ঘটনার ভিডিও বা স্থিরচিত্রধারণ বা গ্রহণ করলে বা কোন কথাবার্তা বা আলাপ-আলোচনা টেপ রেকর্ড বাডিস্কে ধারণ করলে উক্ত ভিডিও, স্থিরচিত্র, টেপবাডিস্ক উক্ত অপরাধ বা ক্ষতি সংশ্লিষ্ট মামলা বিচারের সময় সাক্ষ্য হিসাবে গ্রহণযোগ্য হবে বলে নতুন আইনে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি কারো নিকট মাদক পাওয়া গেলে পুরাতন আইনের মতোই সেই ব্যক্তি ভিন্ন কিছু প্রমান করতে না পারলে এই আইন লংঘন করেছেন মর্মে ধরা হবে। তাছাড়া তদন্তের ক্ষেত্রেও নতুন মাদক আইনে বিশেষ বিধান রয়েছে। মাদক আইনের ৩১ ধারা অনুসারে কোন আসামী হাতেনাতে ধৃত হলে ৩০ দিনের মধ্যে সে তদন্ত শেষ করতে হয়। আর যদি হাতে নাতে ধৃত না হলে ৬০ কার্য দিবসের মধ্যে শেষ করতে হয়। আর যেখানে পলাতক আসামী ও হাতেনাতে ধৃত আসামী থাকে সে ক্ষেত্রে অবশ্যই ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে হয়। পরবর্তীতে আরো ১৫ দিন সময় সীমা বাড়ানোর সুযোগ রাখা হয়েছে। তদন্তকারী কর্মকর্তার গাফিলতির জন্য আইনে কড়াব্যবস্থা রাখা হয়েছে। উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ বা আদালতের নিকট এটা যদি প্রতীয়মান হয় যে, উক্ত কর্মকর্তা দায়িত্বে অবহেলা করেছে সেটা তার অদক্ষতা হিসেবে বিবেচনা করার বিধান রাখা রয়েছে। এই অদক্ষতা তার বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে লিপিবদ্ধ করা যাবে। ক্ষেত্র বিশেষে চাকরি বিধি অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
নতুন আইনে অনেকটা পুরাতন আইনের মতোই রাসায়নিক পরীক্ষকের স্বাক্ষরযুক্ত রাসায়নিক পরীক্ষার প্রতিবেদন মামলা দায়ের, তদন্ত, অনুসন্ধান, বিচার বা অন্য কোন প্রকার কার্য ধারায় সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। এমন কি রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য একাধিক পরীক্ষাগার স্থাপন করার কথা নতুন আইনে আছে।
আইনে মাদক অপরাধের জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল স্থাপনে বিচারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। যার কারণে আলাদা ট্রাইব্যুনাল ও নতুন আইনে দ্রুত গতিতে মাদক অপরাধের বিচারের জন্য এইদেশ স্বপ্ন দেখেছিল। আলাদা ট্রাইব্যুনাল হলে উক্ত ট্রাইব্যুনালের জন্য নতুন বিচারক ও পদ নিয়োগের সুযোগ হয়েছিল। যে সমস্ত আদালতের উপরে ইতিমধ্যে ৩০লক্ষাধিক মামলাবিচারাধীন আছে তাঁরা ব্যতীত অন্য বিচারক দ্রুতগতিতে মাদক অপরাধের বিচার করতে পারতো। কিন্তু পরবর্তীতে ২০২০ সনে উক্ত মাদক আইনে সংশোধন আনা হয় এবং মাদক আইনের অধীন মাদক সংক্রান্ত অপরাধ সমূহ অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী অন্য এখতিয়ার সম্পন্ন আদালত কর্তৃক বিচার্য হবে বলে সংশোধনী আনা হয়। এতে করে মাদক অপরাধের বিচারের জন্য যে নতুনত্ব আনা হয় তা উক্ত সংশোধনীতে পন্ড হয়।
আবার মাদক আইনের ৪৮ ধারায় বলা হয়, “এই আইনের অধীন মাদকদ্রব্য অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ৫(পাঁচ) বৎসরের অধিক কারাদণ্ড না হইলে, সংশ্লিষ্ট মামলার বিচার সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে নিষ্পন্ন হইবে এবং এইরূপ ক্ষেত্রে ফৌজদারী কার্যবিধির অধ্যায় ২২ এর বিধানাবলি, যতদূর সম্ভব, অনুসরণ করিতে হইবে।
একইভাবে মাদক আইনের ৪৯ ধারায় বলা হয়, “এখতিয়ার সম্পন্ন আদালতে মামলার বিচারকার্য আরম্ভ হইলে উহা শেষ না হওয়া পর্যন্ত অবিরাম চলিবে, তবে উক্ত আদালত যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হয় যে, ন্যায়বিচারের স্বার্থে বিচারকার্য মুলতবি করা একান্ত প্রয়োজন, তাহা হইলে স্বল্পকালীন সময়ের জন্য, যাহা তিনকার্য দিবসের অধিক হইবেনা, বিচারকার্য মুলতবি করা যাইবে।”
অর্থাৎ নতুন মাদক আইনে বিচার সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে হবে এবং ৩ (তিন) কার্যদিবসের বেশী মাদক আইনের বিচার মূলতবী রাখার সুযোগ নেই। মামলা অবিরাম চলার কথা আছে। কিন্তু বাস্তবে এই বিধানটি পর্যাপ্ত বিচারকের অভাবে এবং ইতিমধ্যে বিচারক ও মাদক ব্যতীত বর্তমান অন্য মামলা শেষ করার অনুপাত হিসাব করলে আইন আদালতে তা কোনভাবেই সম্ভব নয়। আবার মাদক আইনের ৫১ ধারায় আছে “ (১) বিচারের জন্য মামলা বিচারের জন্য মামলা প্রাপ্তির তারিখ হইতে ৯০ (নব্বই) কার্যদিবসের মধ্যে এখতির সম্পন্ন আদালত কর্তৃক মাদকদ্রব্য অপরাধের বিচার সমাপ্ত করিতে হইবে। (২) কোনো অনিবার্য কারণে উক্ত মেয়াদের মধ্যে কোনো বিচার সমাপ্ত করা সম্ভব না হইলে, এখতিয়ার সম্পন্ন আদালত কারণ লিপিবদ্ধ করিয়া অতিরিক্ত ৩০(ত্রিশ) কার্য দিবসের মধ্যে বিচার সমাপ্ত করিতে পারিবে এবং তৎসম্পর্কে সুপ্রীম কোর্টকে লিখিত ভাবে অবহিত করিবে, যাহার একটি অনুলিপি সরকারের নিকট প্রেরণ করিতে হইবে। (৩) উপ-ধারা (২) এ উল্লেখিত বর্ধিত সময়ের মধ্যেও যদি যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণে কোনো বিচারকার্য করা সম্ভব না হয়, তাহা হইলে এখতিয়ার সম্পন্ন আদালত উহার কারণ লিপিবদ্ধ করিয়া বিচারকার্য সমাপ্তির জন্য সর্বশেষ আরও ১৫(পনেরো) কার্যদিবস সময় বর্ধিত করিতে পারিবে এবং এইরূপ সময় বর্ধিতকরণ সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টকে লিখিত ভাবে অবহিত করিবে, যাহার একটি অনুলিপি সরকারের নিকট প্রেরণ করিতে হইবে। (৪) উপ-ধারা (৩) এর অধীন বর্ধিত সময়ের মধ্যে আবশ্যিক ভাবে বিচারকার্য সমাপ্ত করিতে হইবে।”
উপরের ধারাতে ও দ্রুতবিচারের বিধান সংযোজন করা হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট আইন পর্যালোচনা এটি পরিস্কার যে, মাদক আইন কার্যকর করা গেলে দেশের মানুষ সুফল পেতো। দেশের ভবিষ্যত উজ্জ্বল হতো। আমরা দেখি মাদকের ভয়াবহতায় দেশের যুবসমাজও কিশোররা মাদক গ্রহণে বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। কিশোর গ্যাং এই করোনার মধ্যেও দেশের একটি আলোচিত বিষয়। ইতিমধ্যে ই মামলার জট কমানোর জন্য বিচারকগণ কঠোর পরিশ্রম করছেন। ট্রাইব্যুনাল না হওয়াতে প্রায়ই ২ বৎসর মাদক আইনের বিচারকার্যক্রম স্থবির ছিল। আবার হঠাৎ করে মামলা বেড়ে যাওয়াতে প্রতিটি আদালতে মামলার পরিমান ৪/৫গুন বেড়ে গেছে। উদাহরন স্বরুপ কুমিল্লা সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট-১ম আদালতে প্রায়ই ১২০০ মামলা হতে নিস্পত্তির মাধ্যমে ৩৫০ থেকে ৪০০ মামলার আদালতে পরিণত হলেও হঠাৎ করে মাদক মামলার কারনে এবং করোনার কারনে এখন প্রায়ই ১৮০০ মামলার আদালতে পরিণত হয়েছে। এটা দিবালোকের মতো পরিস্কার বাংলাদেশের প্রায় সব ফৌজদারী আদালতের অবস্থা একই রকম। যার কারনে নতুন করে ট্রাইব্যুনালের জন্য বিচারক ও আনুষঙ্গিক পদ সৃজনের যে বিধান পূর্বে ছিল তা বাদ দেওয়াতে মাদক আইনে সংযোজিত অভিনব অনেক বিধান অনেকটাই অকার্যকর হয়ে গেছে। হয়তো বা মাননীয় সুপ্রীম কোর্ট হতে একটা ব্যাখ্যা আরো অনেক আইনের মতোই আসতে পারে যে, মাদক আইনের উপরোক্ত বিধান গুলো বাধ্যতামূলক নয়।
সংবিধানের অুনচ্ছেদ ৩৫ অনুসারে দ্রুতবিচার পাওয়া এদেশের প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার। সে কারনেই নতুন ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে যুগান্তকারী কিছু বিধান সংযোজনের মাধ্যমে জনগনের আশা আকাঙ্খা পূরণ এবং সংবিধানের বাধ্যবাধকতার আলোকে মাদক আইন, ২০১৮ প্রণীত হয়েছিল। কিন্তু পর্যাপ্ত বিচারক নিয়োগ ব্যতীত উক্ত আইন কার্যকর করা এবং মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সত্যিই দূরহ ব্যাপার।