মো: সালাউদ্দিন সাইমুম, সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

গণহত্যা: একটি সরল পর্যালোচনা

মো: সালাউদ্দিন সাইমুম:

মানবসভ্যতার সূচনালগ্ন হতেই গণহত্যার ভয়াবহতা জনমানুষকে ব্যথিত করেছে, হৃদয় বিগলিত করেছে, মানবতাকে ভুলুণ্ঠিত করেছে। যুগে যুগে মানুষ মানুষকে হত্যা করেছে, এক জাতি আর এক জাতিকে নির্মূল করেছে, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় সংখ্যালঘুদের ওপর অবর্ণনীয় নিপীড়ন চালিয়েছে। মোটা দাগে বলতে গেলে গণহত্যার রথ কখনই শ্লথ হয়নি। অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে ‘জেনোসাইড’ শব্দটাই কারুর জানা ছিল না।

আমরা ‘জেনোসাইড’ শব্দটি পেয়েছি ১৯৪৪ সালে পোলিশ আইনজীবী রাফায়েল লেমকিনের কাছে। হিটলারের নাৎসী বাহিনীর গণহত্যার ভয়াবহতার নিখুঁত চিত্রায়ণ তিনি তার বিখ্যাত বই ‘এক্সিস রুল ইন অকুপাইড ইউরোপ’-এ করেছেন। সেই দীর্ঘ লেখনীতেই সর্বপ্রথম লেমকিন ‘জেনোসাইড’ শব্দগুচ্ছটির অবতারণা করেন। চিরপুরাতন ধারণাটি প্রথমবারের মতো এক সুষ্পষ্ট প্রত্যয়ে আবদ্ধ হলো। আমরা আজ বাংলায় যে ‘গণহত্যা’ প্রত্যয়টি ব্যবহার করি সেটি সেই লেমকিনের ‘জেনোসাইড’ প্রত্যয়েরই স্বীকৃত বঙ্গানুবাদ। লেমকিনের সেই জেনোসাইড শব্দগুচ্ছটি বলতে নিছক গণহত্যাকেই কিন্তু বোঝায় না, এটি অনেক বৃহত্তর এক প্রত্যয়।

লেমকিন ‘জেনোসাইড’ শব্দটি কুড়িয়ে নিয়েছেন দুটো শব্দ থেকে। একটি গ্রীক শব্দ ‘জেনোস’ আর অপরটি ল্যাটিন শব্দ ‘সাইড’ হতে। গ্রীক শব্দ ‘জেনোস’ অর্থ গোত্র,গোষ্ঠী,জাতি আর ল্যাটিন ‘সাইড’ অর্থ হত্যাকাণ্ড। লেমকিনের ভাষায় কোনো জনগোষ্ঠীকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ধ্বংস বা নির্মূলকরণের সকল অপপ্রয়াসই গণহত্যা। তার ভাষায় গণহত্যার অর্থ হচ্ছে কোন গোষ্ঠিকে পুরোপুরি কিংবা তাদের কোন একটি খণ্ড বা অংশকে ধ্বংস করা।

হিটলার তার কুখ্যাত গ্যাস চেম্বারে ভরে যে লক্ষ-লক্ষ নিরীহ ইহুদীদের হত্যা করেছেন সেই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের বিভীষিকাই ‘জেনোসাইড’ তথা গণহত্যা শব্দটির আগমনকে ত্বরাণ্বিত করেছে। হিটলারের নারকীয়তা থেকে রক্ষা পায়নি লেমকিনের পরিবার। তার পরিবারের ৪৯ জন সদস্য হিটলারের ইহুদী নিধনযজ্ঞ (হলোকাস্ট) তথা ফাইনাল সলুশনের বলি হন। হিটলার প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদীকে হত্যা করে যে ভয়াবহ নারকীয় গণহত্যার দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন মানবজাতি আজও তা স্মরণ করলে মর্মাহত হয়ে পড়ে।

অতি সম্প্রতি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মিয়ানমার সামরিক জান্তাদের দ্বারা নির্মম গণহত্যার শিকার হয়। রোহিঙ্গাদের এরূপ নির্মূলকরণকে কেউ কেউ জাতিগণ নিধন হিসেবেও অভিহিত করেছেন। একটু ইতিহাসে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে আমরা সহসাই দেখতে পাবো যে, একাত্তরে আমরা বাঙালীরাও নজিরবিহীন নির্মম গণহত্যার শিকার হয়েছি। সেদিন হানাদার পাক-বাহিনীর বর্বরতা ও পৈশাচিকতা পৃথিবী অবলোকন করেছিল। ত্রিশ লক্ষ বাঙালীকে হত্যা করা হয়েছিল যেটিকে পৃথিবীর ইতিহাসে বর্বরতম গণহত্যার দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে।

একাত্তর পরবর্তী পচাত্তরেও আমরা গণহত্যার দৃষ্টান্ত খুঁজে পাই। কম্বোডিয়ায় খেমাররুজ শাসনামলে প্রায় ১৭ লক্ষ মানুষের প্রাণ যাওয়ার ঘটনাকে ‘গণহত্যা’ বলে রায় দিয়েছে সে দেশের জাতিসংঘ সমর্থিত এক আদালত৷ ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সালের মধ্যে সেই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল। ‘পল পট’ শব্দটির অর্থ ‘বড় ভাই’। অথচ সেই তথাকথিত বড়ভাই নরঘাতক পল পট সেসময় কম্বোডিয়ার এক-চতুর্থাংশ মানুষকে হত্যা করেছিলো বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। হিটলারের মতো পল পটের শেষটাও তাই শুভকর হয়নি, সেও আত্মহননের পথ বেছে নেয়।

