দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)

দুদকের এক-চতুর্থাংশ অনুসন্ধান ও তদন্ত মেয়াদোত্তীর্ণ

ঘটনা-১

রাজধানীর বনশ্রীতে সরকারি রেকর্ডকৃত রাস্তার জায়গার ওপর ‘শীতল গ্রান্ড প্যালেস’ নামে ইমারত নির্মাণের কাজ করা হয়। অভিযোগটি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) হটলাইনে কল করে জানান ভুক্তভোগীরা। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ১৮ জুলাই দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম সেখানে অভিযান চালায়।

অভিযানের সময় রেকর্ডকৃত রাস্তার কিছু অংশ চলাচলের জন্য অবমুক্ত করে দেওয়া হয়। পরে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নকশা অমান্য করে ভবন নির্মাণের কারণে সংশ্লিষ্টদের চূড়ান্ত নোটিশও করা হয়। নোটিশ অমান্য করলে রাজউকের অথরাইজড অফিসারকে ভবনের নির্মিত অংশ উচ্ছেদের কথাও বলা হয়। অভিযানের পর এ বিষয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধান শুরু করে দুদক, যা অদ্যাবধি শেষ হয়নি।

ঘটনা-২

২০১৯ সালে ১ অক্টোবর সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আসিফ ইমতিয়াজের বিরুদ্ধে ঘুস-দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। ‘গার্লফ্রেন্ডের’ ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করে ব্যাংক হিসাব খোলা এবং সেখানে অবৈধভাবে অর্থ জমা রাখার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। এ অনুসন্ধান কাজটিও এখন পর্যন্ত শেষ করতে পারেনি দুদক।

শুধু উল্লিখিত দুই অভিযোগের ক্ষেত্রেই নয়, এই মুহূর্তে দুদকের এক-চতুর্থাংশ অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রমই মেয়াদোত্তীর্ণ। বিদ্যমান আইনের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ২৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ অনুসন্ধান এবং ১৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ মামলার তদন্ত কার্যক্রম শেষ হয়নি। মেয়াদোত্তীর্ণ মোট অনুসন্ধান ও মামলার তদন্তের হার ২৪ দশমিক ৫০ শতাংশ। চলতি বছরের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত দুদকের মেয়াদোত্তীর্ণ অনুসন্ধান ১১১৯টি এবং মেয়াদোত্তীর্ণ তদন্ত ২০৩টি।

দুদকের তদন্তে এমন ধীরগতিতে সম্প্রতি এক রায়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। জানতে চাইলে দুদকের সাবেক মহাপরিচালক (লিগ্যাল) ও সাবেক জেলা জজ মো. মঈদুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, মেয়াদোত্তীর্ণ অনুসন্ধান ও তদন্তের ক্ষেত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তার চেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও কমিশন বেশি দায়ী। এক্ষেত্রে মহাপরিচালক কিংবা কমিশনকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। কারণ কমিশন তদন্তকারী কর্মকর্তা (উপসহকারী পরিচালক, সহকারী পরিচালক, উপপরিচালক, পরিচালক) ও তদারককারী কর্মকর্তাদের (উপপরিচালক, পরিচালক, মহাপরিচালক) বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করে না।

দুদক কমিশনার ড. মোজাম্মেলক হক খান বলেন, এখন পর্যন্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। তবে মেয়াদোত্তীর্ণ অনুসন্ধান ও তদন্তের বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। আমরা দেখছি এর সংখ্যা কেমন, সমস্যা কোথায়, সমস্যা থাকলে তা কোন পর্যায়ে আছে। এটার জন্য একটা গবেষণা শুরু করা হয়েছে। দীর্ঘদিনের কিছু ভুলভ্রান্তি রয়েছে। আমরা চাই একটা শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে। দেশের স্বার্থেই আইনানুগভাবে দুদকের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নানা কারণে অনুসন্ধান ও তদন্তে সময়োত্তীর্ণ হতেই পারে। আমরা ব্যুরোর আমলের মামলাগুলোও এখনো তদন্ত করছি। অনুসন্ধান ও তদন্তে যদি কোনো কর্মকর্তার বড় ধরনের গাফিলতি থাকে এবং তারা যদি উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত ক্ষতিকারক কাজ করে থাকে, তবে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

অনুসন্ধান ও তদন্তের সময়সীমা

কমিশন আইনের ২০(ক) ১ ও ২ উপধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ ১৮০ দিনের মধ্যে তদন্তকাজ শেষ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্ত শেষ করতে ব্যর্থ হলে ৯০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে নতুন করে তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করতে পারে কমিশন। আর ২০০৭ সালের দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালার ৭ বিধিতে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তাকে নির্দেশ পাওয়ার পর সর্বোচ্চ ৪৫ দিনের মধ্যে অনুসন্ধান কাজ শেষ করতে বলা হয়েছে।

