অ্যাডভোকেট রীনা পারভিন মিমি

দানপত্র দলিল রেজিস্ট্রেশনের পরে সেটি পুনরায় বাতিল করা যায় কি?

রীনা পারভিন মিমি:

পৃথিবীতে কেউ চান না তার রেখে যাওয়া কষ্টের বাড়ি, সারা জীবনের সঞ্চয় যা তাঁর উত্তরাধিকারী ছাড়া অন্য কেউ ভোগ করুক বা কেউ তাঁর সম্পত্তিতে এসে ঝামেলা করুক। দানপত্র একেকজন একেক কারণে করতে চান। কেউ দানপত্র করতে চান তাঁর ছেলে না থাকার কারণে মেয়েদের সকল সম্পত্তি লিখে দিতে, কেউবা তার সন্তান নেই বলে তাঁর স্ত্রীকে লিখে দিতে বা মসজিদ বা মাদ্রাসায় দান করে দিতে চান, আবার অনেক সময় অনেক সন্তান থাকলেও কিছু জমি তার এক সন্তানকে দিবেন বলে ঠিক করেন। সকলেই চান, তিনি চলে যাওয়ার পরে যেন সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে সমস্যা না-হয়। যাকে যতটুকু সম্পত্তি দিতে চান তাকে যেন ততটুকুই দিয়ে যেতে পারেন আর এসকল কারণেই দানের বিষয় চলে আসে।

দানপত্র দলিল কি

দানপত্র যার নাম দানপত্র দলিল (Gift Instrument/Deed of Gift) পণ স্বরূপ কোন অর্থ বা অন্য কোন কিছু গ্রহণ না করে কোন ব্যক্তি স্বেচ্ছায় গ্রহীতার সম্মতিক্রমে যে দলিলের মাধ্যমে কোন সম্পত্তি হস্তান্তর করেন, তাকে দানপত্র বলে।

দানপত্রের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির দখল হস্তান্তর আবশ্যকীয় শর্ত। দানপত্রে কোন প্রতিদান (Consideration) এর কোন ব্যবস্থা নেই; তবে শর্ত আরোপ করা যেতে পারে। যে দলিলের মাধ্যমে কোন ব্যক্তি স্বেচ্ছায় এবং পণ ব্যতীত কোন সম্পত্তি অন্য কোন ব্যক্তির নিকট হস্তান্তর করেন, এবং দান গ্রহিতা বা তার পক্ষে বা  অন্য কেউ উক্ত সম্পত্তি গ্রহন করেন, তবে তাকে দানপত্র দলিল বলে। দানও এক ধরনের সম্পত্তি হস্তান্তর Transfer (ট্রান্সফার)। তবে দান হতে হবে স্বতঃপ্রণোদিত, কারও কথার  চাপে পড়ে, শর্ত মেনে কিংবা প্ররোচনায় পরে সম্পত্তি লিখে দেয়ার নাম দান নয়। বিনিময়ে কিছু না-নিয়ে সম্পত্তির যাবতীয় মালিকানা বা স্বত্ব অন্যের হাতে তুলে দেওয়ার নামই দান। সম্পত্তি হস্তান্তর আইন ১৮৮২, এর ১২২ ধারায় বলা হয়েছে- কোন সম্পত্তি দাতা কর্তৃক কোন ব্যক্তিকে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে এর কোন পণ গ্রহণ না করে তাৎক্ষণিকভাবে হস্তান্তর করলে এবং গ্রহীতা বা তার পক্ষে কোন ব্যক্তি সেটি গ্রহণ করলে তাকে দান বা হেবা বলে।

দান বৈধ হবার ক্ষেত্রে তিনটি শর্ত অবশ্যই পূরণ করতে হয়, তা হলো

১. দাতা কর্তৃক দানের ঘোষণা প্রদান।

২. গ্রহীতা তার পক্ষ হতে দান গ্রহণ করা বা স্বীকার করা।

৩. দাতা কর্তৃক গ্রহীতাকে দানকৃত সম্পত্তির দখল প্রদান।

যিনি দান করছেন, তিনি দাতা (donor)। আর যিনি তা গ্রহণ করছেন, তিনি গ্রহীতা (donee)।

কাদেরকে সম্পত্তি দান করা যায়:

