আইন ও আদালত
আইন ও আদালত

টাকা সম্পর্কিত বিরোধ এবং আইনি প্রতিকার

নোয়াইম মাজহারঃ

প্রচলিত আছে “টাকার মুখ বাঁকা”। অর্থাৎ, টাকা ধার দিলে সম্পর্ক নষ্ট হয় –কারণ ধার দেওয়া বা ঋণের থাকা সময় মত ফেরত পাওয়া না পাওয়া সম্পর্কের অবনতি হয়। এমনকি সম্পর্কের অবনতি অনেক সময় আদালত পর্যন্ত গড়ায়। টাকা উদ্ধারের জন্য দেনাদারের বাড়ি আর আদালত পাড়ায় ঘোড়তে ঘোড়তে কয়েক জোড়া জুতার তলা ক্ষয় হওয়ার অভিজ্ঞতাও অনেকের আছে। আমারা দৈনন্দিন জীবনে নানা কারণে একে অপরকে টাকা ধার দেই, ঋণ দেই পরে ফেরত পাইনা বা ফেরত পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয় বা মিত্থ্যা আশ্বাসে টাকা দিয়ে প্রতারিত হই।

টাকা সম্পর্কিত বিরোধ যেমন নানা রকম হতে পারে তেমনই সেই বিরোধের কারণেদেওয়ানি বাফৌজদারিউভয় দ্বায়ইসৃষ্টি হতে পারে। অর্থাৎ, টাকা ফেরত না পেলে দেওয়ানি এবং ফৌজদারি উভয় আইনেই প্রতিকারের বিধান আছে। টাকা উদ্ধারের মোকদ্দমা মূলত দেওয়ানি প্রকৃতির। দেওয়ানি কার্যবিধি ১৯০৮ এর ধারা ৯ এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে দেওয়ানি প্রকৃতির মোকদ্দমা হলো – যে মোকদ্দমায় কোন সম্পত্তির অধিকার অথবা কোন পদে অধিষ্ঠিত থাকা বা হওয়ার অধিকার নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়।

কিন্তু দেওয়ানি মোকদ্দমা যেহেতু তুলনামূলকভাবে সময় সাপেক্ষ্য এবং দেনাদারকে শাস্তি দেওয়ার সুযোগ কম, তাই অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়বিরোধের কারণ দেওয়ানি প্রকৃতির হওয়া সত্ত্বেও দেনাদারকে কঠোর শাস্তি দেওয়ার মানসে পাওনাদার ফৌজদারি মামলা করতে বেশি তৎপর হন। টাকা সম্পর্কিত সব বিরোধ আসলে ফৌজদারি দ্বায় সৃষ্টি করে না। টাকা সম্পর্কিত বিরুধের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ঘটনা বিশ্লেষণ করে মামলা দায়ের করা উচিত।

বিশ্বাস ভঙ্গ বা প্রতারণার উপাদান বিদ্যমান থাকলে দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ৪০৬ এবং ৪২০ ধারা অনুযায়ী ফৌজদারি মামলা দ্বায়ের করা যাবে। তবে যদি অভিযোগ করা হয় যে আসামী ঋণ গ্রহণ করে দিছি, দেব বলে টাকা আর ফেরৎ না দিয়ে আত্মসাৎ করেছে, তাহলে ৪০৬ এবং ৪২০ ধারায় কোন অপরাধ হবে না; দেওয়ানি দ্বায় হিসেবে গণ্য হবে। তবে এরুপ ক্ষেত্রে যদি আরও অভিযোগ করা হয় যে ঋণ নেয়ার সময় আসামী একটি লিখিত অঙ্গীকারনামা (Undertaking) দিয়েছিল সেক্ষেত্রে টাকা ফেরৎ না দিলে ৪২০ ধারায় প্রতারণার অপরাধ হবে।