প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ করতেই হয় যে, একাত্তরে বাংলাদেশে যে নারকীয় গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল তার পেছনেও এক ‘বড় ভাই’-এর হাত খুঁজে পাওয়া যায় যিনি পাক-হানাদারদের ঘনিষ্ঠ মিত্র ও সহযোগী হিসেবে জঘন্য ভূমিকা রেখেছিলেন, তিনি সেই কুখ্যাত কিসিঞ্জার, পুরো নাম হেনরি কিসিঞ্জার, যিনি একদা বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন! ওহে কিসিঞ্জার আসুন দেখে যান, আজ বাংলাদেশ কোথায় আর আপনার প্রিয় পাকিস্তান কোথায়?

গণহত্যা আজ আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে একটি সুনির্দিষ্ট অপরাধ। ১৯৪৮ সালে আমরা গণহত্যা বিরোধী কনভেনশন পাই। যেখানে গণহত্যার আইনী সংজ্ঞায়ন করা হয়েছে যা আজ পুরো বিশ্ব মেনে চলে।

গণহত্যা বিরোধী কনভেনশন, ১৯৪৮ এর দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে সুষ্পষ্টভাবে বলা হচ্ছে যে-

জাতিগত, বর্ণগত, গোত্রগত, নৃতাত্ত্বিক বা ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে কোনো মানবগোষ্ঠীর পুরোপুরি বা আংশিক ধ্বংসসাধন গণহত্যা হিসেবে অভিহিত হবে। লেমকিনের ধারণার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ ধারণার দৃষ্টান্ত আমরা এখানেও খুঁজে পেলাম।

এছাড়া অত্র কনভেনশনে গণহত্যার সংজ্ঞায়নের ক্ষেত্রে আরও বেশ কিছু বিষয় সংযোজিত করা হয়। শুধুমাত্র কোনো নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠীকে হত্যা করাই গণহত্যা নয়; অত্র কনভেনশন অনুসারে, কোনো নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠীকে জোরপূর্বক জন্মনিয়ন্ত্রণে বাধ্য করাও গণহত্যার শামিল বলে গন্য হবে। এছাড়া কোনো এক জনগোষ্ঠীর সন্তানাদিকে অপর কোনো জনগোষ্ঠীর নিকট বলপূর্বক হস্তান্তরও গণহত্যার আওতায় আসবে।

আবারও গণহত্যার ভয়াবহতার দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। খুব বেশিকাল আগের কথা না আপনাদের নিশ্চয়ই মনে পড়বে চুরানব্বইয়ের রুয়ান্ডা গণহত্যার ভয়াবহতার কথা। ১৯৯৪ সালের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত মাত্র ১০০ দিনের ব্যবধানে সেই গণহত্যায় প্রাণ হারিয়েছিল রুয়ান্ডার প্রায় আট লাখ তুতসি জনগোষ্ঠী। উল্লেখ্য, ২০০৩ সাল পর্যন্ত চলা এ গণহত্যায় প্রায় ৫০ লাখের বেশি মানুষ মারা গেছে। বলে রাখা ভালো, রুয়ান্ডার মানুষ তাদের সামাজিক আদালত ‘গাসাসা’য় গণহত্যাসংশ্লিষ্ট প্রায় ১২ লাখ মামলার বিচার করে। হুতু-তুতসির সেই গৃহযুদ্ধে হুতুদের সহায়তা করেছিলো ফ্রান্স এবং আফ্রিকান কিছু দেশ। আর তুতসিদের পাশে ছিলো উগান্ডা। ক্ষমতায় থাকা হুতুদের উদ্দেশ্য ছিলো তুতসি সম্প্রদায়কে চিরতরে রুয়ান্ডা থেকে মুছে ফেলা। তাই তাদের নির্বিচার হত্যাকাণ্ড থেকে বাদ যায়নি অসহায় তুতসি শিশু এবং নারীরাও। উল্লেখ্য, রুয়ান্ডায় ১৯৯৪ সালে সংঘটিত গণহত্যার দায় স্বীকার করে অতি সম্প্রতি ক্ষমা চেয়েছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাঁক্রো।

গণহত্যার পৈশাচিকতার রেশ আজও বহমান। আজও গণহত্যা চলমান, পৃথিবী আজও প্রত্যক্ষ করছে দুর্বল-অসহায় ফিলিস্তিনিদের আর্তনাদ, উইঘুর মুসলিম নিধনযজ্ঞ, রোহিঙ্গাদের হাহাকার! একুশ শতকের এ যুগে এসেও আমরা সার্বজনীন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। পৃথিবীতে আজ গুটিকতক পেশীশক্তিতে বলীয়ান আধিপত্যবাদী শক্তির জয়জয়কার। মানবতা আজও ডুকরে কাঁদছে। জাতিসংঘ আজ নখদন্তহীন বাঘের মতো আচরণ করছে। বিশ্বশান্তি আজ সুদূর পরাহত।

তথ্যঋণ-

১. Genocide: A Comprehensive Introduction, Adam Jones

২. An Introduction to International Criminal Law and Procedure, Robert Cryer

৩. জেনোসাইড নিছক গণহত্যা নয়, মফিদুল হক

৪. বাংলাদেশে গণহত্যা ও ন্যায়রথের অভিযাত্রা, মফিদুল হক

লেখক- সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।