আমরা যখন দান করতে যাই তখন সাধারণত চিন্তায় পরে যাই আমি যাকে দান করবো তাকে দান করতে পারবো কিনা? আমরা কি যে কাউ কেউ দান করতে পারব? উত্তর হলো হ্যাঁ পারব, তবে এখানে রেজিট্রেশন আইনে কিছু নিয়ম রয়েছে তা হলো রেজিট্রেশন আইন অনুযায়ী দানের  ক্ষেত্রে শুধু রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয় তথা স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে, পিতা-মাতা ও সন্তানের মধ্যে, ভাই-ভাই, বোন-বোন অথবা ভাই-বোন, দাদা-দাদী, নানা-নানী থেকে নাতি-নাতনী ও নাতি-নাতনি এই কয়েকটি সম্পর্কের মধ্যে সম্পত্তি হস্তান্তর করা যায় (রেজিস্ট্রেশন আইন-১৯০৮, এর ধারা ৭৮এ (বি) নং অনুসারে। এই সম্পর্কের বাইরে অন্য সম্পর্কের মধ্যে দানপত্র দলিল করা যাবে তবে সে ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশন খরচ ১০০ টাকাতে সীমাবদ্ধ থাকবে না, অন্যান্য দলিলের মতোন খরচ চলে আসবে।

অনেককে আবার দেখা যায় যে রেজিস্ট্রেশন খরচ বাঁচানোর জন্য দান করতে চায় কিন্তু উপরোক্ত ব্যক্তি ছাড়া রেজিস্ট্রেশন খরচ বাঁচানো সম্ভব নয়। অনেক সময় দেখা যায় অনেকে জীবন স্বত্ত্বে দান করতে চায় সে ক্ষেত্রে দলিল রেজিস্ট্রেশন ফিঃ হবে ষ্ট্যাম্প এ্যাক্ট ১৯০৮ এর ৫৮ নং আর্টিক্যাল অনুসারে। জীবন স্বত্ত্বে দানের বিধানহলো-যে প্রতিষ্ঠানের নামে সম্পত্তি দান করা হবে সে প্রতিষ্ঠান ঐ সম্পত্তি শুধু ভোগ-দখল করতে পারবে, সম্পত্তি কোনরূপ হস্তান্তর করতে পারবে না; যেমন মসজিদ ,মাদ্রাসা। জীবন স্বত্ত্বের দান দলিল রেজিস্ট্রির ক্ষেত্রে ২% স্ট্যাম্প ফি, ২.৫% রেজিস্ট্রেশন ফি এবং ই-ফিস লাগবে।

কখন দানপত্র দলিল বাতিল করা যাবে?

দানপত্র আইনের চোখে তখনই সম্পূর্ণ হয় যখন দাতা কোনও সম্পত্তি গ্রহীতাকে দান করেন ও গ্রহীতা তা গ্রহণ করেন এবং তা যদি সঠিক নিয়ম অনুসারে রেজিস্ট্রেশন হয়ে থাকে তাহলে সাধারনত দানপত্র দলিল কেন কোন দলীলই বাতিল করা সম্ভব নয়। উইল করে ফেলার পরেও আপনি যত বার খুশি তা বদলাতে পারেন কারণ, তা কার্যকর হয় উইলকারীর মৃত্যুর পর। কিন্তু এক বার দানপত্র করার প্রক্রিয়া শেষ হওয়া মানেই কিন্তু সম্পত্তি অন্যের হয়ে যাওয়া। তখন তার উপর দাতার আর কোনও অধিকার থাকে না। একবার স্বেচ্ছায় দান করার পর তা বাতিল অনেক কঠিন কাজ। মুসলিম আইনের ১৬৭ ধারায়  দান বাতিল সম্পর্কে বলা হয়েছে। অত্র আইনের  ১ উপধারা অনুসারে, দখল প্রদানের আগে যে কোনো সময়ে দাতা কর্তৃক দান বাতিল করা যেতে পারে। কারণ দখল প্রদানের আগে দান সম্পূর্ণ হয় না। সাধারণত দান বাতিল করতে হলে সেটি দখল অর্পণের আগেই করতে হবে।

