সালতামামি-২০২১: বিচারক সমাচার
সালতামামি-২০২১: বিচারক সমাচার

সালতামামি-২০২১: বিচারক সমাচার

করোনা মহামারির প্রভাবে ২০২১ সালেও আদালতসমূহে বিচারকাজ খানিকটা ব্যাহত হয়েছে। এরমধ্যেও বছরব্যাপী বিভিন্ন আদেশ ও রায় প্রদান করেছেন উচ্চ ও অধস্তন আদালতের বিচারকগণ। তবে উল্লেখযোগ্য সেসব রায় ছাপিয়ে আলোচনায় ছিল বিচারকাজে যুক্ত বিচারক সম্পৃক্ত বেশকিছু বিষয়। এরমধ্যে দেশের ২২তম প্রধান বিচারপতির অবসর, নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. ইমান আলীর ছুটি, দুর্নীতির দায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতির সাজা ও বিচারিক ক্ষমতা হারানো অধস্তন আদালতের এক বিচারকের ইস্যু নিয়েও কম আলোচনা হয়নি। বিচারকদের সেসব ঘটনাবহুল খবরগুলো একত্র করে সালতামামি-২০২১ এর এই পর্ব সাজানো হয়েছে।

নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগ

বছর শেষ হওয়ার একদিন আগে ৬৭ বছর পূর্ণ হওয়ায় অবসরে গেছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। ওই দিনই রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ নতুন প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দিয়েছেন হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীকে। শুক্রবার (৩১ ডিসেম্বর) তিনি দেশের ২৩তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নিয়েছেন। ২০২৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর তিনি অবসরে যাবেন।

আপীল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলীকে ডিঙ্গিয়ে হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগে ফের ভঙ্গ হল জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের প্রথা। এ নিয়ে দেশের ইতিহাসে প্রধান বিচারপতি নিয়োগে নবম বারের মতো সিনিয়রিটিকে ছাপিয়ে জয় হল সুপারসিডের।

এদিকে বিচারাঙ্গনে অনিয়ম-দুর্নীতি, সমস্যা যা-ই থাকুক, তা নিরসনে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। সেই সাথে বিচার বিভাগকে এগিয়ে নিতে সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি।

দেশের ২৩ তম প্রধান বিচারপতি নিয়োগ পাওয়ার পর এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি এসব কথা জানান। প্রধান বিচারপতি বলেন, বিচারাঙ্গনের যারা আছেন, তাদের পাশাপাশি দেশবাসীরও সহযোগিতা প্রয়োজন। সবার সহযোগিতা চাই। তাহলে কিছুটা হলেও বিচার বিভাগকে এগিয়ে নেওয়া যাবে।

দেশের ২২তম প্রধান বিচারপতির অবসর

সংবিধান অনুসারে বয়স ৬৭ বছর পূর্ণ হওয়ায় অবসরে যান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। গত বৃহস্পতিবার (৩০ ডিসেম্বর) অফিসিয়ালি সুপ্রিম কোর্টে তাঁর শেষ কার্যদিবস ছিল। তবে এরও আগে গত ১৫ ডিসেম্বর শেষ বিচারিক কর্মদিবস পালন করেন বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন।

গত ১৯ ডিসেম্বর থেকে সুপ্রিম কোর্টে শুরু হয় অবকাশ। এর ফলে অবকাশে বসেনি আপিল বিভাগ। তাই দেশের ২২তম প্রধান বিচারপতিকে গত ১৫ ডিসেম্বর শেষ বিচারিক কর্মদিবসে বিদায় সংবর্ধনা দেওয়া হয়।

তবে বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠান নিয়েও সুপ্রিম কোর্টে নাটক কম হয়নি। শেষ কর্ম দিবসে সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি আওয়ামীপন্থী অংশের পক্ষ থেকে বিদায় সংবর্ধনা দেওয়া হয়। অন্যদিকে অবমূল্যায়নের অভিযোগ এনে প্রধান বিচারপতির সংবর্ধনা বর্জন করেন আইনজীবী সমিতির বিএনপিপন্থী অংশ।

এমনকি প্রধান বিচারপতির বিদায় অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে সুপ্রিম কোর্টে ধাক্কাধাক্কিতে জড়িয়েছেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। যদিও পরবর্তীতে এ নিয়ে তেমন বাড়াবাড়ি দেখা যায়নি, পরিস্থিতি শান্তই ছিল।

প্রসঙ্গত, দেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এস কে সিনহা) পদত্যাগ করার ৮৫ দিনের মাথায় ২২তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে নিয়োগ দেওয়া হয়।

