অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

সারা জীবনের অর্জন দিয়ে ভুল জমি কিনছেন না-তো?

সিরাজ প্রামাণিক:

আপনার যারা সারা জীবনের অর্জন দিয়ে এক টুকরো জমি কিনে নীড় গড়ার স্বপ্ন দেখেন কিংবা সদ্য বিদেশ ফেরত টাকাওয়ালা কিংবা সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের জন্য আজকের এ নিবন্ধটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দালাল বা প্রতারকচক্র এসে আপনাকে সস্তায় ভাল জমির খবর দেবেন এবং জমি যাতে হাত ছাড়া না হয় তার জন্য আপনাকে দ্রæত বায়না কিংবা রেজিষ্ট্রি করে মূল্য পরিশোধ করার বিষয় তাগিদ দিবেন। কিন্তু কেনার পর আপনি দেখবেন বিক্রেতা ওই জমির প্রকৃত মালিক হিসেবে দখলকার ছিলেন না কিংবা ওই জমি নিয়ে অন্য অংশীদারদের সঙ্গে দীর্ঘদিনের বিবাদ চলেছে কিংবা বিক্রেতা ইতিপূর্বে তার সবটুকু অংশ বিক্রি করে দিয়েছে। ফলে তার বিক্রি যোগ্য কোনো স্বত্ব নেই কিংবা জমিটি অর্পিত সম্পত্তি কিংবা সরকার কর্তৃক হুকুম দখলকৃত জমি কিংবা যে ওয়ারিশ সূত্রে বিক্রেতা মালিকানা দাবি করেছে তা উপযুক্ত আদালত কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কাজেই এজমালি সম্পত্তি বা শরিকানা সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন আবশ্যক।

শরীক ফাঁকি দেয়া, ফারায়েজের অংশ নিয়ে লুকোচুরি খেলা, জমি ক্রেতাকে ভুল তথ্য দেয়া বাঙালীর রক্তের সাথে মিশে আছে। তাই এজমালি সম্পত্তি ক্রয়ের পূর্বে ওয়ারিশান সনদপত্র যাচাই করে নিন। যা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান কর্তৃক ইস্যু করা হয়। এজমালি সম্পত্তি বিক্রেতার নিজ নামে নামজারি বা মিউটেশন হয়েছে কি-না, দেখে নিন। যদি না থাকেন, তাহলে দেখে নিন বিক্রেতার পূর্ব পুরুষ অর্থাৎ বিক্রেতা যার ওয়ারিশ হিসেবে সম্পত্তি প্রাপ্ত হয়েছেন তার নামে রেকর্ড হাল খতিয়ান আছে কি-না। যদি থাকে তাহলে দেখে নিন বিক্রেতার ফারায়েজমত প্রত্যেক দাগে প্রাপ্ত বিক্রয়যোগ্য অংশ। আর যদি কোন এজমালি সম্পত্তির লিখিত বাটোয়ারা দলিল থাকে, তবে তা অবশ্যই রেজিস্ট্রি হতে হবে এবং তিনি দলিলে যে পরিমান সম্পত্তি পেয়েছেন শুধু সেটুকুই বিক্রি করতে পারবেন। পাশাপশি আপনাকে দেখে নিতে হবে যে, যৌথ ইজমেন্ট সুবিধা আছে কি-না। অর্থাৎ পথের অধিকার, চলার অধিকার, আলো বাতাস ও পানির অধিকার। সেই সাথে দেখতে হবে যে, ওই জমি ক্রয়ের পর প্রিয়েমশান বা অগ্রক্রয় বা শুফা অধিকার প্রয়োগের মামলা হবার সম্ভাবনা আছে কি-না। সেকারণ এরুপ এজমালি সম্পত্তি ক্রয়ের ক্ষেত্রে বায়নানামা দলিল কিংবা সাফকবলা দলিলে যতদূর সম্ভব অন্যান্য ওয়ারিশানগণকে সাক্ষী ও সনাক্তকারী হিসেবে রাখা উচিৎ। তাহলে অন্যান্য শরীক বা সহ-শরীকগণ এ সুযোগ আর গ্রহন করতে পারবে না। পাশাপাশি এ জাতীয় এজমালি সম্পত্তির বিক্রয় চুক্তি হবার পর সম্পত্তির উপর নোটিশ টাঙানো এবং পত্রিকায় আইনগত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে পারেন।

এজমালি সম্পত্তি বাদে অন্যান্য জমি ক্রয়ের পূর্বে দেখে নিন যে, ১। জমি বিক্রেতার প্রকৃত মালিকানা স্বত্ব আছে কিনা, ২। মালিকানার প্রমাণ হিসেবে বিক্রেতার নামে সর্বশেষ জরিপের এস,এ রেকর্ড অথবা আর,এস, রেকর্ড আছে কিনা, ৩। বিক্রেতা যদি ক্রয় সূত্রে জমির মালিক হয়ে থাকেন তাহলে তার নামে মিউটেশন বা নামজারি করা হয়েছে কিনা, ৪। বিক্রি প্রস্তাবিত জমির দখল যাচাই করা, ৫। জমির হালনাগাদ খাজনা পরিধোধ আছে কি-না, ৬। জমির দাগ নম্বর এবং খতিয়ান নম্বর জেলা রেকর্ড রুম থেকে তুলে জমির মালিকানা সূত্র নিশ্চিত হতে পারেন, ৭। জমি রেজিষ্ট্রি করার পূর্বে রেকর্ড, নকশায় ও সরেজমিনে জমির দাগ নম্বর সনাক্ত করে নিন, ৮। কৃষি জমি ক্রয়ের ক্ষেত্রে রেকর্ডীয় মালিকানায় অংশীদারগণ অগ্রক্রয়াধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। সেকারণ অংশীদারদের সম্মতি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নিন, ৯। স্ট্যাম্প ফিস ফাঁকি দেয়ার উদ্দেশ্যে জমির বাজার মূল্য অপেক্ষা কম মূল্য নির্ধারণ করে দলিল রেজিষ্ট্রি করা থেকে বিরত থাকুন। এতে ষ্ট্যাম্প আইনের ৬৪ ধারা মোতাবেক ক্রেতা/ বিক্রেতা উভয়েরই শাস্তি হতে পারে, ১০। বিক্রির জন্য প্রস্তাবিত জমি সরকার কর্তৃক ইতিপূর্বে অধিগ্রহণ হয়েছে কি-না অথবা অধিগ্রহণের প্রস্তাবাধীন কি-না তা সংশ্লিষ্ট অফিস হতে যাচাই করে দেখে নিন ১১। একই জমি একাধিকবার বিক্রির মাধ্যমে হস্তান্তরিত হয়েছে কি-না, ১২। জমির খাজনা/ ভূমি কর অনাদায়ে নিলাম হয়েছে কিনা, ১৩। জমি সিকস্তি হওয়ার কারণে মালিকানা বিলুপ্ত হয়েছে কিনা, ১৪। সংশ্লিষ্ট জমি সরকার বা কোন সংস্থাকে ঋণ গ্রহণের মর্গেজ দেয়া আছে কি-না, ১৫। বিক্রি প্রস্তাবিত জমিতে কোন বিরোধ বা মামলা মোকদ্দমা আছে কিনা-এগুলো ভাল করে যাচাই করে নিন। নতুবা সারা জীবনের অর্জন দিয়ে একটুকরো জমি কিনে বাঁকি জীবন ঝামেলার মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হতে পারে।

লেখক- বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা, সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’।

seraj.pramanik@gmail.com