বিচারপতি কে. চান্দ্রু (বামে) এবং জয় ভিম সিনেমার পোস্টার (ডানে)

বিচারপতি কে. চান্দ্রুর ওকালতি জীবনের গল্প নিয়ে তামিল ছবি ‘জয় ভিম’

ভারতের দলিত সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার-নিপীড়নের ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত তামিল ছবি ‘জয় ভিম’। মুক্তির পর দর্শক-সমালোচকদের কাছ থেকে ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে। ইতোমধ্যে ইন্টারনেট মুভি ডেটাবেইজ-এর (আইএমডিবি) দর্শক রেটিংয়ের শীর্ষে পৌঁছে গেছে তামিল ভাষার চলচ্চিত্র এই চলচ্চিত্রটি।

কিন্তু এই ‘জয় ভীম’ ছবি ঘটনা কিন্তু কেবলই সিনমার গল্প নয়। বাস্তব জীবন থেকেই পর্দায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই গল্প। ছবিটিতে উকিল চান্দ্রু হিসেবে তামিল সুপারস্টার সুরিয়া শিবকুমার অভিনয় করেছেন। বাস্তব জীবনে বিচারপতি কে. চান্দ্রুর জীবনের গল্প অবলম্বনে বানানো হয়েছে এই ছবি।

বাস্তব আজীবন নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর অধিকারের জন্য লড়ে গেছেন বিচারপতি কে চান্দ্রু। প্রথম জড়িত ছিলেন বাম রাজনীতিতে। ছাত্রাবস্থায়ই তিনি জড়িয়ে পড়েন ছাত্র-কর্মচারীদের অধিকার আদায়ে।

কে. চান্দ্রুর জন্ম ১৯৫১ সালে, তামিলনাড়ুর তিরুচিরাপল্লির এক রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত পরিবারে। বাবা ছিলেন রেলওয়ের কর্মচারী, ছোটবেলায়ই মাকে হারান। চান্দ্রুর শৈশব কেটেছে চেন্নাইয়ে। শহরটিতে তখন তীব্র খাদ্যাভাব। খাবার কেনার জন্য সারা রাত লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো রেশনের দোকানে। ভোর ৪টা পর্যন্ত লাইনে দাঁড়াত শিশু চান্দ্রু, এরপর এসে তার জায়গা নিত অন্য ভাইবোনেরা।

শৈশব থেকেই দক্ষ রাজনীতিবিদদের বক্তৃতা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতেন চান্দ্রু। চান্দ্রু যখন চেন্নাইয়ের লয়োলা কলেজে উদ্ভিদবিজ্ঞানে বিএসসি করতে ভর্তি হন, তামিলনাড়ুর ক্ষমতায় তখন দ্রাবিড়া মুনেত্রা কালাগাম (ডিএমকে)। তখন শহরের ডিএমকের সমর্থনে ছাত্রবিক্ষোভ নিয়মিত ঘটনা। এর কদিন পরই ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে এক মিছিলের আয়োজন করেন।

১৯৬৮ সালে বেতন নিয়ে বিবাদের জেরে কিলাভেনমানিতে দলিত সম্প্রদায়ের ৪৪ জনকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনা নিয়ে উত্তাল হয়ে ওঠে তামিলনাড়ু। এই অন্যায়ের প্রতিবাদে আন্দোলন গড়ে তোলার সুযোগ খুঁজতে থাকেন চান্দ্রু। তখন যোগ দেন কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়াতে (মার্ক্সিস্ট)।

আইন কলেজে চান্দ্রু যখন তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত, তখন তামিলনাড়ুতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। তখন হোস্টেল ছেড়ে দিয়ে ধর্মঘটে যোগ দেন চান্দ্রু। ওই সময়ই আইন পেশায় আসার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন তিনি।

রাও অ্যান্ড রেড্ডিতে যোগ দেওয়ার ক’দিন পরই মাদ্রাজ হাইকোর্টে এক বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেন তিনি। জরুরি অবস্থার পর মুক্ত নির্বাচনের দাবিতে প্রথমবারের মতো বিক্ষোভ মিছিল বের করেন তারা। আট বছর পর রাও অ্যান্ড রেড্ডি ছাড়েন চান্দ্রু। নিজেই চেম্বার খোলেন।

