ফরিদুন্নাহার লাইলী; কৃষি ও সমবায় সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং সাবেক সংসদ সদস্য।
ফরিদুন্নাহার লাইলী; কৃষি ও সমবায় সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং সাবেক সংসদ সদস্য।

নারীর ক্ষমতায়নে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা ও কর্ম

ফরিদুন্নাহার লাইলী: বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার সার্বিক পরিকল্পনা, গৃহীত কার্যক্রম ও বাস্তবায়নের সঙ্গে নারীর সমাধিকার, সাম্য ও ক্ষমতায়ন নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। পরিবার, সমাজ ও জাতীয় জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই বঙ্গবন্ধু নারী-পুরুষের পৃথক কোনো জায়গা রাখেননি।

বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর চাচাতো বোন ফজিলাতুন্নেছা রেণুর পারিবারিক সূত্রে বাল্য বয়সে বিয়ে হয়। আজীবন রেণুকে তিনি স্ত্রীর পারিবারিক সম্পর্কে দেখেননি। তিনি রেণুকে জীবন সঙ্গী হিসেবে বড় পরিসরে দেখেছিলেন। পারিবারিক উর্ধে তাঁর রাজনীতির যাত্রায়ও রেণু একজন অসাধারণ সঙ্গী হিসেবে ছিলেন। এভাবে নারীর অবদানকে তিনি কখনো অবমূল্যায়ন করেননি। তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইয়ের সূচনায় তিনি উল্লেখ করেন এই বই লেখার জন্য রেণু তাঁকে কীভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। লিখেছেন- ‘আমার স্ত্রী যার ডাক নাম রেণু আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছেন। রেণু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।’

বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ব্যাপকসংখ্যক নারী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার ও মুক্তির লড়াইয়ে বাংলার নারীর ভূমিকা তাই নজর কেড়েছে সারা পৃথিবীতে। বঙ্গবন্ধু নারীকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করেছিলেন, নেতৃত্বের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন করেছিলেন। নারীর ক্ষমতায়নকে গুরুত্ব দিয়েই ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল মহিলা আওয়ামী লীগ। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের পর দুই জন নারীকে মন্ত্রীসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রতিষ্ঠা পায় বাংলা একাডেমি। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে একজন নারীকে নিয়োগ দেন। জাতির পিতার বিশ্বাস ও আদর্শের আলোকে তারই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়নকে বিস্তৃত করেছেন বহুধারায়। রাষ্ট্র ও সমাজের সব ক্ষেত্রে নারী এখন বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখছেন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সংবিধান প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আগেই ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ প্রথম স্বাধীনতা দিবসে ঢাকা আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয়ে মহিলা ক্রীড়া সংস্থার অনুষ্ঠানে নারী বা মেয়েদের উদ্দেশ্যে যে বক্তব্য প্রদান করেন, সেখানে নারী পুরুষ সকলের সমান অধিকারের কথা উল্লেখ করেন। তাঁর এই ভাষণ থেকে নারীর অধিকার এবং তাদের কাজের প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন যা থেকে নারী সম্পর্কে তাঁর ভাবনা সুস্পষ্ট রূপে প্রতীয়মান হয়। বঙ্গবন্ধু সেদিন বলেছেন-

‘আমি দেখেছি আমার জীবনে, যে নারী তার স্বামীকে এগিয়ে দেয় নাই, সে স্বামী জীবনে বড় হতে পারে নাই।’

নারীদের অবদানের কথা, নারীদের সহযোগিতার ইতিহাসকে পুরুষরা যেন না ভুলে যায় এই প্রসঙ্গেও নিজের সংসারের নারীর অবদানের কথা উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে তাঁর স্ত্রী ফজিলাতুননেছার দূরদর্শিতা ও অবদানের উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু সেদিন বলেছেন,

‘আমার জীবনে ১০/১১ বৎসর আমি জেল খেটেছি, জীবনে কোনো দিন আমার স্ত্রী মুখ কালা করে প্রতিবাদ করে নাই। তাহলে বোধ হয় জীবনে অনেক বাধা আমার আসতো। এমন সময়ও আমি দেখেছি যে, আমি যখন জেলে চলে গেছি আমি এক আনা পয়সা দিয়ে যেতে পারি নাই, আমার ছেলে-মেয়ের কাছে। আমার সংগ্রামে তার দান যথেষ্ট রয়েছে। পুরুষের নাম ইতিহাসে লেখা হয়। মহিলার নাম বেশি ইতিহাসে লেখা হয় না। সে জন্য আজকে আপনাদের কাছে কিছু ব্যক্তিগত কথা বললাম। যাতে পুরুষ ভাইরা কোন রকমে সংগ্রাম করে নেতা হন বা দেশের কর্ণধার হন তাদের মনে রাখা উচিত, তাদের মহিলাদেরও যথেষ্ট দান রয়েছে এবং তাদের স্থান তাদের দিতে হবে।’

বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের উন্নয়নে নারীর ক্ষমতায়নের ও সমাজের সমতার কথা ভেবেছেন। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত হলে নারীর অধিকারের প্রতি যে স্বীকৃতি রয়েছে তা বঙ্গবন্ধুর নারী ভাবনার ফসল। সংবিধানের ২৭, ২৮, ২৯ অনুচ্ছেদে সকল নাগরিক যে আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী, নারী-পুরুষভেদে রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন না করার এবং রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ প্রভৃতি বিষয় স্থান পেয়েছে। শুধু তাই নয়, নারীর জন্য জাতীয় সংসদে ১৫টি আসন সংরক্ষিত রাখার বিধান করেন বঙ্গবন্ধু।

মুক্তিযুদ্ধে যে সব নারী পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা সম্ভ্রম হারিয়েছেন তাদের বঙ্গবন্ধু বীরাঙ্গনা খেতাবে ভূষিত করেছেন। এছাড়াও নারী পুনবার্সন বোর্ড গঠন করে তাদের পারিবারিক ও সামাজিকভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি মহিলা সংস্থার এক ভাষণে বীরাঙ্গণাদের বাবার নাম ও ঠিকানা লেখার ক্ষেত্রে বলেন, “ আজ থেকে ধর্ষিতা মেয়ের বাবার নামের জায়গায় লিখে দাও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর ঠিকানা লেখ ধানমন্ডি ৩২।”

মাত্র সাড়ে তিনবছর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ তথা তাঁর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখেছেন এবং নেতৃত্ব দিয়েছেন। দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে নারীর অংশ গ্রহণ, ক্ষমতায়ন ও অধিকারের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করেছেন। ভেবেছেন নারীর উন্নয়নের জন্য। আর তারই ধারাবাহিকতায় তাঁরই কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারীর অধিকার, সমতা ও ক্ষমতায়নে বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন দেখেছিলেন- তা বাস্তবায়ন করছেন।

লেখক: কৃষি ও সমবায় সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ; সাবেক সংসদ সদস্য এবং সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি, ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম।