কওমী মাদ্রাসা ও শিশু নির্যাতন: নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন নীতিমালা

খুরশিদ কামাল তুষার:

“মা গো তোমার একটি ছেলে মাদ্রাসাতে দিও, এই পৃথিবীর বুকে তুমি জান্নাত কিনে নিও”

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার একটি অন্যতম অনুষঙ্গ মাদ্রাসা শিক্ষা। এই মাদ্রাসা শিক্ষা পরিচালিত হয় দুটি ভিন্ন ধারায় বিভক্ত হয়ে। একটি সরকার স্বীকৃত ও ব্রিটিশ আমল থেকে চলমান ধারা যা আলীয়া মাদ্রাসা বলে পরিচিত। এ মাদ্রাসা ১৭৮০ সালে গর্ভনর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিসং কর্তৃক কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৭ সালে আলিয়া মাদ্রাসা কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়।২০০৬ সালে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়। আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা চালুর লক্ষ্য ছিল ধর্মীয় বিষয়ের পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়ে পাঠদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে গড়ে তোলা। ১৯৮৭ সালে আলিয়া মাদ্রাসার পাঠ্যক্রমে যুক্ত করা হয় মানবিক ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে গিয়ে এসব মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের আরবি সাহিত্য, হাদিস ও কোরান শরিফের মতো বিশেষায়িত বিষয় পড়ানো হয়ে থাকে। এ মাদ্রাসা সমুহ সরাসরি সরকার নিয়ন্ত্রিত এবং সরকারি আদেশবলে পরিচালিত হয়।

মাদ্রাসা শিক্ষার অপর ধারাটির উৎপত্তি ১৮৬৬ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশে দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। সরকারি মাদ্রাসা শিক্ষাকে একরকম চ্যালেঞ্জ করেই মসজিদ কেন্দ্রিক এই মাদ্রাসার উত্থান। এ মাদ্রাসাই বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসা নামে ব্যাপকভাবে পরিচিত, যা সম্পুর্ণ আবাসিক ও লিল্লাহ বোডিং। এ লিল্লাহ বোডিংগুলো পরিচালিত হয় মুসলমানদের স্বেচ্ছা অনুদান, যাকাত, ফিতরা ও কোরবানির চামড়ার টাকায়। কোন ধরণের সরকারি অনুদান এ মাদ্রাসাগুলো গ্রহণ করে না। অতি সম্প্রতি সরকার এ মাদ্রাসাগুলোকে স্বীকৃতি দিলেও তারা সরকারের আওতাধীণে যেতে আগ্রহী নয়। বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ, সংক্ষেপে বেফাক, হলো বাংলাদেশের কওমি মাদরাসা সমূহের সবচেয়ে বৃহত্তম বোর্ড। মরহুম মওলানা শাহ্‌ আহমদ শফি আমৃত্যু এ বোর্ডের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। এটি বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড নামেও পরিচিত।এটি ছাড়াও বাংলাদেশের কওমি মাদরাসা সমূহের ৫টি শিক্ষা বোর্ড আছে। এই শিক্ষা ব্যবস্থায় ইংরেজি-বাংলা, গণিত, বিজ্ঞান, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস ও দর্শনের মতো বিষয়গুলো পড়ানো হলেও কোরান ও হাদিস ছাড়া বাকি সব বিষয়েই মূলত প্রাথমিক পর্যায়ের ধারণা দেওয়া হয়। এর মধ্যে আবার রাষ্ট্রবিজ্ঞান, দর্শন ও ইতিহাস পড়ানো হয় ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। কিছু কিছু স্তরে বিজ্ঞান শিক্ষা অনুপস্থিত এবং ধর্মের বাইরের বিষয়গুলো ব্যাপকভাবে অবহেলিত। মাদ্রাসা বোর্ডগুলোর তথ্যমতে বাংলাদেশে বিশ হাজারের বেশি কওমী মাদ্রাসা রয়েছে। তবে এসব মাদ্রাসা সরকারি নিয়ন্ত্রণ তো দুরের কথা, কোন নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যেও নেই।
এ কওমী মাদ্রাসার প্রাক-প্রাথমিক স্তর হল হেফয-খানা যা হাফেজিয়া ক্বওমী দারুল উলুম মাদ্রাসা নামেও পরিচিত যেখানে কোরআন শরীফ মুখস্ত করানো হয়। এ মাদ্রাসাগুলোর অধিকাংশ ছাত্র হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান এবং এ সমস্ত শিক্ষার্থীর অভিভাবকরাও ততটা শিক্ষিত ও সচেতন নয়। অভিভাবকরা মাদ্রাসার কঠোর শাসনকে মেনে নিয়েই তাদের সন্তানকে পাঠায়। ওস্তাদ ছাত্রকে শরীরের যে স্থানে প্রহার করে, শরীর সে অংশ বেহেস্তে যায় এমনও কুসংস্কারে তাঁরা বিশ্বাস করে। আর এ কারণে বিনা জবাবদিহিতায় শাসন প্রায়শঃই বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যায়। কারণে অকারণে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বেদম প্রহার করা হয়। এ সমস্ত ঘটনা খুব একটা প্রকাশিত হয় না। অতি সম্প্রতি কিছু মাদ্রাসায় শিশু বলাৎকার এর মত ঘৃণ্য অপরাধের কথাও বেরিয়ে এসেছে। ২০১০ সালের শিক্ষানীতির অধিনে আলিয়া মাদ্রাসা অন্তর্ভুক্ত হলেও কওমী মাদ্রাসা সম্পুর্ণ স্বাধীন হওয়ায় মাদ্রাসার পাঠ্যক্রম ও শিক্ষক প্রশিক্ষণের সুনির্দিষ্ট কোন নীতিমালা নেই।