উকিলদের কয়েকটি বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিলেও পরে তিনি এরকম বিক্ষোভের বিরোধী হয়ে ওঠেন। তার মতে, আদালত বয়কট করে কোনো সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। চান্দ্রু ঘোষণা করেন, আদালত মামলাকারীদের, উকিলদের নয়।

‘জয় ভীম’-এর একটি দৃশ্যে চান্দ্রুর এই মতাদর্শ বদলের অধ্যায়টি দেখানো হয়েছে। ছবিতে এক জায়গায় দেখা যায় উকিলদের বিক্ষোভ চলাকালেই পুলিশ ব্যারিকেড টপকে সুরিয়া আদালতকক্ষে ফিরে যান, একটি মামলায় লড়ার অন্য। ৪১ বছর বয়সে প্রেম করে বিয়ে করেন চান্দ্রু।

১৯৯৬ সালে চান্দ্রু সিনিয়র আইনজীবী হন। তখন থেকে তিনি আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে ক্রিমিনাল কেস নিতে থাকেন। বেশ কিছু মানবাধিকারের মামলা নেন চান্দ্রু। এসব কেসের বদৌলতে বহুবার তৎকালীন জয়ললিতা সরকারের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে নামতে হয় তাকে।

ওই সময়ই আদিবাসী নারী পার্বতী রাসাকান্নুর মামলা হাতে নেন চান্দ্রু। এই মামলার ঘটনা থেকেই অনুপ্রাণিত ‘জয় ভীম’। পার্বতীর স্বামী রাজাকান্নু ছিলেন আন্দাই কুরুম্বার গোত্রের সদস্য, পেশায় বাঁশের ঝুড়ি নির্মাতা ও কৃষি শ্রমিক। যে বাড়িতে কাজ করতেন, সেখান থেকে গয়না চুরির অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তিনি।

পুলিশ হেফাজতে অত্যাচারে রাজকান্নু মারা যান। এই অপরাধ ধামাচাপার দেওয়ার জন্য স্থানীয় পুলিশ রাতের আঁধারে রাজকান্নুর মরদেহ সরিয়ে ফেলে। লাশ ফেলে দেয় পার্শ্ববর্তী তিরুচিরাপল্লি জেলায়। পরে দাবি করে যে, রাজকান্নু তাদের হেফাজত থেকে পালিয়ে গেছে।

কিন্তু পুলিশের গল্প বিশ্বাস করেননি রাজকান্নুর স্ত্রী পার্বতী। স্বামীকে খুঁজে বের করতে সাহায্যের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরতে একসময় সন্ধান পান কে. চান্দ্রুর। পার্বতীর ন্যায়বিচার পাওয়ার যাত্রায় পথে নামেন তিনিও।

মাদ্রাজ হাইকোর্টে হিবিয়াস কর্পাস পিটিশন করেন চান্দ্রু। দীর্ঘ ১৩ বছরের আইনি যুদ্ধের পর আদালত রায় দেন যে, এটি পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর মামলা। রাজকান্নুকে নির্মমভাবে হত্যার জন্য অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

মামলা চলাকালে পার্বতী ও চান্দ্রুকে ঘুষ দেওয়ার চেষ্টা করেছে পুলিশ। সেই প্রলোভনে টলেননি চান্দ্রু, টাকাভর্তি সুটকেস ছুড়ে ফেলেছেন। শুধু পার্বতী নয়, এরকম আরও সহস্র প্রান্তিক ও নিপীড়িত অসহায় মানুষকে ন্যায়বিচার পাইয়ে দিতে সহায়তা করেছেন বিচারপতি কে. চান্দ্রু।

দীর্ঘদিন আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ২০০৬ সালে চান্দ্রু মাদ্রাজ হাই কোর্টে বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান। যদিও তামিলনাড়ুর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা তাকে বিচারক নিয়োগ দেওয়ার বিরোধিতা করেছিলেন। চান্দ্রুকে ‘সন্ত্রাসী উকিল’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন জয়ললিতা।