আবদুল্লাহ আল মামুন, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ

ক্ষতি হয়ে গিয়েছে আমাদের, মূল্যবোধের, বিশ্বাসের…

আবদুল্লাহ আল মামুন:

ভেবেছিলাম কিছুই লিখবো না। কিন্তু, রক্তক্ষরণ থামছে না। মনে হচ্ছে লিখলেই যা দেখছি তা উবে যাবে। রাত পোহালেই মনে হবে এসব অবিশ্বাস্য। জাতির জনককে নিয়ে লেখা গান “যদি রাত পোহালে শোনা যেতো” – আমার অসম্ভব প্রিয়। আমি বার বার এটা শুনি।

এই গানের দুটো লাইন হলো- “যে মানুষ ভীরু কাপুরুষের মতো। করেনিতো কখনো মাথা নত……”

এই লাইনগুলো শোনার সময় মনে হয় জাতির জনক যেন তার অবুঝ, নিষ্পেষিত বাঙালীর যাবতীয় হাহাকার, নিষ্পেষণ, অপ্রাপ্তি, আকাংখা, আশা, অধিকার, মুক্তি, স্বপ্ন, স্বাধীনতা এবং বিদ্রোহসহ সবকিছুকে তার অপার মমতা, ক্ষমা, ভালোবাসা এবং শক্তিতে জড়িয়েছেন মাথা উঁচু করে। মনে হবে যেন নিপীড়িত মানুষকে রক্ষার জন্য, তাদের অধিকারের প্রশ্নের অভিভাবক হয়ে তর্জনী উঁচিয়ে দাঁড়িয়েছেন কোন প্রবল প্রতাপান্বিত শোষকের বিরুদ্ধে। এটা শক্তির, বিশ্বাস এবং আস্থার জায়গা। এই অবস্থান তাঁকে আসীন করেছে অনতিক্রম্য এক উচ্চতায় যেখানে হাজার বছরেও আর কোন বাঙালী পৌঁছাতে পারবে না। বাঙালীর সেই আস্থা, শক্তির জায়গা কোথায় গেলো?

মাঝে মাঝে প্রশ্নের উদ্রেক হয় যে, আমরা আসলে কি? আমরা কি মানুষ নাকি অমানুষ? আমরা কি ধার্মিক নাকি অধার্মিক, কু-ধার্মিক নাকি বকধার্মিক? এ প্রশ্নগুলো বিশ্বাসের সাথে জড়িত। একই সাথে অবিশ্বাসের কিংবা কিছুটা মানবিকতার। যে মানুষ হতে পারেনি, মানবিক হতে পারেনি, ধার্মিক হতে পারেনি -তার কাছে সব কিছুই মূল্যহীন। সেখানে আছে শুধু পার্থিব, লোভ লালসা এবং স্বার্থসিদ্ধি। এই স্বার্থসিদ্ধি, লোভ, লালসা, কামনা বাসনার লেলিহান শিখায় পুড়ে যায় মানুষের স্বপ্ন। আমরা সেটা অনুধাবন করতে পারি শুধুমাত্র সেটারই শিকার হলে। নয়তো আমাদের সুখী সুখী ভাব কখনোই সমাপ্ত হয় না। আমাদের মহান ৭১ তার জ্বলন্ত উদাহরণ। নিপীড়ন,শোষণ,বঞ্চনা আর প্রতিরোধ শেষে মুক্তি পেয়ে আমরা বুঝেছি পাকিস্তানীরা কি ছিলো?

গত কয়েকদিনের তান্ডবলীলায় ইসলাম ধর্ম, সনাতন ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, শিখ ধর্ম, জৈন ধর্ম বা খ্রিস্টান ধর্মের কোন ক্ষতি হয়নি। স্ব স্ব ধর্ম স্ব স্ব জায়গায় বিরাজমান রয়েছে। একইভাবে ক্ষতি হয়নি মহান আল্লাহ, ভগবান, ঈশ্বর কিংবা গড এর। ক্ষতি হয়ে গিয়েছে আমাদের। আমাদের মূল্যবোধের। আমাদের বিশ্বাসের। আমাদের প্রতিরোধের। এই বিষয়গুলো কোন স্বাভাবিক বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির কাছে বোধের অগম্য নয়। আমরা ফ্যানাটিজম লালন করছি। রক্তে ডুকিয়ে নিচ্ছি। তার মাশুল আমাদেরকে অনেক ভাবে দিতে হবে। সমস্যা হলো এই ফ্যানাটিকদের কাছে কোন ধর্মের, বোধের মানুষ নিরাপদ নয়। তারা তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য পৃথিবী পুড়িয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করবে না। সেখানে কোন ধর্ম, মানুষ বা বোধ নেই।