বাংলাদেশে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিলে বাকি সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারের নীতির অনুগত। সেজন্য শিক্ষার্থীকে মারধর বা নির্যাতন না করার ব্যাপারে সমস্ত আইন ও নীতিমালা মেনে চলতে হয় এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমুহকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী যাতে নির্যাতনের স্বীকার না হয় এজন্য সুনির্দিষ্ট কিছু আইন ও নীতিমালা রয়েছে।
১৯৭৯ সালের শিক্ষক আচরণবিধিতে বাচ্চাদের মারধর না করার নির্দেশ রয়েছে। শিশু আইন অনুযায়ী ৯ বছর বয়স পর্যন্ত কোন শিশুকে শাস্তি দেয়া সম্পুর্ণ নিষিদ্ধ। শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষকদের শারীরিক নির্যাতন প্রতিরোধে সরকারের ক্রমাগত ব্যর্থতা কে চ্যালেঞ্জ করে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এবং বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ১৮ জুলাই, ২০১০ সালে একটি রীট পিটিশন দায়ের করে (রীট পিটিশন নং-৫৬৮৪/২০১০)। এই রীট আবেদনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট বিভাগ ১৩ জানুয়ারি,২০১১ স্কুল এবং মাদ্রাসায় সব ধরণের শারীরিক শাস্তি প্রদান অসাংবিধানিক ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন বলে রায় প্রদান করেন। রায়ে আদালত মোট আটটি নির্দেশনা সহ উল্লেখ করেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থীদের কন রকম শারীরিক শাস্তি এবং নিষ্ঠুর অমানবিক অপমানকর আচরণ শিক্ষার্থীদের জীবন ও ব্যাক্তি স্বাধীনতার সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করে। বিশেষত তা বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭,৩২,৩৫(৫) অনুচ্ছেদ ও মানবাধিকারের পরিপন্থী।

এ রায়ের প্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রনালয় ২১ এপ্রিল,২০১১ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সব ধরণের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি নিষিদ্ধ করে “শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি রহিত করা-সংক্রান্ত নীতিমালা,২০১১” জারি করে যা প্রাথমিক, মাধ্যমিক, নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ, কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসা সহ দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য। এ নীতিমালায় শারীরিক ও মানসিক শাস্তি সংজ্ঞায়িত করে নীতিমালা পরিপন্থী কাজের জন্য শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী, শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত কোন ব্যাক্তি শিক্ষার্থীদের কোন প্রকার শারিরীক বা মানসিক শাস্তি দিলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এসব অপরাধের সাথে কারো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তা সরকারী কর্মচারী আচরণ বিধিমালা, ১৯৭৯ এর পরিপন্থী হবে এবং ঐ ব্যাক্তির বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপীল) বিধিমালা, ১৯৮৫ অনুযায়ী ব্যাবস্থা নেয়া যাবে। তবে যাদের ক্ষেত্রে এ আইন প্রযোজ্য নয়, তাদের ফৌজদারি আইনে শাস্তি দেয়া যাবে।
বর্তমান সময়ে মাদ্রাসায় শিশু নির্যাতন উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে যা নিঃসন্দেহে সমাজ ও দেশের জন্য একটি বড় ধরণের চিন্তার বিষয়। অল্প শিক্ষিত হতদরিদ্র অভিভাবকরা বলতে গেলে একরকম মন্ত্রঃপুত অবস্থায় থাকায় এসব নির্যাতনের ব্যাপারে অবচেতন এবং প্রতিবাদ করে না কিংবা করতে চাইলেও সঠিক উপায় পাচ্ছে না। এজন্য স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের নামের আড়ালে তাঁরা যে ধরণের ঘৃন্য কাজ চালিয়ে যাচ্ছে তার প্রতিকারও হচ্ছেনা। মাদ্রাসার ব্যাপারে যে ধরণের নির্মম অত্যাচার বা শাস্তির খবর পাওয়া যায়, বাংলাদেশের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তা সচরাচর হয় না। এর অন্যতম কারণ প্রতিষ্ঠানগুলো সরকার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং শিক্ষকদের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদান করে। তাই অধিকাংশ শিক্ষককেই ছাত্রবান্ধব বলা যায়।
অতএব এসব স্পর্শকাতর বিষয়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের সময় এখনই। কওমী মাদ্রাসা সরকারের আওতায় যদি নাও আসে, সরকারের উচিত যত দ্রুত সম্ভব উপযুক্ত নীতিমালা প্রনয়ন করে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া এবং মাদ্রাসাগুলো নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রেখে শিশুশিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা। এছাড়া ইতিপুর্বে সংঘটিত নির্যাতন অপরাধের দ্রুত ও কার্যকরী বিচার সম্পন্ন করতে হবে, অভিভাবক মহলকে সচেতন করতে হবে। সকল মাদ্রাসায় ছাত্রবান্ধব পরিবেশে শিক্ষা আদান প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। নতুবা লোকচক্ষুর আড়ালে অনেক নির্মম ঘটনা ঘটতেই থাকবে।।

বন্ধ হোক শিক্ষার্থী নির্যাতন। সুশিক্ষার আলোয় কুসংস্কারমুক্ত হোক আমাদের সমাজ।।

তথ্যসুত্রঃ ১) বিবিসি বাংলা ;
২) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক শাস্তি প্রদান প্রতিরোধ বুকলেট, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)।

লেখক: এল এল, বি (স্নাতক) তৃতীয় বর্ষ, আইন বিভা‌গ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।