চন্দন কান্তি নাথ: সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কুমিল্লা।

ফৌজদারি বিচারে সাক্ষ্য ও সাক্ষির ধরন

চন্দন কান্তি নাথ:

যে সকল দলিল, বস্তু, এবং বিবৃতি উপস্থাপন করে আদালত কোন বিচার্য বিষয় বা প্রাসঙ্গিক বিষয় প্রমাণ করে থাকেন তাকেই সাক্ষ্য বলা হয়। আইনে পাচঁ ইন্দ্রিয় -চোখ, কান, নাক, জিভ ও ত্বক দ্বারা যা অনুভব করা যায় কিংবা যা মানসিক সচেতনতা- তাই বিষয় (Fact)। সে কারনে বিষয় শারীরিক বা মানসিক হতে পারে।তবে বিচার্য বিষয়ের (Facts in issue and law)ক্ষেত্রেই আদালত সাক্ষ্য নেয়। সাক্ষ্য আইনে দুই প্রকারের সাক্ষ্য এর কথা বলা আছে।যথা মৌখিক সাক্ষ্য এবং দালিলিক সাক্ষ্য। আবার মৌখিক সাক্ষ্য সব সময় প্রত্যক্ষ হতে হয়। দালিলিক সাক্ষ্য আবার দুই প্রকারঃ (১) প্রাথমিক সাক্ষ্য (২) মাধ্যমিক সাক্ষ্য। মূল দলিল আদালতে হাজির করাকেই প্রাথমিক সাক্ষ্য বলে। (সাক্ষ্য আইন ৬২ ধারা) মূল দলিলের অনুলিপি বা প্রতিলিপি আদালতে হাজির করাকেই মাধ্যমিক সাক্ষ্য বলে।( সাক্ষ্য আইন ৬৩ ধারা) আবার আরেক প্রকার সাক্ষ্য আছে যাকে পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য বলা হয়।অন্য সাক্ষির বা সাক্ষ্য এর উপস্থিতি না থাকলে পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত মোতাবেক অবস্থাগত সাক্ষ্য এর সংজ্ঞা নিন্মরুপ- ‘Circumstantial evidence is an indirect mode of proof by drawing inference from facts closely connected to the fact in issue.’

আবার চুরির মামলায় যে চোরাই মালামাল পাওয়া গেছে, খুনের মামলায় যে অস্ত্র দিয়ে খুন করা হয়েছিল, আদালতে এগুলো সাক্ষ্য হিসেবে আসে না তবে এগুলো ঘটনার আলামত। এগুলোকে বস্তুর প্রদর্শনী হিসেবে রাখা হয়। যা আদালতকে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সাহায্য করে। আবার সাক্ষ্য আইনের ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে অনেক বিষয়ে আদালত প্রমাণের ক্ষেত্রে সত্য বলে গ্রহণ করবেন। ফৌজদারী কার্যবিধির ২৯৩ এবং ৫৩৯ ধারায় তদন্ত বা পরিদর্শনের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সাক্ষ্য না হলেও এর মূল্য অপরিসীম। ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ৩৬৩ ধারা অনুসারে অনেক সময় সাক্ষীর হাবভাব হতে সত্য বাহির হয়ে আসে। এক্ষেত্রে তা আদালত লিপিবদ্ধ করে রাখেন।