এটাকে ঘৃণা করি বলছি না। শুধু বলছি এই বোধ বাংলাদেশের প্রকৃত নাগরিকদের অজানা। এটা অভিজাত রক্তের কোন বিষয় নয়। এই ধর্মীয় ফ্যানাটিজম এবং সেটাকে জায়গামতো কাজে লাগানো মানুষের অনেক পুরোন স্বভাব। কথিত সংখ্যালঘুদের রক্ষার নির্দেশ বা আশ্বাস সম্পর্কিত ধর্মের বাণী তাই একে রোধ করতে পারেনি। ধর্মের সুন্দর মর্মবাণী তাদের কর্ণকুহরে পৌঁছায়নি। বরং, হয়তো অমানুষদের হাতে আরো চমৎকার অস্ত্র তুলে দিয়েছে। পাশাপাশি বেড়ে উঠা, পড়ালেখা শেখা দুজন ব্যক্তি ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে তাই সম্পূর্ণ অপরিচিত হয়ে যায়। ৪৭ সালে এই উপমহাদেশ সেটি দেখেছে। ধর্মীয় ভাগাভাগিতে দেশ ভাগ হয়েছে। সেটার খুব লাভ হয়েছে। মানুষ গিয়েছে। কিন্তু, জমিতো নিতে পারেনি!! তাই, আমরা ৬৫ এর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পরবর্তীতে শত্রু সম্পত্তি, বাংলাদেশে অর্পিত সম্পত্তি আইন দেখি। এসব আইনের সুবিধা -অসুবিধা দুটোই দেখেছি।

গত কয়েকদিনের তান্ডবলীলায় স্পষ্ট যে, এমন ঘটনা অতীতে যেমন হয়েছে, ভবিষ্যতেও হয়তো হবে। আমি আমার ছেলের ধর্ম সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করি। তার মতে তার ধর্ম (যদিও সে এসবের কিছুই বোঝে না এখনো) সেরা। আমিও একমত হই। একই সাথে এটাও বলি তোমার বন্ধু গোবিন্দের ধর্মও কিন্তু তার কাছে সেরা। তুমি তোমারটা মানবে। গোবিন্দ তারটা। কোন সমস্যা হবে না। তার ছোট্ট মাথায় হয়তো এই বোধ আস্তে আস্তে অনুরণিত হবে। কিন্তু আমাদের পরিণত মাথার কি হবে? গত কয়েকদিনে জড়তা, বিহবলতা কাটিয়ে মুসলিম বন্ধুরা সনাতন ধর্ম অনুসরণ করা বন্ধুদের সহমর্মীতা জানাচ্ছেন, লজ্জিত হচ্ছেন। ক্ষমা চাইছেন। এটা অভাবনীয় দৃশ্য। কিন্তু, এটি কি ক্ষত উপসমের জন্য যথেষ্ট?

উদ্বেগজনক বিষয় হলো-৪৭ এর সর্বনাশা বীজ আবার অংকুরিত হচ্ছে। কেউ যদি ভেবে থাকে সে রক্ষা পাবে- সেটা ভুল। ইতিহাস বলছে সেটা থেকে কারো রক্ষা হবে না। হয় এদেশে, নয়তো অন্য দেশে, কিংবা পরপারে। হয় নিজে নয়তো তার একই বিশ্বাসে বিশ্বাসী ভাই আক্রান্ত হবে। ধার্মিক ব্যক্তিগণ নিশ্চয়ই পরপারের জবাব প্রস্তুত রেখেছেন। কোথায় যেন পড়লাম (ফেসবুকে হুমায়ুন আজাদের উক্তি মনে হয়) নাস্তিকদের সে সমস্যা নেই। তারা কারো মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডা ধবংস করতে যায় না। অনুভূতি খুব ভয়ংকর। ভোঁতা, থেতলে যাওয়া, পুড়ে যাওয়া বিশ্বাস, অবিশ্বাস হয়তো আরো ভয়ংকর। এই বোধে আক্রান্ত ব্যক্তি হয়তো শারিরীকভাবে বেঁচে থাকে। কিন্তু মানসিকভাবে অনেকবার মারা যায়। বার বার মৃত্যুবরণ করে। সেটা মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান, জৈন, শিখ সবার ক্ষেত্রেই সমান। এই জায়গায় কোন ভেদাভেদ নেই। বার বার মরে যাওয়া মানুষেরা বাংলাদেশ, মায়ানমার, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক, ইরান, কাশ্মীর, শ্রীলংকা, আফ্রিকা, ইসরায়েল, ফিলিস্তিন, উইঘুরে আছে। ইচ্ছা হলেই দেখা যায়। এরা দেখতে একই। ধর্মীয় বোধ ভিন্ন। কিন্তু,একই জায়গায় আক্রান্ত। মানুষের মতো। কিন্তু মানুষ নয়। এরা সবাই বৈশ্বিক সংখ্যালঘু। যারা এসব করেছে তাদের চেয়ে বিপরীত শুভ বোধের ধার্মিক মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। সংখ্যাগরিষ্ঠ শুভ বোধের উপরই তাই আস্থা রাখছি। যে মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে তার বিচার হবে। শুভবোধের উদয় হবে। এই রক্তক্ষরণ, জাতীয় লজ্জার পুনরাবৃত্তি হবে না। সংখ্যালঘু বলে কোন শব্দ থাকবে না। প্রকৃতপক্ষেই সবাই স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক এবং অংশীদার হবে। কোন নাগরিক অপমানিত, লজ্জ্বিত, কুন্ঠিত হবে না। আমাদের জাতির জনক এবং সংবিধান প্রণেতারা সেই সোনার বাংলার স্বপ্নই দেখেছিলেন।এটাই বাঙালী জাতির আত্মপরিচয় যা আমাদের রক্তে বহমান। আমরা সেই পরিচয়ে পরিচিত হই।

লেখক- অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ, কক্সবাজার।