খুরশিদ কামাল তুষার
খুরশিদ কামাল তুষার

বৈবাহিক ধর্ষণ: আইন কিংবা শাস্তির দৃষ্টান্ত নয়, প্রয়োজন পারিবারিক ও নৈতিক মূল্যবোধ

খুরশিদ কামাল তুষার:

ইদানীং মিডিয়া পাড়ায় কোর্টরুম ড্রামা বা লিগ্যাল ড্রামার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। বিশেষত বলিউডে আইন ও বিচার সংক্রান্ত বেশ ভালো মানের কিছু সিনেমা তৈরী হয়েছে । ২০১৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ‘পিংক’ তিনজন সিঙ্গেল মেয়ের জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনার ওপর তৈরী। এই সিনেমার শেষ অংশে ক্লোজিং আর্গুমেন্ট দেয়ার সময় বিবাদী পক্ষের আইনজীবী কিছু হৃদয়স্পর্শী কথা বলেন। কথাগুলোর সারসংক্ষেপ অনেকটা এরকম, “একজন মেয়ে, সে পরিচিত হোক, বান্ধবী হোক, যৌনকর্মী হোক কিংবা নিজের বিবাহিত স্ত্রী-ই হোক, যখন সে ‘না’ বলবে, সেই না মানে যে না এটা মেনে নিতে হবে ছেলেদের। যখন কেউ ‘না’ বলবে, ঐ মুহুর্তে থেমে যেতে হবে। মেয়েরা কোন ভোগ্যপণ্য নয়, তাদের  আত্মসম্মান কে শ্রদ্ধা করতে হবে । ”

পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কাছে মেয়েরা কতটা অসহায় তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। বিবাহিত স্ত্রী বলে, তাঁর ইচ্ছেকে প্রাধান্য না দিয়ে অনেকেই জোরপূর্বক নিজের কামনা চরিতার্থ করে। এই ধরনের ঘটনাকে একটা বিশেষ নাম দেয়া হয়েছে, ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ বা ‘ম্যারিটাল রেপ’৷ কিন্তু এই বিশেষ শব্দটি একটি তার্কিক বিষয়ে পরিনত হয়েছে। বৈবাহিক ধর্ষণ বলতে আসলেই কিছু থাকা উচিত কি না, তা নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে অনেক মতামত প্রকাশ পাচ্ছে। একদিকে স্বীকৃতি সহ আইন চাচ্ছে নারী সমাজ এবং তাদের সমর্থনকারী ব্যাক্তি ও সংগঠন, অন্যদিকে এই বিষয়টির সম্পুর্ণ বিরোধিতা করে একদল মানুষ ঐ আন্দোলনকারীদের নারীবাদী বা ফেমিনিস্ট কিংবা অধার্মিক আখ্যা দিচ্ছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে এটাকে ইসলামিক ভাবধারার বিরোধী ও পশ্চিমা অপসংস্কৃতির প্রভাব বলে তকমা দেয়া হচ্ছে।

বর্তমান সময়ে এসে  নারী সমাজ যখন ম্যারিটাল রেপ কে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য আন্দোলনে নেমেছে তখনই পুরুষরা তাদের এ আন্দোলন নানা ভাবে হেয় প্রতিপন্ন করে চলছে। মিডিয়া ট্রায়ালের নগ্নরুপ দেখা যাচ্ছে ফেসবুক সহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জুড়ে। একটা বড় সংখ্যক  হৃদয়হীন পুরুষের দেখা মিলছে সে মাধ্যমেগুলোতে যারা আজও নারীকে শুধুই ভোগ্যপণ্য মনে করে। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার কোরআন হাদিস থেকে আংশিক ব্যখ্যা দিয়ে বেড়াচ্ছে। মোদ্দাকথা হলো, তারা মেনেই নিতে পারছে না বিবাহিত স্ত্রী নিজের মাধ্যমেই ধর্ষিত হতে পারে বা স্বামীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের মত ঘৃণ্য অপরাধের দায় চাপাতে পারে !

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বৈবাহিক ধর্ষণ বলতে কোনকিছু এখনো স্বীকৃতি পায়নি এবং প্রচলিত আইনেও এর ব্যাখ্যা বা কোন শাস্তির বিধান নেই। পেনাল কোড বা দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণের সংগা দেয়া হলেও এই ধারার ব্যতিক্রম বলে, স্ত্রীর বয়স যদি তেরো বছরের কম হয়, একমাত্র সেই ক্ষেত্রেই বিনা অনুমতিতে যৌন মিলন করলে তা ধর্ষণ হবে অন্য কোন ক্ষেত্রে নয়। তার মানে হলো ১৪ কিংবা তার বেশি বয়সী স্ত্রী বাধা দিলেও তা তোয়াক্কা না করেই স্বামী যদি যৌন মিলন করে তা ধর্ষণ হবে না। কিন্তু অনেক সময়ই এরকমটা হয় যে, স্বামী বা স্ত্রী একে অপরের অসুবিধার বিষয়টি বুঝতে চায়না এবং একজনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অপরজন শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে। সম্মতি ছাড়া জোরপূর্বক এই মিলিত হওয়াকেই বৈবাহিক ধর্ষণ বলা হচ্ছে।