কোন ব্যক্তিকে ভুলবশত বেশি টাকা দেওয়া হয় এবং পরে সেই অতিরিক্ত টাকা ফেরত দিতে না চায় তাহলে ঐ ব্যক্তির বিরুদ্ধে আত্মসাতের অভিযোগ দায়ের করা যাবে। দণ্ডবিধির ৪০৩ ধারার উদাহরণ (ক) অনুযায়ী এটা আত্মসাৎ।ব্যবসায়ী লেনদেনের ক্ষেত্রে হিসাব করার পর যদি কোন টাকা পাওনা হয় সেক্ষেত্রেও দেওয়ায়নি দ্বায় তৈরি হবে। আবার কেউ টাকা নেওয়ার পর যদি অস্বীকার করে সেক্ষেত্রে ফৌজদারি দ্বায় তৈরি করবে। দণ্ডবিধির৪০৫ ধারা অনুযায়ী যদি কোন ব্যক্তি অসৎভাবে কোন সম্পত্তি তার নিজের মনে করে বা হস্তান্তর করে বা আইনানুগ কোন চুক্তির খেলাফ করে কোন সম্পত্তি ব্যবহার করে ঐরূপ কাজগুলিও অপরাধমূলক বিশ্বাস ভঙ্গ বলে গণ্য হবে। ৪০৬ ধারায় চার্জ গঠনের সময় প্রথমে দেখাহয় আসামির উপর কোন সম্পত্তি ন্যাস্তকরণ করা হয়েছিল কিনা, তারপর দেখতে হবে আসামি ঐ সম্পত্তি আসাধুভাবে আত্মসাৎ করেছে কিনা বা নিজের ব্যবহার করেছে কিনা। এই দুটি উপাদান বর্তমান থাকলে ৪০৬ ধারায় চার্জ গঠন করা যাবে।

৪২০ ধারা প্রতারণা সংক্রান্ত। প্রতারণা কি এবং কি ধরনের কাজ প্রতারণা হিসেবে গণ্য হবে টা ৪১৫ ধারায় উল্লেখ আছে। ৪২০ ধারায় মামলায় অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে লেনদেনের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে কোন প্রতারণা ছিলনা। প্রাথমিক পর্যায়ে কোন প্রতারণা ছিল কিনা সে বিষয়ে সাক্ষ্য প্রমানের ভিত্তিতে এবং সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত দিতে হবে। এমনকি আসামীর পরবর্তিকালের আচরণ হতেও টা বুঝা যেতে পারে। সাধারণত কোন ধুর্ত ব্যক্তি ঋণ নেয়ার সময় তার অসৎ উদ্দেশ্য গোপন রাখার চেষ্টা করে কিন্তু পরবর্তীতে তার আচরণে টা প্রকাশ পেয়ে যেতে পারে। অনেক সময় ৪০৬ ধারা এবং ৪২০ ধারায় একই আসামীর বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা যেতে পারে – তবে দুটি অপরাধের উপাদান থাকতে হবে।

চেকের মাধ্যমে লেনদেন হয়ে থাকলে চেক যদি ডিসঅনার হয় তাহলে Negotiable Instrument Act (NI Act) ১৮৮১ এর ধারা ১৩৮ অনুযায়ী চেক ডিসঅনার মামলা করা যাবে। তবে সম্প্রতি আপিল বিভাগ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে বাদীকে অবশ্যই প্রতিদান প্রমাণ করতে হবে। অর্থাৎ, কি দ্বায় পরিশোধ করার জন্য চেকটি দেওয়া হয়েছিল সেটি চেক গ্রহিতাকে প্রমাণ করতে হবে। অন্যথায় শুধু চেক ডিসঅনার হলেই ১৩৮ ধারা অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া যাবে না। সাধারণত অপর্যাপ্ত তহবিলের করণে চেক ডিসঅনার হয়। এছাড়া চেক প্রদানকারীর স্বাক্ষর যদি না মেলে বা হিসাব বন্ধ পাওয়া যায় বা চেকে উল্লিখিত টাকার অঙ্ক ও কথায় লিখিত পরিমাণ গড়মিল হয় বা চেকের অর্থ পরিশোধ না করতে নির্দেশনা থাকে তাহলেও চেক ডিসঅনার হতে পারে।

