ভুয়া নিয়োগপত্র: রিট করে ফাঁসলেন ৩৪ আবেদনকারী
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। ছবি: জয়দীপ্তা দেব চৌধুরী

হাতিরঝিলের সংরক্ষণ-উন্নয়নে হাইকোর্টের চার দফা নির্দেশনা, ৯ পরামর্শ

হাতিরঝিলের পানি এবং এর নান্দনিক সৌন্দর্য ও মহামূল্যবান জাতীয় সম্পদ উল্লেখ করে এর সংরক্ষণ ও উন্নয়নে চার দফা নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে এ বিষয়ে বিষয়ে ৯ দফা পরামর্শ দেন আদালত।

হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ বনাম বাংলাদেশ ও অন্যান্য মামলার রায়ে হাইকোর্ট এসব পরামর্শ ও নির্দেশনা দেন। রাজধানীর হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি প্রজেক্টকে পাবলিক ট্রাস্ট (জনগণের সম্পত্তি) ঘোষণা করে গত বছরের ৩০ জুন রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। এ বিষয়ে জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ৫৫ পৃষ্ঠার ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়েছে।

রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেছেন, প্রতিটি ফোটা পানি অতি মূল্যবান। পানির চেয়ে তথা সুপেয় পানির চেয়ে মূল্যবান আর কোনো সম্পদ বিশ্বে নেই। তাই প্রতিটি ফোটা পানির দূষণ প্রতিরোধ করা একান্ত আবশ্যক।

আদালত আরও বলেছেন, There is no ‘planet B’। দ্বিতীয় কোনো বিশ্ব নেই। এ বিশ্ব ছাড়া আর কোনো গ্রহে পানির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন দেশ ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে এক ফোটা পানি বিশ্বের বাইরে থেকে আনতে সক্ষম হয়নি। অথচ ওই খরচের শত ভাগের এক ভাগ টাকা খরচ করলে আমরা আমাদের গ্রহের পানিকে দূষণ মুক্ত ব্যবহারযোগ্য রাখতে সক্ষম। হাতিরঝিলের পানি এবং এর নজরকাড়া সৌন্দর্য অমূল্য সম্পদ। এ অমূল্য সম্পদকে কোনোরূপ ধ্বংস বা ক্ষতি করা যাবে না।

রায়ে হাতিরঝিলের পানি এবং এর নান্দনিক সৌন্দর্য ও মহামূল্যবান এ জাতীয় সম্পদ সংরক্ষণ ও উন্নয়নে চার দফা নির্দেশনা দিয়েছেন আদালত।

সেগুলো হলো:

  • সংবিধান, পরিবেশ আইন, পানি আইন এবং তুরাগ নদী রায় মোতাবেক রাজধানীর ফুসফুস বেগুনবাড়ি খালসহ হাতিরঝিল এলাকা যা ‘হাতিরঝিল’ নামে পরিচিত পাবলিক ট্রাস্ট প্রপার্টি (Public Trust Property) তথ্য জনগণের ন্যাস সম্পত্তি তথা জাতীয় সম্পত্তি।
  • ‘হাতিরঝিল এলাকায় হোটেল, রেস্টুরেন্টসহ সব ধরনের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বরাদ্দ এবং নির্মাণ- সংবিধান, পরিবেশ আইন, পানি আইন এবং তুরাগ নদীর রায় অনুযায়ী বেআইনি এবং অবৈধ।
  • ‘হাতিরবিল’ প্রকল্প এলাকায় বরাদ্দ করা সব হোটেল, রেস্টুরেন্ট এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অবৈধ এবং এখতিয়ার বহির্ভূত মর্মে এসব বরাদ্দ বাতিল ঘোষণা করা হলো।
  • রায়ের অনুলিপি প্রাপ্তির পর ৬০ দিনে মধ্যে সব হোটেল, রেস্টুরেন্ট এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদের জন্য প্রতিপক্ষগণকে (রিটের বিবাদীগণ) নির্দেশ দেওয়া হলো।

এ ছাড়া আদালত এ বিষয়ে ৯ দফা পরামর্শ দেন।

সেগুলো হলো:

