চন্দন কান্তি নাথ

সাক্ষ্য ও জেরাতে সাক্ষ্য আইনের যে বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ

চন্দন কান্তি নাথ:

সাক্ষ্য আইন গুরুত্বপূর্ণ আইন। দেওয়ানী ও ফৌজদারী আইনে বিচার ব্যবস্থায় সাক্ষ্য আইন ভালোভাবে প্রয়োগ হয়। এটা দ্বারা আদালত পরিচালিত হয়। ১৮৭২ সনে স্যার জেমস স্টিফেন এই আইন প্রণয়ন করেন। জেরা জবানবন্দি করার আগে বিষয় ও বিচার্য বিষয, সাক্ষ্য ও তার প্রাসঙ্গিকতা এবং কোন বিষয় প্রমাণিত হলো কিনা বা অপ্রমাণিত থেকে গেল বা প্রমাণিত নয় ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকতে হয়। আর আদালত কোন ক্ষেত্রে অনুমান করতে পারে (May presume)।আর কোনো ক্ষেত্রে অবশ্যই অনুমান করবেন (Shall Presume)। আবার আদালত কোন ক্ষেত্রে কোন বিষয়কে আদালত চুড়ান্ত প্রমাণ হিসেবে ধরে নেন (Conclusive proof)। তাই অনুমান বিষয়ে ও পরিষ্কার ধারণা থাকতে হয়। আর সম্পূর্ণ সাক্ষ্য আইন অনেকটাই এই বিষয়গুলোর ওপর নির্ভরশীল। উক্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে ভাল ধারণা থাকলে জেরার শুধু সময় নষ্ট হয় না। বিষয়( Fact) বলতে সাক্ষ্য আইনে বুঝানো হয়েছে যে কোন জিনিস, জিনিসের অবস্থা বা জিনিসের সম্পর্ক যাহা বোধগম্য হয়। কোন মানসিক অবস্থা -যার সম্পর্কে কোন ব্যক্তি সচেতন তাও বিষয় হতে পারে। যেমন কোন জিনিস কোন জায়গায় কিভাবে সাজানো হয়েছে তাও একটি বিষয়। বই আলমিরাতে সুন্দরভাবে সাজানো আছে বা করিম একটি বিষয় সম্পর্কে শুনেছে বা দেখেছে বা বলেছে,যা বিষয় হতে পারে।করিম একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে মত পোষণ করল, একটি কাজ করার ইচ্ছা আছে, সরল বিশ্বাসে কোনো কাজ করলো, প্রতারণামূলকভাবে কোন কাজ করল,কোন একটি নির্দিষ্ট বাক্য নির্দিষ্ট অর্থে ব্যবহার করল,বিশেষ কোনো সময়ে কোন বিশেষ অনুভূতি সম্পর্কে সচেতন আছে বা ছিল,করিমের অনেক খ্যাতি আছে -সবগুলোই বিষয়( Fact)। অর্থাৎ পাচঁ ইন্দ্রিয় -চোখ, কান, নাক, জিভ ও ত্বক দ্বারা যা অনুভব করা যায় কিংবা যা মানসিক সচেতনতা- তাই বিষয়।সে কারনে বিষয় শারীরিক বা মানসিক হতে পারে।

যেকোনো বিষয় নিয়ে যে কেউ বলতে পারে। কিন্তু সবাই প্রাসঙ্গিক বিষয় চাই। এমনকি দুটি বিষয় নিয়ে কেউ বললে একটি বিষয়ের সঙ্গে অপরটির প্রাসঙ্গিকতা থাকতে হয়। সাক্ষ্য আইন এর ধারা ৬-৫৫ অনুসারে আদালতে বিচার্য বিষয়ের (Facts in issue and law) সংগে সম্পর্কিত প্রাসঙ্গিক বক্তব্য দিতে হয়। বিচার্য বিষয়ের একটা উদাহরণ দেয়া যায়।যেমন করিমের বিরুদ্ধে রহিমকে হত্যা করার মামলায় এজাহার হল।যথারীতি পুলিশ রিপোর্ট হল। অপরাধ আমলে গ্রহন করা হল।অভি্যোগ গঠিত হল।

