বিদায়ী বছরে মাগুরা লিগ্যাল এইড অফিসে ৯৫ শতাংশের বেশি বিরোধ নিষ্পত্তি
আইনগত সহায়তা (প্রতীকী)

আদালতের বাইরে মামলা নিষ্পত্তি স্বস্তি এনেছে লক্ষ্মীপুরের বিচারপ্রার্থীদের জীবনে

রানি (ছদ্মনাম) মায়ের গর্ভে থাকার সময়ই বিচ্ছেদ হয়ে যায় তার বাবা-মায়ের। পৃথিবীতে এসে রানি বাবাকে দেখেনি। বাবা তাকে মেয়ে হিসেবে পরিচয়, ভরণপোষণ ও সামাজিক মর্যাদা দেননি টানা ২০ বছর। বাধ্য হয়ে মায়ের সঙ্গেই বড় হতে থাকে রানি। ১৮ বছর বয়সে তার বিয়ে হয় ফেনী জেলার পরশুরাম উপজেলার রহিমের (ছদ্মনাম) সঙ্গে।

বিয়ের পর রানি তার স্বামীর কাছে পিতৃপরিচয়ের সব ঘটনা খুলে বলেন। সব শুনে রানির স্বামী তাকে লক্ষ্মীপুর জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে নিয়ে যান। মাত্র একটি অভিযোগ আর তিনটি আপস বৈঠকে কোনো ধরনের মামলা ও ডিএনএ টেস্ট ছাড়াই রানির বাবা রানিকে নিজের সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি দেন।

শুধু রানির বিবাদ নয়, দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া ও হয়রানি এড়িয়ে এরকম আরও অনেক বিবাদের মীমাংসা হয়েছে লক্ষ্মীপুর লিগ্যাল এইড অফিসের মধ্যস্থতায়।

লক্ষ্মীপুর জজ আদালতের সিনিয়র সহকারী জজ ও জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার মুহম্মদ ফাহ্‌দ বিন আমিন চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের অফিসে এসে লিগ্যাল এইড সহায়তা পেতে একটি ফরম পূরণ করতে হয়। তারপর আমরা উভয়পক্ষকে সমঝোতার আহ্বান জানাই। তারা পারস্পরিক সমাধানে আগ্রহী হলে আমরা কাজ শুরু করি। একটি মামলার নিষ্পত্তি করতে তিনটি বৈঠক এবং প্রায় তিন মাস সময় লাগে।’

ফাহ্‌দ বিন আমিন চৌধুরী জানান, সংবিধানে প্রত্যেক নাগরিকের সমান আইনগত সহায়তা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। সেজন্য কোনো অসহায় ব্যক্তি যদি এমন কোনো বিপদে পড়েন, যেজন্য তার আইনি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, তখন তিনি জাতীয় হেল্পলাইন নম্বর ১৬৪৩০-এর মাধ্যমেও আইনগত সহায়তা পেতে পারেন।

জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের সংশ্লিষ্ট বিচারিক কর্মকর্তা, বিচারপ্রার্থী এবং সহায়তা পাওয়া কয়েকজন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে এমন আরও বেশ কিছু ঘটনার কথা জানতে পেরেছেন এই প্রতিবেদক।

জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে হালিমা ও সফিক নামের এক বৃদ্ধ দম্পতির সঙ্গে কথা হয়। তাদের বাড়ি সদর উপজেলার দালাল বাজার এলাকায়। সফিক পেশায় একজন রিকশাচালক।

হালিমা (৬০) জানান, ২০ বছর আগে এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে ৬ শতক জমি কিনেছিলেন তারা। কিন্তু কেনার পর থেকে একদিনের জন্যও তারা জমির দখল বুঝে পাননি। জমি বিক্রেতা উল্টো ৭ বছর আগে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। লক্ষ্মীপুর জজ আদালতে ৭ বছরে মামলাটির পেছনে তাদের প্রায় আড়াই লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এ বয়সেও প্রায় প্রতি মাসে আদালতে আসতে হচ্ছে তাদের।

হালিমা বেগম জানালেন, মামলাটি এখন জজ আদালত থেকে লিগ্যাল এইডে স্থানান্তর করা হয়েছে। এবার জমির দখল ও মামলা থেকে মুক্তি পাবেন বলে আশা করছেন হালিমা বেগম।

লক্ষ্মীপুর জজ আদালতের অ্যাডভোকেট রিপন পাটোয়ারী জানান, ভবঘুরে বেদে ও মানতা সম্প্রদায়ের বিয়ের কোনো লিখিত দলিল বা কাবিননামা থাকে না। তাদের বিয়ের একমাত্র প্রমাণ জীবিত ছেলেমেয়ে। সন্তান না থাকলে স্বামীর দ্বারা নিগৃহীত হলে স্ত্রী কোনো আইনি সহায়তা পায় না।

আবার চেয়ারম্যান সনদ বা নাগরিকত্ব কার্ড না থাকলে এ সম্প্রদায়ের নারীরা পারিবারিক সহিংসতার শিকার হলেও তেমন কোনো আইনি সহায়তা পায় না। কারণ প্রচলিত আদালতে কাগজপত্র ও প্রমাণ ছাড়া আইনি সহায়তা পাওয়া সম্ভব নয়। সে কারণে এ সম্প্রদায়ের অলিখিত আইনের সহায়তার একমাত্র আশ্রয়স্থল লিগ্যাল এইড।

লক্ষ্মীপুর জজ আদালতের সিনিয়র সহকারী জজ ও জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার মুহম্মদ ফাহ্‌দ বিন আমিন চৌধুরী জানান, লিগ্যাল এইড অফিসের মাধ্যমে নিম্ন আদালত এবং উচ্চ আদালতে বিচারপ্রার্থী ও অসহায় কারাবন্দিরা সরকারি খরচে আইনি সেবা পান. এছাড়াও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে এবং লিগ্যাল এইড অফিসের মধ্যস্থতায় প্রতিদিনই অসংখ্য অসহায় সহায়তা মানুষ নিচ্ছেন।

আইনগত সহায়তা প্রদান আইন ২০০০-এর ২১(ক) ধারা এবং বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি বিধিমালা ২০১৫-এর ১৬ নং বিধি অনুযায়ী অসহায় মানুষকে বিনা পয়সায় আইনি সহায়তা দেয় বিভিন্ন জেলার লিগ্যাল এইড অফিসগুলো। সে কারণে বহু অসহায় মানুষ নির্ভয়ে বিচারের জন্য চলে আসছে লিগ্যাল এইড অফিসে।

জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের তথ্য অনুসারে, লক্ষ্মীপুর জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের মাধ্যমে প্রতি মাসে প্রায় ৫০টি মামলা ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি করা হয়।

২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩০০-র বেশি মামলায় আইনি সহায়তা দিয়েছে লক্ষ্মীপুর জেলা লিগ্যাল এইড। এর মধ্যে ২৮১টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। আর বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে ২৫৯টি অভিযোগে ২০ লাখ টাকার বেশি আদায় করে দেওয়া হয়েছে।