প্রবেশন : অপরাধীর শাস্তি নয়, সংশোধন যার লক্ষ্য
সাঈদ আহসান খালিদ; সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রবীণ সুরক্ষায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় দায়

সাঈদ আহসান খালিদ: বার্ধক্য মানুষের জীবনের একটি অনিবার্য পরিণতি। চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিকাশের সাথে পৃথিবীজুড়ে প্রবীণের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। বাংলাদেশেও প্রবীণের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ বাংলাদেশে বর্তমানে বাস করছেন প্রায় ১ কোটি ৪০ লক্ষ প্রবীণ যা ২০৩০ সালের পূর্বেই ২ কোটি ছাড়িয়ে যাবে এবং প্রবীণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই হার জারি থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে দেশে প্রতি পাঁচ জন মানুষের মধ্যে একজন হবেন প্রবীণ। কিন্তু এই বিপুল প্রবীণদের সুরক্ষা ও সেবায় আমরা কতো টা প্রস্তুত? প্রবীণবান্ধব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের দায় নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট আইন, নীতি, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও সক্রিয়তার মূল্যায়ন গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশ সাংবিধানিকভাবে এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে প্রবীণদের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চয়তাবিধানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। ১৯৮২ সালে ভিয়েনাতে অনুষ্ঠিত প্রবীণ বিষয়ক প্রথম বিশ্ব সম্মেলনে প্রবীণদের বার্ধক্য, স্বাস্থ্য সমস্যা, আর্থিক অক্ষমতা, পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা, একাকিত্ব- প্রভৃতি বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে প্রবীণ সুরক্ষায় আন্তর্জাতিক পরিকল্পনা ও দিকনির্দেশনা গৃহীত হয় যেখানে বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করে এবং সম্মেলনের লক্ষ্যপূরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। ২০০২ সালে স্পেনের মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত ২য় প্রবীণ বিষয়ক সম্মেলনেও বাংলাদেশ অংশ নেয় এবং এর প্রেক্ষিতে ২০১৩ সালে “জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা” প্রণয়ন করে।

প্রবীণদের কল্যাণে বাংলাদেশ সরকারের যুগান্তকারী পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে ১৯৯৭-৯৮ সালে প্রচলন করা বয়স্কভাতা কর্মসূচি, পিতামাতার ভরণপোষণ আইন-২০১৩ প্রণয়ন, কর্মকর্তা/কর্মচারীদের অবসর গ্রহণের বয়স বৃদ্ধি, পেনশন সুবিধা সম্প্রসারণ, সম্পূর্ণ পেনশন উত্তোলন কিংবা বিক্রির ওপরে সীমাবদ্ধতা আরোপ, পিতামাতাকে অন্তর্ভুক্ত করে পরিবারের সদস্য ৪ হতে ৬ জনে উন্নীতকরণ প্রভৃতি। কিন্তু প্রবীণ সুরক্ষায় এসব উদ্যোগের কোনটিই সম্পূর্ণ নয় এবং যথাযথ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারছে না। ৫০০ টাকা বয়স্কভাতায় বর্তমানে একজন প্রবীণের জীবনধারণ করা অসম্ভব। পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইনটি চমৎকার কিন্তু এটির প্রয়োগ দুর্লভ এবং এ সংক্রান্ত সচেতনতাও বেশি মানুষের নেই।

আবহমানকাল ধরে বাংলাদেশের সমাজ ও পরিবারে প্রবীণ সদস্যদের শ্রদ্ধা করা ও যত্ন নেওয়ার ধর্মীয় কর্তব্য, সামাজিক সংস্কৃতি ও নৈতিক মূল্যবোধের অনুশীলন হয়ে এসেছে। কিন্তু বিশ্বায়নের প্রভাবে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কারণে যৌথ পরিবার ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে, মানুষ নগরজীবনে অভ্যস্ত হচ্ছে, আর্থিক প্রয়োজন ও উন্নত জীবনের প্রত্যাশায় তরুণ প্রজন্ম বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে তাদের বয়স্ক পিতা-মাতাসহ পরিবারের প্রবীণ সদস্যরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন, একাকীত্ব ও বিষন্নতায় আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা এখন প্রবল হুমকির সম্মুখীন। কেউ কেউ আত্মহত্যা করছেন। এই প্রবণতার এটি উন্মেষ মাত্র যা ক্রমশ বাড়বে।

বৃদ্ধাশ্রম বা ওল্ডহোম সম্পর্কে আমাদের অস্বস্তি রয়েছে- অস্বীকারের জো নেই। এটি আমাদের চিরায়ত পারিবারিক, সামাজিক সংহতি ও মূল্যবোধকে আঘাত করে বলে বেশিরভাগ মানুষ এখানে বৃদ্ধাশ্রম বা প্রবীণ নিবাসকে নেতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করে। প্রবীণ সুরক্ষা বলতে শুধু বয়স্কভাতা বুঝায় না। প্রতিজন প্রবীণের প্রয়োজন পেশাদারী চিকিৎসাসেবা ও পরিচর্যা, উপযোগী খাদ্য, ওষুধ, পথ্য, শয্যা, বিনোদন, নিরাপত্তা, সমবয়সিদের সান্নিধ্য এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতা যা উপরে উল্লেখিত বাস্তবিক নানা কারণে ব্যক্তিপর্যায়ে বেশিরভাগ উত্তর-প্রজন্মের দ্বারা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না এবং ভবিষ্যতে এটি আরও প্রকট হবে।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসেবে, বাংলাদেশে বতর্মানে মানুষের গড় আয়ু ৭১ বছর ছয় মাস। জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এ কে এম নুর-উন-নবী’র মতে, “মানুষের আয়ুষ্কাল বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে অচিরেই এমন অবস্থা তৈরি হবে যেখানে একজন কর্মক্ষম মানুষকে তিনটি প্রজন্মের দায়িত্ব নিতে হবে – তার নিজের, তার আগের (মা-বাবা) এবং তারও আগের (দাদা-দাদী)। তিনটা প্রজন্মের দায়িত্ব নেয়ার মত অর্থনৈতিক অবস্থাতো সবার থাকবে না”। শুধু ভাবাবেগ ও পারিবারিক মূল্যবোধের দোহাই দিয়ে প্রবীণ জনসংখ্যার এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। তাই প্রবীণ সুরক্ষায় রাষ্ট্রীয় আইনগত দায় সৃষ্টি ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা অর্জনে এখন আমাদের দ্রুত মনোনিবেশ করা প্রয়োজন।