বিচার কালে করিম রহিমের মৃত্যু ঘটিয়েছে, করিমের রহিমকে মারার ইচ্ছা ছিল,করিম রহিমের নিকট হতে গুরুতর আকস্মিক উস্কানি পেয়েছিল,করিম সে সময় মানসিক বিকারগ্রস্ত ছিল এবং তাই সে যে রহিমের মৃত্যু ঘটিয়েছে সেটা বুঝতে পারেনি ইত্যাদি সবকিছু প্রাসঙ্গিক বিচার্য বিষয়।বিচার্য বিষয় দুই ধরনের হয় যথা তথ্যগত (Facts in ussue) এবং আইনগত (Facts in law) তবে দেওয়ানি কার্য বিধি আইনের ক্ষেত্রে ১৪ আদেশের ১ বিধি অনুসারে যখন কোন ঘটনা আইনের গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতি এক পক্ষ দৃড়ভাবে ঘোষণা করে এবং অপর পক্ষ অস্বীকার করে,তখনই বিচার্য বিষয় উদ্ভব হয়।বিচার্য বিষয়ের ক্ষেত্রেই আদালত সাক্ষ্য নেয়।

সাক্ষ্য আইনে দুই প্রকারের সাক্ষ্য এর কথা বলা আছে যথা মৌখিক সাক্ষ্য এবং দালিলিক সাক্ষ্য। আদালত সাক্ষিকে কোন ঘটনার বিচার্য বিষয়ে যে প্রাসঙ্গিক বক্তব্য দিতে দেন বা আদালতের সাক্ষির যে প্রাসঙ্গিক বক্তব্য প্রয়োজন, তা যদি সাক্ষি মৌখিকভাবে দেন তাকে মৌখিক সাক্ষ্য বলে। দালিলিক সাক্ষ্য এর আগে দলিল কি জানা যাক। কোন তথ্য বা ব্যাপার সংরক্ষণের জন্য ইচ্ছা পোষণ করে কোন বস্তুতে কোন কিছু অক্ষর,সংখ্যা বা চিহ্ন দিয়ে প্রকাশ বা বর্ণনা করা হলে বা উক্ত রুপ একের অধিক উপায়ে প্রকাশ বা বর্ণনা করা হলে তাকে দলিল বলা হয়। আইনে বলে হয়েছে, ‘Documents means any matter expressed or described upon any substance by means of letters, figures or marks, or by more than one of those means,intended to be used,or which may be used, for the purpose of recording that matter.’

সে কারনে লিখন মাত্রই দলিল। মুদ্রিত ও লিথোগ্রাফকৃত বা ফটোগ্রাফিকৃত শব্দ দলিল।কোন মানচিত্র বা নঁকশা বা কোন ধাতু খন্ড বা প্রস্তরখন্ডের উপর কিছু খোদাই করা হলে তা দলিল।এমনকি ব্যঙ্গচিত্র ও দলিল। তবে সকল দলিল দালিলিক সাক্ষ্য নয়। বরং যে সকল দলিল আদালত কতৃক পরিদর্শনের জন্য উপস্থাপন করা হয় তাই দালিলিক সাক্ষ্য।

আবার কিছু বিষয় আছে যা ঠিক সাক্ষ্যের পর্যায়ে পড়ে না। অথচ সিদ্ধান্তে উপনীত হবার জন্য আদালত সেগুলো বিবেচনা করতে পারেন। যেমন সাক্ষ্য গ্রহণের পর আদালত ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারা বিধান মতে আসামিকে বক্তব্য রাখার সুযোগ দেন। আদালত আসামির এ বিবৃতি বা বক্তব্য বিবেচনা করেন। ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ৩৬৩ ধারা এবং দেওয়ানী কার্যবিধির ১৮ আদেশের রুল ১২ অনুসারে অনেক সময় সাক্ষীর হাবভাব হতে সত্য বাহির হয়ে আসে। এক্ষেত্রে তা আদালত লিপিবদ্ধ করে রাখেন। দেওয়ানী কার্যবিধির ২৬ আদেশের রুল ৯ এবং ১৮ আদেশের ১৮ অনুসারে আদালত অনেক সময় তদন্ত বা পরিদর্শন করতে পারেন। ফৌজদারী কার্যবিধির ২৯৩ এবং ৫৩৯ ধারায় একই রূপ অধিকার আদালতকে দেওয়া হয়েছে। এরূপ তদন্ত বা পরিদর্শনের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সাক্ষ্য না হলেও এর মূল্য অপরিসীম। আবার সাক্ষ্য আইনের ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে অনেক বিষয়ে আদালত প্রমাণের ক্ষেত্রে সত্য বলে গ্রহণ করবেন। শুধুমাত্র গেজেট থেকে আদালত এগুলো সত্য বলে মেনে নিবেন। আবার চুরির মামলায় যে চোরাই মালামাল পাওয়া গেছে আদালত তা দেখতে পারেন, খুনের মামলায় যে অস্ত্র দিয়ে খুন করা হয়েছিল, আদালত তা দেখতে পারেন। এগুলো সাক্ষ্য হিসেবে আসে না তবে এগুলো ঘটনার আলামত। এগুলোকে বস্তুর প্রদর্শনী হিসেবে রাখা হয়। যা আদালতকে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সাহায্য করে। আবার আরেক প্রকার সাক্ষ্য আছে যাকে পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য বলা হয়। উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত মোতাবেক অবস্থাগত সাক্ষ্য এর সংজ্ঞা নিন্মরুপ- ‘Circumstantial evidence is an indirect mode of proof by drawing inference from facts closely connected to the fact in issue.’

