সাঈদ আহসান খালিদ
সাঈদ আহসান খালিদ; সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

নাসির-তামিমা-রাকিব-সুবাহ-ইলিয়াস-কারিন: মুসলিম বিবাহ আইনের গুরুত্বপূর্ণ কেস স্টাডি

সাঈদ আহসান খালিদ:

১.

ক্রিকেটার নাসিরের সাথে প্রেম ছিল নায়িকা সুবাহ’র। কিন্তু নাসির বিয়ে করে তামিমা কে। এটি নাসিরের প্রথম বিয়ে হলেও তামিমার দ্বিতীয় বিয়ে, মতান্তরে তৃতীয় বিয়ে। প্রেমের প্রতারণার অভিযোগে জনতার আদালতে বিচার চেয়েছিল সুবাহ।

২.

তামিমা-কে নিজের স্ত্রী দাবি করেন রাকিব। সেই সংসারে তাদের একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। কিন্তু রাকিবের সাথে আইনগত বিবাহ বিচ্ছেদ সম্পন্ন না করেই তামিমা নাসিরকে বিয়ে করে ফেলেছেন। তামিমার বিরুদ্ধে জাল তালাকনামা তৈরির অভিযোগও ওঠেছে। এক্ষেত্রে রাকিব জনতার আদালতে বিচার চেয়ে ক্ষান্ত হননি, আদালতে নাসির-তামিমার বিরুদ্ধে অন্যের বৈধ স্ত্রীকে অবৈধভাবে বিয়ের দায়ে মোকদ্দমা দায়ের করেছেন। পিবিআই তদন্ত প্রতিবেদনে জানিয়েছে, রাকিবের অভিযোগ সত্য- নাসিরের সাথে তামিমার বিবাহ বেআইনিভাবে সম্পন্ন হয়েছে। বিষয়টি এখনো আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় বিচারাধীন।

৩.

সম্প্রতি আদালতে তামিমা ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতির একটি আবেদন পেশ করেছেন এই গ্রাউন্ডে যে তিনি গর্ভবতী, কিন্তু আদালত সেটি গ্রহণ করেননি। নাসির-তামিমা বিগত ১০ মাস ধরে একত্রবাস করছেন। তামিমার অনাগত সন্তানের পিতৃত্ব ডি-ফ্যাক্টো অর্থে তাই নাসিরের, কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে মুসলিম বিবাহ আইন অনুসারে তামিমা ও রাকিবের বিয়ে বহাল আছে বিবেচনা করলে এই অনাগত সন্তানের আইনগত পিতৃত্ব রাকিবের ওপরেই বর্তায়। অবশ্য রাকিব প্রশ্ন তুলতে পারেন, বিবাহিত দম্পতি হিসেবে তাদের মিলনের সুযোগ ছিলো না- এই সন্তান তাঁর নয়৷ সন্তানের পিতৃত্ব নির্ধারণে এই প্র‍্যাগনেন্সি ডেভেলপমেন্ট গভীর আইনগত জটিলতা সৃষ্টি করবে যা ভবিষ্যতে আদালত কর্তৃক নিষ্পত্তি হবে হয়তো।

৪.

অন্যদিকে নাসিরের প্রেমিকা সুবাহ বিয়ে করেছে গায়ক ইলিয়াস-কে। সুবাহ-র এটি প্রথম বিয়ে হলেও ইলিয়াসের তৃতীয় বিয়ে। ইলিয়াসের বিরুদ্ধে এখন তাঁর আগের স্ত্রী কারিন অভিযোগ এনেছেন যে, ইলিয়াস কারিন-কে ডিভোর্স না দিয়ে এবং তাঁর পূর্ব অনুমতি ছাড়াই সুবাহ-কে বিয়ে করেছেন। অন্যদিকে সুবাহ দাবি করছেন, ইলিয়াস ও কারিনের বিয়ে আইনগতভাবে সম্পন্ন হয়নি, সেই বিয়ের কোন রেজিষ্ট্রেশন নেই, তাই বিয়েটি অবৈধ ছিল। এই জটিলতা ঘিরে ইলিয়াস-সুবাহ-র দাম্পত্য কলহ চরমে ওঠেছে, নতুন সংসারও ভাঙার উপক্রম। খবরে জানা যায়, কারিন ইলিয়াস-সুবাহ’র বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

৫.

দেখা যাচ্ছে, নাসির- তামিমা- রাকিব- সুবাহ- ইলিয়াস- কারিন সবাই এখানে পরষ্পর গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। এই কেস স্টাডি মুসলিম বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ ও সন্তানের পিতৃত্ব নির্ধারণ সংক্রান্ত আইনশিক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হতে পারে। মুসলিম পারিবারিক আইনের সাথে এখানে বিজড়িত হয়েছে জাল-জালিয়াতি ও প্রতারণার মতো ফৌজদারি উপাদানও। বিয়ে সংক্রান্ত প্রতারণার ঘটনা বর্তমানে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে যার মধ্যে স্বামী কিংবা স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থায় পরবর্তী বিয়ের অভিযোগ সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। এসব প্রতারণামূলক বিয়ের ঘটনা থেকে বিভিন্ন সামাজিক অস্থিরতা, পারিবারিক জটিলতা ও সহিংসতার সৃষ্টি হয় যা বেশিরভাগ সময় আদালতে মোকদ্দমা অব্দি গড়ায়। বাংলাদেশে বিয়ে ও বিয়ে-বিচ্ছেদ পারিবারিক ধর্মীয় আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত কিন্তু বিয়ে সংক্রান্ত ফৌজদারি অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় দণ্ডবিধি প্রযোজ্য হয়।

৬.

মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী, প্রথম স্বামীর সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্ক বিদ্যমান থাকাবস্থায় স্ত্রী যদি পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, তাহলে সেই দ্বিতীয় বিয়ে অবৈধ, অকার্যকর ও বাতিল বলে গণ্য হবে। স্ত্রী দ্বিতীয় বিয়ে করতে ইচ্ছুক হলে তাঁকে আবশ্যিকভাবে আগে প্রথম স্বামীর সাথে বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করতে হবে। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ অনুসারে প্রথম স্বামীকে তালাকের নোটিশ প্রদানপূর্বক ৯০ দিন পর তালাক কার্যকর হওয়া সাপেক্ষে নির্দিষ্ট ইদ্দতপালন শেষে দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করা যেতে পারে। এই বিধান লঙ্ঘন করে প্রথম স্বামীর সাথে বিয়ে বলবৎ থাকাবস্থায় স্ত্রী যদি স্বামীর জিম্মা থেকে পালিয়ে গিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করেন সেক্ষেত্রে প্রথম স্বামী সেই স্ত্রীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করতে পারেন যার ফলে অভিযুক্ত স্ত্রী বাংলাদেশের ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৪৯৪ ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড পেতে পারেন, সাথে অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।

তবে দণ্ডবিধির ৪৯৪ ধারার এই বিধানের ব্যতিক্রম হতে পারে যদি সেই স্ত্রী তার পূর্বের স্বামীর সাত বছর যাবত কোন খোঁজ-খবর না পান, অথবা তিনি জীবিত থাকতে পারেন এমন কোন তথ্য যদি জানা না যায়, তাহলে পরবর্তী স্বামীকে আসল ঘটনা জানিয়ে তাঁর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারেন। অর্থাৎ, এই ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে স্ত্রীর দ্বিতীয় বিয়ে শাস্তিযোগ্য হবে না।

৭.

স্ত্রী যদি দ্বিতীয় বা পরবর্তী বিয়ে করার সময় যাকে বিয়ে করছেন তাঁর কাছে পূর্বের বিয়ের কথা গোপন করেন এবং দ্বিতীয় বা পরবর্তী স্বামী তা জানতে পারেন তাহলে সেটি দণ্ডবিধির ৪৯৫ ধারা অনুসারে একটি অপরাধ যার ভিত্তিতে অপরাধীকে সর্বোচ্চ দশ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড প্রদান করা হবে, সাথে অর্থদণ্ডও প্রযোজ্য হবে।

৮.

অন্যের স্ত্রী জানা সত্ত্বেও কোন বিবাহিত নারীকে কোন পুরুষ যদি ফুসলিয়ে বা প্ররোচনার মাধ্যমে যৌনসঙ্গম করার উদ্দেশে কোথাও নিয়ে যায় বা একই উদ্দেশে কোথাও আটকে রাখে তাহলে সেটি একটি অপরাধ যা দণ্ডবিধির ৪৯৮ ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডনীয়, অথবা অর্থদণ্ড কিংবা উভয়দণ্ডে দণ্ডনীয় হবে।

৯.

দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারায় ব্যভিচারের শাস্তির উল্লেখ করা হয়েছে। যদি কোনো ব্যক্তি কোনো বিবাহিত নারীর সঙ্গে তার স্বামীর সম্মতি ব্যতীত যৌনসঙ্গম করে এবং অনুরূপ যৌনসঙ্গম যদি ধর্ষণের অপরাধ না হয়, তাহলে সে ব্যক্তি ব্যভিচারের দায়ে দায়ী হবে, যার শাস্তি পাঁচ বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডসহ উভয় দণ্ড। তবে ব্যভিচারের ক্ষেত্রে স্ত্রীলোকটির কোনো শাস্তির বিধান আইনে নেই।

পরিশেষে বলা যায়, বিয়ে কোন গেমস নয়। এটি একটি পবিত্র ধর্মীয় কর্তব্য ও আইনগত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিয়ে ও বিচ্ছেদ নিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বিয়ে-কে যেন খেলায় ও বিনোদনে পরিণত করা হচ্ছে। এই অপচর্চা রোধ করতে হবে। বাংলাদেশে বিবাহ নিবন্ধনের আইনি বাধ্যবাধকতা সত্ত্বেও অনলাইন বা ডিজিটাল বিবাহ নিবন্ধন ব্যবস্থা না থাকায় অনেকে এই সুযোগে বিয়ে সংক্রান্ত প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে থাকেন যা বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যে কোন বিয়ের ক্ষেত্রে বিয়ের সংশ্লিষ্ট পক্ষকে সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে, বিয়ের নিবন্ধন নিশ্চিত করতে হবে, বিয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি-বিধান সম্বন্ধে সজাগ থাকতে হবে। ধর্মীয়, সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ ধারণ করতে হবে এবং বিয়ে সংক্রান্ত প্রতারণার শিকার হলে আইনের আশ্রয় নিতে হবে, তাহলেই এই ধরণের অপরাধের প্রতিরোধ করা সম্ভব বলে আশা করা যায়।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।