এই সময়ের মধ্যে অনুসন্ধান কাজ শেষ করতে না পারলে যুক্তিসংগত কারণ উল্লেখ করে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা আরও ৩০ দিন সময় নিতে পারবেন। আর ২০(খ) অনুযায়ী, তদন্তে দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অদক্ষতার অভিযোগে কমিশন আইন বা প্রযোজ্য আইন অনুযায়ী বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে পারবে কমিশন। ২০০৪ সালের দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের ১৯ ও ২০ ধারায় অনুসন্ধান ও তদন্তের ক্ষেত্রে দুদককে বিশেষ ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে। তবে কমিশন ব্যর্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে নজির সৃষ্টি করতে পারেনি বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের।

বিলম্বের কারণ

তবে দুদক সংশ্লিষ্টদের অভিমত-দুর্নীতির অনুসন্ধান ও মামলার তদন্ত কার্যক্রম আইনে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ না করার পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ দুটি। প্রথমটি হলো-কমিশনের জনবল সংকট। বর্তমানে কমিশনে অনুসন্ধান ও তদন্তকারী কর্মকর্তা রয়েছেন প্রায় ২০০ জন। আর জনপ্রতি তাদের কাঁধে ৩০টি অনুসন্ধান ও তদন্তের দায়িত্ব রয়েছে। ফলে নির্ধারিত সময়ে সব কাজ শেষ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন কর্মকর্তারা।

এছাড়া দ্বিতীয় কারণটি হলো অন্যান্য সংস্থা ও সংশ্লিষ্টদের অসহযোগিতা। দুদকের মামলা করতে হয় তথ্যপ্রমাণভিত্তিক। এজন্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট অনুসন্ধান ও তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সংগ্রহ করা আবশ্যক। তবে অনেক ক্ষেত্রে চাহিদা অনুসারে তথ্য সরবরাহ করে না সরকারের অন্য দপ্তরগুলো। ফলে সংগত কারণেই অনুসন্ধান ও তদন্ত বিলম্ব হয়।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুদকের সামর্থ্য ও সক্ষমতার তুলনায় দেশে দুর্নীতির অভিযোগ এবং এ সংক্রান্ত মামলা অনেক বেশি। আধুনিক প্রযুক্তিগত জ্ঞানসম্পন্ন জনবলের ঘাটতি রয়েছে। এ ঘাটতি পূরণ করতে হবে। এছাড়া দুদক থেকেও অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করা হয় যে, দুদকের কর্মকর্তাদের একাংশের মধ্যে অনিয়ম-দুর্নীতি বিরাজ করছে।

কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এলে একশ্রেণির দুদক কর্মকর্তা সেটাকে সুযোগ হিসাবে দেখেন এবং তারা অনৈতিক সুবিধা নিয়ে ছাড় দেন। তিনি বলেন, দু-একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। দুদকের কর্মকর্তা যারা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়বে, তাদের জন্য দুর্নীতির কারণে যে ধরনের শাস্তি দেওয়া হয়, তেমন পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। কমিশন এ বিষয়টি অনুধাবন করা সত্ত্বেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।

হাইকোর্টের অসন্তোষ

অনুসন্ধান বা তদন্ত আইনে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে শেষ করার ক্ষেত্রে দুদকের ‘ইতিবাচক’ কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না বলে মনে করছেন হাইকোর্ট। বিশেষ বিধান থাকার পরও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অনুসন্ধান-তদন্ত শেষ না করায় সংশ্লিষ্ট অনুসন্ধান বা তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। সম্প্রতি এমন পর্যবেক্ষণ এসেছে উচ্চ আদালতের এক রায়ে।

হাইকোর্ট বলেছেন, দুদক আইনের ৩২ ধারা ও বিধি ১৫ অনুযায়ী কমিশনের উচিত নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে অভিযোগের অনুসন্ধান বা তদন্ত শেষ করে অভিযুক্তকে বিচারের আওতায় আনা। দক্ষতার সঙ্গে বিচারকাজ শেষ করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। গত ২৪ জানুয়ারি দুদকের মামলায় এক আসামির অব্যাহতির আদেশ বাতিল করে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি মহি উদ্দিন শামীম হাইকোর্ট বেঞ্চ মৌখিকভাবে রায় দেন।

২৪ আগস্ট সেই পূর্ণাঙ্গ রায় সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। সেখানে এসেছে এসব পর্যবেক্ষণ। রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, কমিশনের উচিত নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে অভিযোগের অনুসন্ধান বা তদন্ত শেষ করে অভিযুক্তকে বিচারের আওতায় আনা এবং দক্ষতার সঙ্গে বিচারকাজ শেষ করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। তাহলেই দুর্নীতি ও দুর্নীতিচর্চা নির্মূল হবে। যদি কমিশনের কোনো কাজ, আদেশ, কার্যপ্রণালি এবং নিষ্ক্রিয়তা সংশ্লিষ্ট আইনের উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে এবং দেশের দুর্নীতি প্রতিরোধে কমিশন যদি যথাযথ ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে নীরবতা অবলম্বন করে, তবে সব প্রচেষ্টাই ব্যাহত হবে।

সূত্র: যুগান্তর