ফেসবুকে মিথ্যা পোস্ট ও শেয়ারিং – বনাম আইনী জটিলতা

সামাজিক যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হলো ফেসবুক। কিন্তু ফেসবুক ব্যবহারে উপকারিতার পাশাপাশি ক্ষতির সম্মুখীনও হচ্ছে অনেকে। কেউ আবার না বুঝে অথবা বুঝে অপব্যবহার করছে ফেসবুককে প্রচলিত আইনে ফেঁসে যাচ্ছে তারা।

মত প্রকাশের অধিকার আছে সবার। কিন্তু মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মানে যা খুশি তা লিখে ফেলা নয়।

কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিপক্ষে অভিযোগ করে সামাজিক মাধ্যমে কোনো পোস্ট দিলে, সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আপনার বিরুদ্ধে মামলা করার অধিকার রাখে। যদি যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ আপনার হাতে না থাকে, আপনি পড়ে যেতে পারেন ঝামেলায়।ফেসবুকে এ ধরনের পোস্ট দেওয়া বা শেয়ার করার আগে আমাদের কী কী বিষয় খেয়াল রাখা উচিত, তা জেনে রাখা তাই ভালো। শুধু নিজে সতর্ক থাকতে নয়; প্রতিকার পেতেও। কারণ, সামাজিক মাধ্যমে ঘৃণা ছড়ানো বা অপমানের শিকার হতে হচ্ছে অনেককে।

সামাজিক মাধ্যমে মানহানির শিকার হলে এ থেকে প্রতিকারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আইন করা হয়েছে। আবার সেসব আইনের অপপ্রয়োগও হচ্ছে। ফেসবুকে যা অপরাধ হিসেবে গণ্য।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী ফেসবুকে যেসব কাজ দণ্ডনীয়-

১. ফেসবুকে মিথ্যা ও অশ্লীল এমন কোনো কিছু ব্যবহার করা, যা কোনো ব্যক্তি পড়ে, দেখে ও শুনে নীতিভ্রষ্ট হতে পারে।

২. কোনো স্ট্যাট্যাস বা ট্যাগের কারণে কারো মানহানি ঘটানো।

৩. এমন কোনো কিছু লেখা যার মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে।

৪. এমন কিছু লেখা ও ট্যাগ করা যার মাধ্যমে রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়।

৫. এমন কোনো কিছু লেখা, যার

মাধ্যমে কারো জাত, বর্ণ ও ধর্মীয় অনূভূতিতে আঘাত লাগতে পারে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এসব করলে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন অনুযায়ী শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন:

ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ শনাক্তকরণ, প্রতিরোধ, দমন, বিচার ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে বিধান প্রণয়নকল্পে প্রণীত আইন হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন।তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ও ৬৬ সহ মোট ৫টি ধারা বিলুপ্ত করে,সেপ্টেম্বর ২০১৮ ইং বাংলাদেশের সংসদে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ পাস হয়। ১ অক্টোবর ২০১৮ ইং আইনটি কার্যকর হয়।

অপরাধ ও শাস্তি:

ধারা ২১ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা, প্রচারণা ও মদদ দিলে সর্ব্বোচ শাস্তি ১৪ বছরের কারাদণ্ড; জরিমানা ৫০ লাখ টাকা।

ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক প্রতারণা

ধারা২৩। উপধার(১) যদি কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যম ব্যবহার করিয়া প্রতারণা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।

উপধারা(২) যদি কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেন, তাহা হইলে তিনি অনধিক ৫ (পাঁচ) বৎসর কারাদণ্ডে, বা অনধিক ৫ (পাঁচ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শক, তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ, ইত্যাদি

ধারা ২৫ উপধারা (১) যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে,-

(ক) ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে, এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ করেন, যাহা আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শক অথবা মিথ্যা বলিয়া জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও, কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয় প্রতিপন্ন করিবার অভিপ্রায়ে কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ বা প্রচার করেন,

বা (খ) রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণ্ণু করিবার, বা বিভ্রান্তি ছড়াইবার, বা তদুদ্দেশ্যে, অপপ্রচার বা মিথ্যা বলিয়া জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও, কোনো তথ্য সম্পূর্ণ বা আংশিক বিকৃত আকারে প্রকাশ, বা প্রচার করেন বা করিতে সহায়তা করেন,

তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।

উপধারা(২) যদি কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেন, তাহা হইলে তিনি অনধিক ৩ (তিন) বৎসর কারাদণ্ডে, বা অনধিক ৩ (তিন) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

ধারা ২৭ অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা,নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করে এবং জনগণের মাঝে ভয়ভীতি সঞ্চারের জন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে বৈধ প্রবেশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বা করায়, তাহলে সর্ব্বোচ সাজা ১৪ বছর কারাদণ্ড। জরিমানা এক কোটি টাকা।

ধারা ২৮ অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করে এমন কিছু ডিজিটাল মাধ্যমে প্রচার করে, তাহলে সর্ব্বোচ ১০ বছরের সাজা। জরিমানা  ২০ লাখ টাকা।

ধারা২৯ অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে পেনাল কোডের ৪৯৯ ভঙ্গ করে কোনো অপরাধ করেন তাহলে সর্ব্বোচ তিন বছরের কারাদণ্ড ভোগ করবেন। জরিমানা পাঁচ লাখ টাকা।

ধারা-৩২ অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ ও সংরক্ষণ করেন বা সহায়তা করেন, তাহলে সর্ব্বোচ ১৪ বছরের সাজা। ২৫ লাখ টাকা জরিমানা।

বর্তমানে ফেসবুক বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম হিসেবে কাজ করতেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের নানা সামাজিক প্রতিবাদে সোচ্চার কণ্ঠ হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। বেশির ভাগ ঘটনাতেই ইতিবাচক ভূমিকায় ব্যবহার করা হয়েছে। আবার অনেক সময়ই ফেসবুক ব্যবহার করে নানা ভুল তথ্য, ছবি ও গুজব ছড়ানো হয়েছে। মতপ্রকাশের অধিকার আছে সবার। কিন্তু মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মানে যা খুশি তা করা নয়। আইন মেনেই করতে হয়। অনলাইনে মতপ্রকাশের সময় এই দায়িত্ববোধ রয়েছে। সুতরাং ফেসবুক ব্যবহারে এমন সতকর্তা ও দায়িত্বশীল হতে হবে, যাতে একটি পোস্ট বা মন্তব্য যেন আইন লঙ্ঘন না করে।

লেখক ও তথ্য সংগ্রহকারক: মোঃ আব্দুল বাতেন; আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।