আবার প্রমাণিত (Proved), অপমানিত (Disproved), প্রমানিত নয় (Not Proved) এ বিষয়গুলো একত্রে বিশ্লেষণ করা দরকার। আদালতে যখন কোন বিষয় তোলা হয়, আদালত তার অবস্থা, অস্তিত্ব ইত্যাদি বিবেচনা করে দেখেন। প্রমাণিত হয়েছে তখনই বলা চলে যখন তর্কিত বিষয়ের অস্তিত্ব নিশ্চিত বলে বিশ্বাস জন্মে। কিংবা একটি মামলায় উপস্থিত প্রেক্ষাপটের পরিপ্রেক্ষিতে তর্কিত বিষয়ের অস্তিত্ব এতই সম্ভব মনে হয় যে,তাতে কোন জ্ঞানবান (Prudent man) লোকের সন্দেহ থাকার উপযুক্ত কারণ অবশিষ্ট থাকে না।

আইন বলছে, ‘A fact is said to be proved when,after considering the matters before it,the court either believes it to exist,or considers its existence so probable that a prudent man ought, under the circumstances of the particular case,to act upon the supposition that it exists.’  উচ্চ আদালতের একটি মামলায় বলা হয়, ‘Disproved’ is merely the converse of the defintion of Proved’  একটি বিষয় অপ্রমাণিত হয়েছে তখনই বলা চলে যখন আদালত বিবেচনা করে দেখেন যে,এর অস্তিত্ব থাকতে পারে না বা অস্তিত্ব নেই এবং কোন জ্ঞানবান (Prudent man) লোক সে পরিস্থিতিতে তার অস্তিত্ব নেই ভেবে কাজ করত। আবার যখন কোন তর্কিত বিষয় ‘প্রমাণিত’ বা ‘অপ্রমাণিত’ হয়নি , তখন ‘প্রমানিত নয়’ বলা হয়।

আবার সাক্ষ্য আইন মোতাবেক আদালত তিন প্রকার অনুমান করতে পারেন। আদালত কোন বিষয় সত্য গণ্য করতে পারেন,আবার অসত্য ও গণ্য করতে পারেন।এটিকে আইনের ভাষায় May Presume হিসেবে ধরা হয়। এ অনুমানের বিষয় সাময়িক ও খন্ডন যোগ্য। যেমন সাক্ষ্য আইনের ৮৬ ধারা হতে ৮৮ ,৯০ এবং ১১৪ ধারায় এরুপ অনুমানের বিষয় আছে।

কোন ক্ষেত্রে আইনে অবশ্যই অনুমান (Shall Presume) করতে হবে বলেছে। সেখানে কোন বিষয় আদালত সঠিক বলে মেনে নিতে বাধ্য।কিন্তু বিষয়টি মিথ্যা প্রমাণিত হলে এই অনুমানের বাধ্যবাধকতা থাকে না। তাই এটিও খণ্ডনীয় অনুমান। সাক্ষ্য আইনের ৭৯ হতে ৮৫,৮৯ এবং ১০৫ ধারা এরুপ অনুমানের উদাহরণ। তবে যেখানে চুড়ান্ত প্রমাণ (Conclusive Proof) বলা হয়,সেখানে সে বিষয়টিকে সঠিক বলে মেনে নেওয়া ছাড়া আদালতের আর কোন উপায় থাকে না।তাই এই অনুমান অখন্ডনযোগ্য। সাক্ষ্য আইনের ৪১,১১২ এবং ১১৩ ধারা এই অনুমানের অন্তর্ভুক্ত। এক্ষেত্রে আদালত কোন বিষয়কে সঠিক প্রমানিত বলে গণ্য করবেন,যতক্ষণ পর্যন্ত তা মিথ্যা প্রমাণিত না হয়। আর উপরোক্ত বিষয়ে ভালো ধারণা থাকলেই ভালো জেরা জবানবন্দি নেয়া যায়।

লেখক- সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কুমিল্লা।