আবার সাক্ষ্য আইন মোতাবেক আদালত তিন প্রকার অনুমান করতে পারেন। আদালত কোন বিষয় সত্য গণ্য করতে পারেন,আবার অসত্য ও গণ্য করতে পারেন।এটিকে আইনের ভাষায় May Presume হিসেবে ধরা হয়। এ অনুমানের বিষয় সাময়িক ও খন্ডন যোগ্য।কোন ক্ষেত্রে আইনে অবশ্যই অনুমান (Shall Presume) করতে হবে বলেছে। সেখানে কোন বিষয় আদালত সঠিক বলে মেনে নিতে বাধ্য।কিন্তু বিষয়টি মিথ্যা প্রমাণিত হলে এই অনুমানের বাধ্যবাধকতা থাকে না। তাই এটিও খণ্ডনীয় অনুমান। তবে যেখানে চুড়ান্ত প্রমাণ (Conclusive Proof) বলা হয়,সেখানে সে বিষয়টিকে সঠিক বলে মেনে নেওয়া ছাড়া আদালতের আর কোন উপায় থাকে না।তাই এই অনুমান অখন্ডনযোগ্য।এক্ষেত্রে আদালত কোন বিষয়কে সঠিক প্রমানিত বলে গণ্য করবেন,যতক্ষণ পর্যন্ত তা মিথ্যা প্রমাণিত না হয়।আবার প্রমাণিত (Proved), অপমানিত (Disproved), প্রমানিত নয় (Not Proved) এ বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ। আদালতে যখন কোন বিষয় তোলা হয়, আদালত তার অবস্থা, অস্তিত্ব ইত্যাদি বিবেচনা করে দেখেন। প্রমাণিত হয়েছে তখনই বলা চলে যখন তর্কিত বিষয়ের অস্তিত্ব নিশ্চিত বলে বিশ্বাস জন্মে। কিংবা একটি মামলায় উপস্থিত প্রেক্ষাপটের পরিপ্রেক্ষিতে তর্কিত বিষয়ের অস্তিত্ব এতই সম্ভব মনে হয় যে,তাতে কোন জ্ঞানবান (Prudent man) লোকের সন্দেহ থাকার উপযুক্ত কারণ অবশিষ্ট থাকে না।

আইন বলছে, ‘A fact is said to be proved when,after considering the matters before it,the court either believes it to exist,or considers its existence so probable that a prudent man ought, under the circumstances of the particular case,to act upon the supposition that it exists.’ উচ্চ আদালতের একটি মামলায় বলা হয়, ‘Disproved’ is merely the converse of the defintion of Proved’

একটি বিষয় অপ্রমাণিত(Disproved) হয়েছে তখনি বলা চলে যখন আদালত বিবেচনা করে দেখেন যে, এর অস্তিত্ব থাকতে পারে না বা অস্তিত্ব নেই এবং কোন জ্ঞানবান (Prudent man) লোক সে পরিস্থিতিতে তার অস্তিত্ব নেই ভেবে কাজ করত। আবার যখন কোন তর্কিত বিষয় ‘প্রমাণিত’ বা ‘অপ্রমাণিত’ হয় নি,তখন প্রমাণিত নয় বলা হয়।Proved এর সংজ্ঞা অনুসারে আদালতের সামনে (matters before it) অনেক বিষয় আসে।এজাহার আসলে তা শক্ত প্রমান নয়।( substantive evidence)

