কারাদণ্ডের বিকল্প হিসেবে প্রবেশন ব্যবস্থা: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ সাইফুল ইসলাম পলাশ

বিচার চাই না, তাই বিচার পাই না!

সাইফুল ইসলাম পলাশ: “বিচার চাই না… বিচার নাই, বিচার কার কাছে চাইব“- ইদানিং এই একটি কথা সোশ্যাল মিডিয়ায় বার বার ঘুরছে। সম্প্রতি দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত কলেজছাত্রী প্রীতির বাবা জামাল উদ্দিন শোকে পাগলপ্রায় হয়ে ঘটনার পরপরই কথাগুলো বলেছেন। মেয়ে হারানোর বেদনায় স্বাভাবিকভাবেই এই কথাগুলো তিনি বলতে পারেন। কিন্তু অনেক শিক্ষিত মানুষ যখন বলেন, প্রীতির বাবার এই উক্তির মাধ্যমে সামগ্রিক বিচার ব্যবস্থার করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে, দেশের বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে গেছে; তখন আমি এর ভিন্ন চিত্রটাই খুজে পেয়েছি।

পত্রিকায় দেখলাম, দুই দিন আগে গাইবান্ধায় আধা কেজি হেরোইন রাখার দায়ে এক নারীর মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে। তার আগের দিন সিলেটে ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ হত্যার দায়ে চারজনের এবং লক্ষ্মীপুরে একটি মামলায় যৌতুকের দাবিতে আরজু বেগমকে হত্যার দায়ে তার স্বামীর মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে। প্রতিদিন পত্রিকা খুললেই দেখা যায়, কারো ফাঁসি, কারো যাবজ্জীবন কিংবা সাধারণ কারাদণ্ড হয়েছে। আবার কেউবা খালাস পেয়েছেন। দেশেতো বিচার নাই, তবে এরা কারা যারা বিচার পেল? এ তো মাত্র তিনটি খবর পত্রিকায় এসেছে। আদালত পাড়ায় গিয়ে দেখুন কত শত খবর পড়ে আছে যা মিডিয়ায় আসে না। জনগণ জানতে পারে না।

মৃত্যুদণ্ড থাকা উচিত কিনা তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে মানুষ বিচার পাচ্ছে কিনা? মৃত্যুদণ্ড নিয়ে শুরু করি। ২০২০-২১ অর্থবছরে কারাগারে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামী যুক্ত হয়েছে ১০৮ জন। এই নিয়ে বর্তমানে ২০০৩ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কারাগারে আছেন (যুগান্তর, ২৪ মার্চ ২০২২) । এখন তো বলবেন, আশঙ্কাজনকহারে মৃত্যুদণ্ড বেড়ে যাচ্ছে। সেদিন হাইকোর্টের একজন বিজ্ঞ আইনজীবী বললেন, নিম্ন আদালতের বিচারকরা মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। আমরা কুলিয়ে উঠতে পারছিনা। যাইহোক, সবার মৃত্যুদণ্ড শেষ পর্যন্ত কার্যকর হয় না। মহামান্য হাইকোর্ট কারো সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন করে। কেউ খালাস পায়। কারো মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। অল্প কিছু অপরাধী মহামান্য রাষ্ট্রপতির দয়ায় ক্ষমাও পান। দুইদিন আগের তথ্যটা জানিয়ে দেই। সেদিন ইতিহাসে প্রথম একদিনে বারোটি ডেথ রেফারেন্স মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এই ১২ মামলায় ২৬ জনের মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন হয়েছে, চারজনের মৃত্যুদণ্ড বহাল এবং বাকি দুইজন খালাস পেয়েছেন।

এবার সামগ্রিকভাবে ফৌজদারি মামলার চিত্রটা দেখি। ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট অনিষ্পন্ন মামলা ছিল ২০ লক্ষ ৬ হাজার ৩১ টি। এই সময়ে নিষ্পত্তি হয়েছে ৫ লক্ষ ৬৯ হাজার ৩৬২ মামলা। এই সময়ে শাস্তি পেয়েছেন ৬১ হাজার ৩২৯ জন এবং পূর্বের বছরে শাস্তি পেয়েছিলেন ৫৬ হাজার ৪২১ জন (যুগান্তর, ২৪ মার্চ ২০২২)। তাহলে দেখা যাচ্ছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর ৪৯০৮ জন বেশি সাজা পেয়েছেন। করোনার সময়ে আদালত দীর্ঘ দিন বন্ধ থাকা স্বত্বেও মামলা বেশী প্রমাণ হয়েছে।