নালিশী টাকা আদায়ের জন্য ইতিমধ্যে দেওয়ায়নী মোকদ্দমা বিচারাধিন থাকাবস্থায়ও ফৌজদারি মামলা করতে বাধা নেই যদি ফৌজদারি অপরাধের উপাদান থাকে। [55 DLR (AD) 58] আবার একই বিষয়ে দেওয়ায়নী মোকদ্দমা অথবা দণ্ডবিধির ৪০৬ ও ৪২০ ধারার অধীন ফৌজদারি মামলা বিচারাধিন থাকাবস্থায়ও NI Act ১৩৮ ধারা অনুযায়ী মামলা করতে কোন বাধা নেই। প্রতারণার মাধ্যমে টাকা নেয়ার কারণে দণ্ডবিধির ৪২০ ধারায় অপরাধ হবে এবং ঐ টাকা যদি চেকের মাধ্যমে ফেরৎ দেয় এবং উক্ত চেক ডিসঅনার হয়, এক্ষেত্রে প্রথমে ৪২০ধারায় মামলা দ্বায়ের করার পরও ১৩৮ ধারায় মামলা চলতে পারে। কোন চেক ডিসঅনার হলে NI Act ১৩৮ ধারায় বা দণ্ডবিধির ৪২০ ধারায় মামলা করা যাবে। কিন্তু চেক শুধু একবার ডিসঅনার হলে৪২০ ধারায় অপরাধ হবে না। [19 BLD 461]

দেওয়ানি মকদ্দমার ক্ষেত্রে আরজিতে দাবীকৃত অর্থের সথাযথ বা নির্দিষ্ট পরিমাণ উল্লেখ করতে হবে। তবে ওয়াশীলাতের উদ্দেশ্যে (mesne profit) অথবা বাদী-বিবাদীর মধ্যে অমীমাংসিত হিসাব গ্রহণপূর্বক সম্ভাব্য পাওনা টাকা উদ্ধারের জন্য মোকদ্দমার ক্ষেত্রে আনুমানিক পরিমাণ উল্লেখ করাযাবে। যেক্ষেত্রে বাদী তার আংশিক দাবি পারস্পরিকভাবে পরিশোধ সম্মত (sett-off) হয়েছে বা বর্জন করেছে সেক্ষেত্রে দাবীর যে অংশ অনুরূপভাবে পরিশোধ বা বর্জন করা হয়েছে সেটাও উল্লেখ করতে হবে। ধারা ৫৬ অনুযায়ী টাকা পরিশোধের ডিক্রি জারির ক্ষেত্রে কোন মহিলাকে গ্রেফতার অথবা দেওয়ানী কারাগারে আটক করা যায় না। ধারা ৫৮ক অনুযায়ী পঞ্চাশ টাকা বেশি পরিশোধের ডিক্রির ক্ষেত্রে আদালত ৬ মাসের জন্য এবং পঞ্চাশ টাকার কম পরিশোধের ক্ষেত্রে ৬ সপ্তাহে জন্য দেওয়ানী আদালতে আটক রাখার আদেশ দিতে পারে।

ফৌজদারি মামলার উপাদান না থাকলে শুধু দেনাদারকে শাস্তির মানসে ফৌজদারি মামলা করলে চূড়ান্ত ফলাফল অনুকূলে আসবে না। তাই টাকা সম্পর্কিত বিরুধের ক্ষেত্রে মামলা করার আগেই ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা জরুরি তা কি ধরণের দ্বায় সৃষ্টি করেছে – দেওয়ানি নাকি ফৌজদারি।সকল প্রকার আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে সচেতন হওয়া উচিত এবং লেনদেন করার সময় অন্তত দুই জন স্বাক্ষীর উপস্থিতিতে লিখিত চুক্তি সম্পাদন করে রাখা উচিত। আইন না-জানা কোনো গ্রহণযোগ্য অজুহাত নয়। তাই ঝামেলামুক্ত জীবন চলতে জীবন ঘনিষ্ঠ কিছু আইন জানা জরুরি বৈ কি!

লেখক- আইনজীবী এবং কলামিস্ট।