যিনি এজাহার করেছেন তার বক্তব্যর সাথে মিল অমিল (contradict)কিংবা সামঞ্জস্যপূর্ণ (corroborate) হচ্ছে কিনা তা পরিক্ষা করা যাবে। অন্য সাক্ষ্য ও সাক্ষির প্রমানের সাথে এজাহারের মিল অমিল করে সামগ্রিক বিষয় পর্যালোচনা করে আদালতকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।(20 BLC (AD) 122)। এজাহার বিলম্বে হলে আদালতে এর গ্রহনযোগ্যতার ব্যাখ্যা দিতে হয়। এজাহার ছাড়া ও সুরতহাল রিপোর্ট মুল সাক্ষ্য(substantive evidence) নয়।তাই সাক্ষিদের সাথে এটার মিল অমিল ( Contradiction ) করা যাবে।একইভাবে তদন্ত রিপোর্ট আইনগত সাক্ষ্য নয়।তবে বিজেন্দর বনাম দিল্লী, ১৯৯৭,৬ এম সি সি ২৮৮৫ মামলায় বলা হয়, “The evidence produced at the trial as a result of an investigation constitute evidence for the purposes of formulating judicial conclusions.” আবার ১৬১ ধারার জবানবন্দি দ্রুত তদন্ত করে লিপিবদ্ধ করতে হয় এবং দ্রুত পুলিশ রিপোর্ট প্রস্তুত করতে হয়। জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করতে অহেতুক বিলম্ব করলে সে বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য হয় না।(17 BLC (HCD) 366) তবে তদন্তকালীন আসামির ১৬৪ জবানবন্দি আদালতে আইনসঙ্গতভাবে প্রমান করতে হবে।যে ম্যাজিস্ট্রেট লিপিবদ্ধ করেছেন তাকে সাক্ষি হিসেবে উপস্থিত হয়ে তা প্রমান করতে হয়। (48 DLR (AD) 186) উক্ত জবানবন্দি স্বেচ্ছামূলক, সত্য এবং বিধি অনুযায়ী লিপিবদ্ধ হলেই আসামিকে সাজা দেয়া যায়।(67 DLR (AD) 6) গত ২৮/০৮/২০১৯ ইং তারিখে মাননীয় হাইকোর্ট এর ৩ জনের বৃহত্তর বেঞ্চ আনিস মিয়া বনাম রাষ্ট্র মামালায় শিশুর ১৬৪ ধারার জবানবন্দি বিষয়ে বলেন, “We find it difficult to accept that by virtue of section 18 or section 42 of the Shishu Ain, Confession of a child under section 164 of the Crpc can be recorded and used against him.”

তদন্তকালীন আসামি ছাড়া অন্য কেউ ১৬৪ জবানবন্দি দিতে পারে কিন্তু আদালতে বিচারের সময় ভিন্ন বক্তব্য দিতে পারে না।দিলে কোন পরিস্থিতিতে এরুপ বক্তব্য দেয়া হয়েছে আদালত তা বিবেচনা করতে পারেন।(2 BLD (AD) 18)। অনেক সময় সহ -আসামি অন্যকে জড়িয়ে দোষ স্বীকার করে।পৃথক বিশ্বাস যোগ্য সাক্ষ্য না থাকলে বিচারের সময় এরুপ সাক্ষ্য দিয়ে অন্য কাউকে সাজা দেয়া যায় না।(45 DLR (AD) 175) অনেক সময় আসামি আংশিক সত্য এবং আংশিক মিথ্যা মিশিয়ে ১৬৪ জবানবন্দি দেয়।সেক্ষেত্রে যে টুকু সত্য তা গ্রহন করা যাবে।(44 DLR(AD) 51) আবার আসামি ম্যাজিস্ট্রেট বা পুলিশ ব্যাতিত অন্য কাউকে extra judicial স্বীকারোক্তি দেয়।সে ক্ষেত্রে যার নিকট এরুপ সাক্ষ্য দেয়া হয়েছে তিনি যদি একইরুপ বক্তব্য বিচারে দেন তার সাক্ষ্য বিশ্বাস যোগ্য হবে।(16 MLR(AD) 35) তদন্তের সময় ভিক্টিম মারা গেলে সঠিকভাবে লিপিবদ্ধকৃত জবানবন্দি মুল সাক্ষ্য (substantive) হয়। (8 ALR(AD)(2) 45)