প্রবীণেরা শিশুদের সমান বা অনেক ক্ষেত্রে শিশুদের চেয়েও অসহায়, অক্ষম ও অরক্ষিত। কিন্তু বাংলাদেশে শিশু ও মহিলাদের সুরক্ষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও যেসব আইন ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা রয়েছে, তার তুলনায় প্রবীণ সুরক্ষার বিষয়টি প্রায় শুন্য। বাংলাদেশে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় রয়েছে, আছে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, জাতীয় মহিলা সংস্থা, শিশু একাডেমির মতো বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান। সমাজসেবা অধিদফতর এর আওতায় সমাজের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য বিভিন্ন কল্যাণমূলক কর্মসূচি ও প্রকল্প থাকলেও প্রবীণদের সুরক্ষায় ৫০০ টাকা ভাতার বাইরে বিশেষায়িত কোন সরকারি দপ্তর, সংস্থা, উদ্যোগ বা কর্মসূচি এখন অব্দি নেই।

বাংলাদেশে সরকারিভাবে শুধু প্রবীণদের জন্য বিশেষায়িত কোন প্রবীণনিবাস নেই। সমাজসেবা অধিদফতর এর অধীনে ৬৪ জেলায় ৮৫টি সরকারি শিশু পরিবারের প্রত্যেকটিতে ১০ টি আসন প্রবীণদের জন্য সংরক্ষিত থাকে যেখানে থাকা-খাওয়ার খরচ সরকারিভাবে বহন করা হয়। কিন্তু দুঃখজনক সত্য হচ্ছে, এই ১০ টি আসনের অধিকাংশ প্রবীণের অভাবে খালি পড়ে থাকে, বৃদ্ধ নাকি পাওয়া যায় না। এই চিত্র প্রমাণ করে সরকারি ব্যবস্থাপনার জনসংযোগ কতোটা দূর্বল! এমন একটি ব্যবস্থার কথা বেশিরভাগ মানুষ জানেই না! বেসরকারি বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যাও হাতেগোনা মাত্র।

২০১৩ সালে বাংলাদেশে ষাটোর্ধ্বদের ‘সিনিয়র সিটিজেন’ ঘোষণা করা হয়েছে, যার মাধ্যমে গণপরিবহন, চিকিৎসা, পাবলিক সার্ভিস প্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রবীণদের অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা পাবার কথা। কিন্তু বাস্তবে এটির কোন প্রয়োগ নেই এবং প্রয়োগের লক্ষ্যে কোন উদ্যোগও নেই। গণ-পরিবহনে ‘নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধী’র জন্য সংরক্ষিত আসন থাকলেও প্রবীণদের জন্য কোন অগ্রাধিকার নেই। বাংলাদেশের বাস-ট্রেনের মতো গণপরিবহনে আরোহন ব্যবস্থাও মোটেই প্রবীণবান্ধব নয়, উঁচু সিঁড়ি বেয়ে এসব পরিবহনে ওঠতে হয়।

বার্ধকের জন্য ব্যক্তিগতভাবে পূর্ব প্রস্তুতি নেওয়া সমীচীন। উত্তর-প্রজন্মের বিবেক ও মূল্যবোধের কাছে নিজেদের বৃদ্ধ বয়সের অসহায় সময়কে নিঃশর্ত সমর্পণ বিপজ্জনক হতে পারে। বৃদ্ধকালে আমাদের আর্থিক নিরাপত্তা, আবাসন, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা কীভাবে নিশ্চিত হবে সেটির পরিকল্পনা তরুণ বয়স থেকেই শুরু করা ও সেই লক্ষ্যে উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন।

প্রবীণদের সুরক্ষায় রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের পরিধি ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়ারও বিকল্প নেই। যেমন: বার্ধক্য বীমা এবং সার্বজনীন নাগরিক পেনশন ব্যবস্থা চালু করা, আরামপ্রদ ও নিরাপদ আবাসন বা প্রবীণনিবাস গড়ে তোলা, পেশাগত ও সাধারণ শিক্ষা পাঠ্যক্রমে বার্ধক্য ও প্রবীণকল্যাণ বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা, গণমাধ্যমে ইতিবাচক বার্ধক্য বিষয়ক প্রোগ্রাম প্রকাশ ও প্রচার করা ইত্যাদি।

বৃদ্ধাশ্রমে থাকাকে সামাজিকভাবে কটাক্ষ করার পরিবর্তে বেসরকারি উদ্যোগে আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্বলিত প্রবীণনিবাস প্রতিষ্ঠায় উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসা উচিত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, আর্থিক ও অন্যান্যদিক দিয়ে যাদের প্রবীণ সদস্যদের পারিবারিক পরিমণ্ডলে রাখার সামর্থ ও সুযোগ রয়েছে তারা যেন প্রবীণদের উপেক্ষা না করেন, পরিবারের সঙ্গ, যত্ন ও ভালবাসার চাহিদা অন্য কোন প্রতিষ্ঠান পূরণ করতে পারে না।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।