সারা বিশ্বের কোথাও শতভাগ সাজার রেকর্ড নেই। তবে শুধু চীন, জাপান ও রাশিয়ায় সাজার হার ৯৯ শতাংশের বেশী দেখলাম। ভাবছেন এ দেশগুলোতে কী অটো রায় হয়! এসব দেশে কী আইনজীবী নেই, বিচারক নেই! বিষয়টা কিন্তু তা নয়। এত বেশী সাজা হবার কারণটা কিন্তু ভিন্ন। চীনের কথাই ধরা যাক। ২০১৪ সালের একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সে বছর বিচার বিভাগ ১.২ মিলিয়ন অপরাধীর বিচার করেছিলেন। এদের মধ্যে মাত্র ১০৩৯ জন (০.০৮ শতাংশ) খালাস পেয়েছে অর্থাৎ বাকীরা সবাই সাজা ( ৯৯.৯ শতাংশ) পেয়েছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে সেখানকার শূন্য খালাস নীতির (Zero Acquittal Policy) জন্যে প্রসিকিউটররা খালাসের ঝুঁকি নিতে চান না। তাই তারা বিচার পূর্ব স্তরেই (Pre-trial stage) অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেন।

বিশ্বের বেশ কিছু দেশ আছে যেখানে মামলা দায়েরের আগেই কেস নিষ্পত্তি হয়ে যায়। আগাছা আগেই পরিস্কার হয়ে যায়। বিচার শুরুর আগেই দোষ স্বীকার করলে (Plea bargaining) সাজার পরিমাণ কম করে দেয়া হয়। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স, ইতালি, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে এই পদ্ধতি চালু আছে। আমাদের দেশে এসব নেই। এখানে সব ধরনের মামলার বিচার হয়। ফলে গুরুত্বপূর্ণ মামলা ছাড়াও অনেক ধরনের তুচ্ছ মামলায় সময় নষ্ট হয়। বিচার পেতে বিলম্ব হয়।

আমাদের দেশে মামলা বিলম্বে নিষ্পত্তির পিছনে অনেকগুলো কারণ আছে। আদালতে বিচার পেতে সাক্ষী লাগে, তদন্ত রিপোর্ট লাগে, মেডিকেল সার্টিফিকেট লাগে। এগুলো সময়মত না পাওয়া গেলে বিচার পেতে বিলম্ব হয়। অভিজ্ঞতায় দেখেছি আদালতে সাক্ষীর উপস্থিতি নিশ্চিতকরণে ব্যর্থতা, তদন্তে ধীরগতি, আদালতের গ্রেফতারী পরোয়ানা ঠিকমতো তামিল না করা, তদন্ত কর্মকর্তা ও মেডিকেল অফিসারের সাক্ষ্য প্রদানে বিলম্ব ইত্যাদি কারণে মামলার বিচার দীর্ঘায়িত হয়।

বলছিলাম চীনের শাস্তি নীতির কথা। ওদের সাথে আমাদের তুলনা চলবে না। আমাদের ফৌজদারী নীতি হচ্ছে দশ জন অপরাধীও যদি খালাস পায় একজন নিরপরাধ ব্যক্তি যেন সাজা না পায়। শুধু সাজা পাওয়াই বিচার নয়, খালাস পাওয়াও ন্যায় বিচার। এটি একমাত্র ভুক্তভোগীরাই অনুধাবন করতে পারবেন। আমাদের দেশে অনেকেরই অপরাধ না করেও আসামি হয়ে দিনের পর দিন মাসের পর মাস এমনকি বছর ধরেও হাজতবাস হয়েছে। জাহালম কিংবা আরমান এর কথা আমরা সবাই জানি। শুধু মাত্র নাম বিভ্রাটের কারণে তাদের দীর্ঘ দিন হাজতবাস করতে হয়েছে। তবে জাহালমের মামলায় দুদকের একটি ভুল দিয়ে সংস্থাটিকে মাপা যাবে না। সেদিন ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভিতে দেখলাম ২০২১ সালে দুদকের মামলা গুলো শাস্তির হার ৬০ শতাংশ এবং ২০২০ সালে তা ছিল ৭২ শতাংশ।