আদালতে নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে দানপত্র দলিল বাতিল চাওয়া যাইতে পারে

১। দানপত্র বাতিল হতে পারে যদি প্রমাণিত হয় যে, বলপ্রয়োগ করে অথবা ভয় দেখিয়ে বা অন্যায় প্রভাব খাটিয়ে দানপত্রটি সম্পাদিত হয়েছে।

শুধুমাত্র গ্রহীতার কোন অসততার কারণে অসন্তুষ্ট হয়ে দাতা একতরফা ভাবে দানপত্র বাতিল করতে পারেন না৷

২।  যদি দানপত্র দলিলে এমন কোনও শর্তের উল্লেখ থাকে এবং সেই শর্ত পালনে গ্রহীতা যদি ব্যর্থ হন, তবে দানপত্র বাতিল হতে পারে৷

৩। দখল হস্তান্তরে পূর্বেই কেবল হেবা দলিল বাতিল করা যায়।

তবে  দানপত্রটিকে বাতিল ঘোষণার ক্ষেত্রে  দানপত্রের ওই ধরনের কোনও শর্ত লঙ্ঘন করেছেন কিনা তা প্রমাণ সাপেক্ষ্য।

নিম্নলিখিত ক্ষেত্রগুলো বিদ্যমান থাকিলে, দানপত্র দলিল বাতিল করা যায় না

(ক) সম্পত্তির দাতা-গ্রহীতা স্বামী বা স্ত্রী হইলে।

(খ) গ্রহীতা মৃত্যূবরণ করিলে।

(গ) দাতা-গ্রহীতার মধ্যে বিবাহ অযোগ্য সম্পর্ক বিদ্যমান থাকিলে।

(ঘ) দানকৃত সম্পত্তি গ্রহীতা কর্তৃক বিক্রি বা হস্তান্তরিত হয়ে গেলে।

(ঙ) দানকৃত সম্পত্তি বিলীন বা ধ্বংস হয়ে গেলে।

উল্লেখিত ক্ষেত্রগুলো বিদ্যমান না থাকলে আদালতের মাধ্যমেও দান দলিল বাতিল করা যায়।

মৌখিক দান

সম্পত্তি হস্তান্তর আইন, ১৮৮২ এর ধারা-৯, Oral transfer বা মৌখিক হস্তান্তর – সম্পর্কে বলা হয়েছে,  A transfer of property may be made without writing in every case in which a writing is not expressly required by law. কিন্তু ২০০৫ সালের পরে দানপত্র দলিল বাধ্যতা (এই দলিল ১ জুলাই, ২০০৫ খ্রিস্টাব্দ হতে রেজিস্ট্রেশন আইন, ১৯০৮ এর ১৭(১)(এএ) ধারা সংযুক্তির মাধ্যমে কার্যকর হয়েছে এবং সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ১২৩ ধারা অনুযায়ী দান লিখিত হতে হবে। বর্তমানে দান রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামুলক হবার কারণে দান কোনভাবেই মৌখিকভাবে হবার সুযোগ নেই।

যেহেতু দানপত্র দলিল এখন রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে সেহেতু দানপত্র একবার হয়ে গেলে বাতিল করা সম্ভব নয়। শুধুমাত্র আদালতের মাধ্যমে ইহা বাতিল করা যাবে সেক্ষেত্রে তাকে আদালতে দলিলটি বাধ্যকর নয় মর্মে ঘোষণা চাইতে হবে। কিন্তু ইহা প্রমাণ করা অনেক সময় সাপেক্ষ্য এবং কঠিন কাজ। তাই আমার মতে, যথেষ্ট ভাবনা-চিন্তার পর তবেই দানপত্র করা উচিত। একবার করে ফেললে, এ নিয়ে নতুন করে ভাবনার অবকাশ আর থাকবে না। দানপত্র বাতিল করতে চাইলে বা এই বিষয়ে অগ্রসর হওয়ার আগে অবশ্যই আইনজীবীর পরামর্শ নিয়ে অগ্রসর হওয়া উচিত নয়তো ঝামেলায় পরার আশংকা থেকে যাবে।

লেখক– অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এবং সহযোগী সম্পাদক- লইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম।

ইমেইলrinaparvinmimi18@gmail.com