২০১৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি প্রধান বিচারপতি হিসেবে তাঁকে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। পরের দিন বঙ্গভবনে প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন তিনি।

ছুটিতে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি

নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগের পর ছুটিতে গেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী। তবে কতদিনের জন্য তিনি ছুটিতে গেছেন সে বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

এদিকে আগামীকাল রোববার (২ জানুয়ারি) অবকাশ শেষে সুপ্রিম কোর্টের নিয়মিত বিচারিক কার্যক্রম শুরু হবে। সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে রোববারের (২ জানুয়ারি) জন্য প্রকাশিত কার্যতালিকায় (কজলিস্টে) বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলীর নাম নেই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইনাঙ্গনের কারো কারো ধারণা বিচারপতি ইমান আলীর আচনক এই ছুটির নেপথ্যে প্রধান বিচারপতি নিয়োগে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন। কেননা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি ইমান আলী ছিলেন সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ বিচারপতি।

আর এমন ধারণার পেছনের যুক্তি কিংবা নজিরও যে নেই তাও কিন্তু নয়। কারণ গত এক দশকে আপিল বিভাগে বিচারপতি নিয়োগে সুপারসিডের একাধিক ঘটনা ঘটেছে। ২০১১ সালে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হককে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়। এপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগের দুই বিচারপতি বিচারপতি মো. আব্দুল মতিন ও বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান ছুটিতে যান। একইভাবে বিদায়ী প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে ২০১৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি নিয়োগ দেওয়া হলে বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্‌হাব মিয়া পদত্যাগ করেন।

সাবেক প্রধান বিচারপতির সাজা

গত বছরের আলোচনার শীর্ষে ছিল দুর্নীতির মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার দণ্ডিত হওয়া। দুদকের একটি মামলায় তাকে ১১ বছরের কারাণ্ড দেয় ঢাকার বিশেষ জজ আদালত। প্রধান বিচারপতির পদটি বিচার বিভাগের শীর্ষ পদ। সেই পদের একজন যাকে দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত হয়ে দণ্ডিত হতে হয়েছে।

দেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে এটি ছিল নজিরবিহীন ঘটনা। এর আগে বাংলাদেশের সাবেক কোনো প্রধান বিচারপতির এমন সাজা হয়নি। এই রায় দেশ জুড়ে নানা আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

বিচারকের বিচারিক ক্ষমতা প্রত্যাহার

বনানী রেইনট্রি হোটেল ধর্ষণ মামলায় ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবু্যনাল-৭-এর বিচারক মোছাম্মাৎ কামরুন্নাহারের এক পর্যবেক্ষণ জন্ম দেয় ব্যাপক সমালোচনার। ঐ মামলার পাঁচ আসামিকে বেকসুর খালাস দেওয়ার রায়ের পর্যবেক্ষণে ঐ জজ বলেন, ‘৭২ ঘণ্টা পর যেন ধর্ষণের ঘটনায় মামলা নেওয়া না হয়।’ এই পর্যবেক্ষণ গণমাধ্যমে প্রকাশ পেলে প্রতিবাদে সরব হয় বিভিন্ন মহল। পরে প্রধান বিচারপতি তাৎক্ষণিকভাবে তাকে বিচার কাজ থেকে সরিয়ে দেন। তাকে আইন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়। বিভিন্ন মহলের তীব্র সমালোচনা ও প্রতিবাদের মুখে সেই পর্যবেক্ষণ লিখিত রায়ে স্থান দেননি কামরুন্নাহার।

পরে অবশ্য অন্য এক মামলায় আসামিকে জামিন দেওয়ায় তাকে ফৌজদারি মামলার বিচার কাজ থেকে সরিয়ে দিয়ে আদেশ প্রদান করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। রায়ে বলা হয়, ‘স্থগিতাদেশ থাকার পরও অসৎ উদ্দেশ্য ধর্ষণ মামলার আসামি আসলাম শিকদারকে জামিন দিয়েছিলেন বিচারক মোছা. কামরুন্নাহার। তাই সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদ মোতাবেক, ফৌজদারি মামলায় তার বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তাই এখন থেকে তিনি আর দেশের কোনও আদালতে ফৌজদারি মামলা পরিচালনা করতে পারবেন না।’ মামলার ঘটনা পর্যালোচনার শেষে রায়ের একটি অংশে মোছা. কামরুন্নাহার কোনও ফৌজদারি মামলা পরিচালনার জন্য উপযুক্ত নন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।