তদন্তকালে সংগ্রহকৃত ময়নাতদন্ত রিপোর্ট ডাক্তারের উপস্থিতি ছাড়া ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৫০৯এ অনুসারে বিচারকালে গ্রহণ করা যায়।(7 BLT(AD) 337) আর অন্য ক্ষেত্রে সার্টিফিকেট ইস্যুকারি ডাক্তার ছাড়া মেডিক্যাল সার্টিফিকেট গ্রহণ যোগ্য হয় না। তবে অন্য সাক্ষিরা যদি খুন,জখম,ধর্ষণ ইত্যাদি অভিযোগ প্রমান করতে পারে তবে সে মৌখিক সাক্ষ্য প্রমানের ভিত্তিতে আসামিকে সাজা দেয়া যায়।(27 BLD(AD) 253) একইভাবে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫১০ ধারা অনুসারে বিশেষজ্ঞ এর উপস্থিতি ছাড়া রাসায়নিক রিপোর্ট বা তাঁর অন্য রিপোর্ট গ্রহণ করা যায়।আদালতে মৌখিক সাক্ষি কিছু সত্য এবং কিছু মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে যেটুকু সত্য সেটুকু বিবেচনা করতে হবে। (53 DLR(AD) 1) সাক্ষ্য আইনের ১১৮ ধারা অনুসারে যারা আদালতের প্রশ্ন বুঝতে সক্ষম নন তারা মৌখিক সাক্ষ্য দিতে পারেন না। ইশারায় বক্তব্য প্রকাশ করতে পারলে বা লিখে বুঝাতে পারলে সাক্ষ্য আইনের ১১৯ ধারা মোতাবেক আদালত তার সাক্ষ্য নিবেন। তবে সাধারণত chance witness(হঠাৎ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হওয়া সাক্ষি) এর সাক্ষ্য বিশ্বাস যোগ্য নয়।(43 DLR(AD) 92) তবে সাক্ষি কোন পক্ষের আত্মীয় বা শত্রু বা কোনভাবে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট (Interested) শুধু এই ভেবে কারো সাক্ষ্য বাদ দেয়া যাবে না।(58 DLR(AD) 73) এমনকি পুলিশ সাক্ষিকে বিশ্বাস যোগ্য মনে হলে তাদের সাক্ষ্যকে ও মূল্যায়ন করতে হয়।(15 MLR(AD) 77)

বিরুদ্ধে সাক্ষি দিলে সাক্ষ্য আইনের ১১৮ ধারা অনুসারে তাকে জেরা করা যায়। বৈরী সাক্ষির সাক্ষ্য সামঞ্জস্যপূর্ণ হলে তার সাক্ষ্য বিবেচনা করতে হয় এবং এটা নির্ভর করা যাবে।( 44 DLR(AD) 169) ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৩৭ ধারা অনুসারে সত্য উদঘাটনে সহায়তাকারী আসামি সাক্ষির সাক্ষ্য অন্য সাক্ষ্য দ্বারা সমর্থিত না হলে এবং বিশ্বাস যোগ্য না হলে গ্রহণযোগ্য হয় না।(56 DLR(HCD) 132) আবার জব্দ তালিকার সাক্ষি সাধারণত নিরপেক্ষ হয়। মোহাম্মদ হোসাইন বি রমজান বনাম মহারাষ্ট্র,(CrLJ,1020(Bomb)) মামলায় বলা হয়, “ Normally, it is expected that the investigating officer would take independent panch witness and, if knowingly he took pitiable witnesses as panch witnesses, the entire raid would become suspicious and in such a case it would not be possible to hold that the evidence of the police witnesses by themselves would be sufficient to a conviction.” আবার একজন চাক্ষুস সাক্ষি সমস্থ আঘাতের কথা গনণা করে বলবে এমন নয়। (AIR 2009 SC,1636) তবে ভিক্টিম চাক্ষুস সাক্ষি পুলিশ কে একটা আর আদালতে আরেকটা বললে তা নির্ভর করা যায় না।(1993 CrLJ 1259 Mad) তবে একাধিক চাক্ষুষ সাক্ষি থাকলে সকলের সাক্ষ্য সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হয়। আবার সাক্ষিদের জবানবন্দির সাথে তাদের দেয়া ১৬১ জবানবন্দির মিল থাকলে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে সাক্ষি হিসেবে না ডাকলে ও চলে।AIR 2000 SC 1582 সহ অনেক মামলায় বলা হয়, “ Where is there is no contradiction in statements of the prosecution witnesses given in the court and their earlier statements,the non examination of the Investigation Officer like other witnesses can not be said to be fatal for the prosecution.”

ফৌজদারি বিচারে সাক্ষ্য ও সাক্ষির ধরন সম্পর্কে ভাল জ্ঞান থাকলে, জেরা ও জবানবন্দি ও ভাল হয়।

লেখক- সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কুমিল্লা।