একটি অভিযোগ প্রায়ই শুনি। সেটা হচ্ছে নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা গুলোতে সাজার মাত্র ৩ শতাংশ। যারা ফৌজদারি প্র্যাকটিস করেন, আদালত প্রাঙ্গণে ঘোরাফেরা করেন, তারা ভালভাবেই জানেন এর নেপথ্যে কারণ কি? এই মামলাগুলো শুরুতে শক্ত থাকলেও পরবর্তী সময়ে আপস হয়ে যায়। কত শতাংশ আপস হয়ে যায় তা কোনো গবেষক তথ্য দিতে পারেননি। এ বিষয় নিয়ে আসলে গবেষণা হয়নি। তবে ২০২০ সালের যুগান্তরের একটি খবরে জানা যায়, রাজশাহী চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৭৩১ যৌতুকের মামলা মধ্যে আপোষ হয়েছে ৫৭১ মামলা অর্থাৎ ৭৮ শতাংশ মামলা উভয়পক্ষের সম্মতিক্রমে নিষ্পত্তি হয়েছে। এদের মধ্যে আদালতের মধ্যস্থতায় সংসারে ফিরে গেছে ২৫২ জন। ৩৪১ মামলায় অসহায় নারীরা তিন কোটি ৭০ লক্ষ ১১ হাজার ৭২৩ টাকা বুঝে পেয়েছেন। অধিকাংশ মামলায় এই প্রতিকার পেয়েছেন মাত্র ছয় থেকে সাত মাসের মধ্যে। এটি তো গেল একটি জেলার মধ্যে একটি আদালতের তথ্য। ভাবুনতো ৬৪ জেলায় কতজন এমন প্রতিকার পেয়েছে! দেনমোহর-ভরণপোষণ সংক্রান্ত মূল মামলাগুলো হয় পারিবারিক আদালতে। এই আদালতগুলোতে দেনমোহর- ভরণপোষণ আদায় হয় ফৌজদারী আদালতগুলোর চেয়ে অনেক বেশি। এই তথ্যগুলো সবারই অজানা থেকে যায়।

আপনার মামলা করার টাকা নেই। কোন অসুবিধা নেই। সরকার আর্থিকভাবে অসচ্ছল, সহায়-সম্বলহীন এবং নানাবিধ আর্থ-সামাজিক কারণে বিচারপ্রাপ্তিতে অসমর্থ বিচারপ্রার্থীদের বিনামূল্যে সরকারি আইনগত সহায়তা প্রদান করছে। প্রতিটি জেলায় জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির মাধ্যমে বিনা পয়সায় আপনার মামলা পরিচালনা করা হবে। এই অফিসের একজন বিচারক সরাসরি আপনার অভিযোগ শুনবেন, পরামর্শ দিবেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। আপনি জেনে অবাক হবেন যে, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ লক্ষ ৭৯১ জন বিচারপ্রার্থী লিগ্যাল এইড সেবা পেয়েছেন। আপনি চাইলে মামলাগুলো আপসেও নিষ্পত্তি করতে পারেন । গত এক বছরে এই অফিসের মাধ্যমে ২৬ কোটি ৫৬ লাখ ৮১ হাজার ৩৮৫ টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করা হয়েছে এবং প্রকাশ্যে সেগুলো আবেদনকারীকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে।

এরপরেও বলবেন দেশে বিচার নেই! আপনার টাকা নেই বলে লোক নেই বলে বিচার নেই – সেই যুগ আর নেই। আপনি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, আপনার অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে বলে বাড়িতে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়ে কোনো লাভ নেই। থানায় যান। আদালতে যান। আইনজীবীর পরামর্শ নিন। লেগে থাকুন। নিশ্চয়ই আপনি ন্যায়বিচার পাবেন। বিচার নাই, বিচার চাই না – এই কথা বলে নিজেকেই বঞ্চিত করছেন। এটি আপনার সাংবিধানিক অধিকার। এখন বিচার পাবার অধিকার, ধনী–গরীব সবার। বিচার না চাইলে বিচার পাবেন কিভাবে? আর হ্যাঁ, আপনি শিক্ষিত হয়েও যদি এই কথার সাথে তাল মিলান তাহলে প্রকান্তরে আপনি জাতির ক্ষতি করছেন। আপনার এই কথায় লাখো মানুষ নিরুৎসাহিত হবে।

দেশে প্রতি বছর বছর মামলার সংখ্যা বাড়ছে। মানুষ এখন আদালতমুখী হয়েছে। মানুষ আগের চেয়ে বেশী অধিকার সচেতন হয়েছে বলেই মামলা বাড়ছে। কিন্তু মামলার সংখ্যানুপাতে বিচারক বাড়ছে না। ১৮ কোটি মানুষের এই দেশে মাত্র ১৯০০ জন বিচারকের ঘাড়ে ৩৯ লক্ষ মামলার চ্যালেঞ্জ। বিচার বিভাগ নানা সীমাবদ্ধতা নিয়ে সর্বোচ্চ সেবা দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। মানুষ কেউ সীমাবদ্ধতার কথা শুনতে চায় না। তাই এগুলো নিয়ে আজ বললাম না। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে সিস্টেমের ত্রুটির কথাটা কেউ বলে না। কিছু একটা হলেই বিচারহীনতার সংস্কৃতির কথা বলে ফেলি। কবিগুরুর ভাষায় বলতে চাই, নিন্দা করতে গেলে বাইরে থেকে করা যায় কিন্তু বিচার করতে গেলে ভিতরে প্রবেশ করতে হয়।

লেখক: যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ, কুড়িগ্রাম।