অতি সম্প্রতি গত ৬ ই আগস্ট, ২০২১,  ৬ বছর ধরে চলা একটি মামলায় ম্যারিটাল রেপ কে চিহ্নিত করে  এক ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন ভারতের কেরেলা রাজ্যের হাইকোর্ট।

রায়ে বলা হয়েছে, ‘কোন নারী এবং পুরুষের মধ্যে যৌন মিলন ঘটার ক্ষেত্রে সম্মতি থাকতেই হবে, তারা বিবাহিত হোকবা না হোক।’ রায়ে আরও বলা হয়েছে, ‘ স্ত্রীর শরীরের ওপর স্বামীর অতিরিক্ত কোন অধিকার বর্তায় না। স্বামী স্ত্রী দুজনেরই সমান অধিকার রয়েছে। সম্মতির বাইরে জোর করে শারীরিক সম্পর্ক ধর্ষণের সমান অপরাধ বলেই গণ্য হবে এবং এই ধরণের কাজ মানসিক ও শারীরিক ধর্ষণের সমতুল্য, তদুপরি আরও উল্লেখ্য যে, ম্যারিটাল রেপ ডিভোর্সের জন্য একটি যুক্তিগ্রাহ্য কারণ হিসেবে বিবেচিত হবে । ‘

বাংলাদেশেও বৈবাহিক ধর্ষণকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য একাধিকবার হাইকোর্টে রীট করা হয়েছে, চাওয়া হয়েছে একটি নির্দিষ্ট আইন। তবে এখনো পর্যন্ত ফলপ্রসূ কোন উদ্যোগ দৃষ্টিগোচর হয়নি। সেক্ষেত্রে কেরেলা হাইকোর্টের দেয়া এই সাম্প্রতিক রায় আবারও এই দাবীকে বেগবান করতেই পারে।

বিবাহিত দম্পতিদের যৌন মিলন আইনত এবং সামাজিকভাবে  স্বীকৃত।  তবে বৈবাহিক সম্পর্কের ভেতরেও গোপনীয়তা বিরাজ করে আর তার সুরক্ষা ব্যাক্তি স্বাধীনতার সংগে জড়িত। ব্যাক্তির ইচ্ছের বিরুদ্ধে গোপনীতায় আঘাত ঐ ব্যাক্তির স্বাধীনতা হরণের সমতুল্য। এজন্যই ইচ্ছের বিরুদ্ধে মিলন যেকোন দম্পতির মধ্যেই অন্তঃকলহ সৃষ্টি করে। এই জবরদস্তি যেকোন পক্ষেরই হতে পারে। শুধু যে নারীরাই এ ধরনের নির্যাতনের শিকার, তা বলা যাবে না, অনেকক্ষেত্রে পুরুষদেরও বাধ্য হতে হয়, বাধ্য করা হয়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীরাই এ ধরনের সহিংসতার শিকার হয়ে থাকে। এজন্য এ সহিংসতা প্রতিরোধে নারীরাই বেশি সোচ্চার।

আসলেই কি আইন প্রয়োজন নাকি প্রয়োজন নারী পুরুষের পারস্পরিক সহমর্মিতা, মূল্যবোধ আর সচেতন মানসিকতা?

অনেক সময়ই আইন খড়গ হচ্ছে কিছু মানুষের জন্য। বিশেষত নারীকে সুরক্ষা দিতে তৈরী করা আইন সমুহে বিতর্কের শেষ নেই। অনেক সময়ই এই আইনগুলো দ্বারা মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা হচ্ছে। আবার এসব মিথ্যা মামলায় নিরপরাধ ব্যাক্তিযেমন সাজা খাটছে, তেমনি প্রকৃত অপরাধীরা আইনের ফাঁক গলিয়ে স্বদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এজন্য যদি আইন একান্তই করতে হয়, তবে নারী পুরুষ উভয়ের বিষয়কেই সমান গুরত্ব দিয়ে আইন করতে হবে। বৈবাহিক ধর্ষণ কে স্বীকৃতি দিলে তা যেন একেবারেই নারীবান্ধব না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।

শুধুমাত্র একের পর এক আইন তৈরী এবং তার প্রয়োগ সবক্ষেত্রে সমাধান হতে পারে না। বিবাহিত জীবনে যৌন সম্পর্ক নারী পুরুষের একান্ত ব্যাক্তিগত বিষয়। এক্ষেত্রে স্বামী- স্ত্রী উভয়কেই হতে হবে পরস্পরের সহযোগী। পরস্পরকে বুঝবার ক্ষমতা থাকতে হবে। পারিবারিক বিষয়গুলো নিজেদের মধ্যে মিটিয়ে ফেলার মানসিকতা থাকাটা জরুরী।  সর্বোপরি পাশবিকতার বেড়াজাল ডিঙিয়ে মানবিক আচরণে অভ্যস্ত হতে পারলেই এ ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধ করা সম্ভব।

তথ্যসূত্রঃ বিবিসি বাংলা, জি ২৪ ঘন্টা ( ভারত )

লেখক- শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।