  • হাতিরবিল এবং বেগুনবাড়ি সম্পূর্ণ প্রকল্পটি সংরক্ষণ, উন্নয়ন এবং পরিচালনার নিমিত্তে একটি পৃথক কর্তৃপক্ষ তথা ‘হাতিরখিল লেক সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সরাসরি অধীন গঠন করা।
  • বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রকৌশল বিভাগ এবং সেনাবাহিনীর ২৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডকে যৌথভাবে হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকার স্থায়ী পরামর্শক নিয়োগ করা।
  • জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য মাটির নিচে আন্তর্জাতিক মানের টয়লেট স্থাপন করা।
  • নির্ধারিত দূরত্বে বিনামূল্যে সব জনসাধারণের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা।
  • পায়ে চলার রাস্তা, বাইসাইকেল লেন এবং শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য পৃথক লেন তৈরি করা।
  • পানির জন্য ক্ষতিকর সব ধরনের যান্ত্রিক যান তথা ওয়াটার ট্যাক্সি সার্ভিস ব্যবহার নিষিদ্ধ করা।
  • লেকে মাছের অভয়ারণ্য করা।
  • হাতিবধিল-বেগুনবাড়ি প্রকল্পটি বাংলাদেশের প্রথম বাঙালি বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর নামে নামকরণ করা।
  • হাতিরঝিল এবং বেগুনবাড়ি সম্পূর্ণ প্রকল্পটি সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও পরিচালনার ব্যয় রেভিনিউ (রাজস্ব) বাজেট থেকে বরাদ্দ করা।

একইসঙ্গে রায়ে রিট মামলাটি একটি চলমান আদেশ (Continuing Mandamus) হিসেবে অব্যাহত থাকবে বলে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া যেসব প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া হাতিরঝিল ও পরিবেশ রক্ষায় ব্যাপক প্রচারণা ও সোচ্চার ভূমিকা পালন করে চলেছে রায়ে তাদের অভিনন্দন জানানো হয়েছে।

রায়ে হাতিরঝিল সম্পর্কে বলা হয়, হাতিরঝিলসহ তেজগাঁও এলাকায় অনেক ভূ-সম্পত্তি ভাওয়াল রাজার এস্টেটের অন্তর্ভুক্ত ছিল। রাজার হাতির পাল এ ঝিলে স্নান করতো এবং জলে বিচরণ করতো বলে কালের পরিক্রমায় এর নাম হয় ‘হাতিরঝিল’।

বেগুনবাড়ি খালসহ হাতিরঝিল প্রকল্পটি ২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন। ১ হাজার ৯৭১ দশমিক ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে মোট ৩০২ একর জমির ওপর এ প্রকল্পটি প্রতিষ্ঠিত। প্রকল্প এলাকার মোট ১৬ কিলোমিটার রাস্তায় কোনো বাস অথবা মিনিবাস চলাচলের অনুমতি ছিল না। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ৫/২০০৯তম সভায় অনুমোদিত লে-আউটে প্রস্তাবিত ওয়াকওয়ে ও রোডওয়ে এলাইনমেন্ট ছাড়া অন্য কিছু ছিল না।

প্রকল্পটি ঢাকা মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন, বৃষ্টি, বন্যাজনিত পানি ধারণ, বৃষ্টির পানি পয়ঃনিষ্কাশন ও নগরের নান্দনিক সৌন্দর্য বাড়িয়ে এবং সার্বিক পরিবেশ উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। খালগুলোর জন্য প্রস্তাবিত সুবিশাল লেকটি একটি নিয়ন্ত্রিত ‘হাইড্রোলিক সিস্টেম’ হিসেবে কার্যকর হয়।

এতে ওই এলাকার ড্রেনেজ ম্যানেজমেন্ট ক্যাপাসিটি বেড়েছে, পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় ও সৌন্দর্যমণ্ডিত পাবলিক স্পেসের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। রমনার পাশাপাশি একটি সুবিশাল নীল জলাধার বেষ্টিত উন্মুক্ত স্থানের অভাব লাঘব হয়। যা বিশ্বের কাছে ঢাকা মহানগরীর গ্রহণযোগ্যতা বাড়ায়।

প্রসঙ্গত, হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি প্রজেক্টে লে-আউট প্ল্যানের নির্দেশনার বাইরে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালনা বন্ধে রাজউকের নিষ্ক্রিয় থাকার প্রতিবেদন গণমাধ্যমে প্রকাশের পর ২০১৮ সালের ৯ সেপ্টম্বর হাইকোর্টে রিট দায়ের করে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি)।

ওই রিটের শুনানি নিয়ে ২০১৮ সালের ১০ সেপ্টম্বর রুল জারি করেন হাইকোর্ট। পরে ২০২১ সালের ৩০ জুন ওই রুল যথাযথ ঘোষণা করে রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট।

আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ওয়ায়েস আল হারুনী।