গ্রীষ্মকালে আইনজীবীদের 'ড্রেস কোড' শিথিলে প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন
বিচারক-আইনজীবীর পোষাক (প্রতীকী ছবি)

ঔপনিবেশিক আধিপত্যের প্রকৃষ্ট উদাহরণ: বিজ্ঞ আইনজীবীদের ড্রেসকোড

ফাইজুল ইসলাম: উপনিবেশের আধিপত্যই প্রমাণ করে আমরা জাতি হিসেবে কতটা আনুগত্য ব্রিটিশদের প্রতি। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা ব্রিটিশ শাসনের উত্তরাধিকার সূত্রে চলে এসেছে। সময়ের প্রয়োজনে অনেক রীতিতে পরিবর্তন এলেও আদালতে কালো কোট বা গাউন পরিধানের রীতিতে কোন পরিবর্তন আসেনি। গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহে যখন ঘর থেকে বের হওয়া দায়, তখন বাংলাদেশের আইনজীবীরা আদালতকক্ষে কালো কোট ও গাউন পরে দায়িত্ব পালন করেন।

আমরা সকলেই জানি যে আইনজীবীদের আদালতে সবসময় কালো কোট ও কালো গাউন পরে মামলা পরিচালনা করতে হয়। কারণ এগুলো হল আইনজীবীদের পোশাক যা আইনজীবীদের অন্যান্য পেশার লোকদের থেকে আলাদা করে। কিন্তু আমাদের দেশে গরমকালে সাধারণ তাপমাত্রা থাকে ৩০-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সেখানে গরমকালে কালো কোট ও গাউনের মত গরম পোশাক পরা কতটুকু যুক্তিসংগত? দেশের অনেক বিচারপ্রাঙ্গণে এসিও নেই। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে শুধুমাত্র কট্টর ঔপনিবেশিকতার জোরে আমরা প্রকৃতির বিরুদ্ধে নিজেদের তৈরি করছি।

কেন কালো কোট, গাউন আইনজীবীদের পোশাক?

ইংল্যান্ডের কোর্টে Dress code (নির্দিষ্ট পোশাক) এর প্রচলন শুরু হয় অনেক আগে, ১৭তম শতাব্দিতে। তখন আইনজীবী, জাজরা কোর্টে কালো কোট, বিভিন্ন রঙের গাউন, ব্যান্ড ও পরচুলা পড়তো, যার অনেককিছু এখনও ইংল্যান্ডের কোর্টে প্রচলিত আছে। ১৬৮৫ সালে ইংল্যান্ডে রাজা দ্বিতীয় চার্লস মারা যাবার পর শোকের প্রকাশের জন্য আদালতে আইনজীবী এবং বিচারপতিরা কালো কোট ও গাউন পরা শুরু করেন। 

কিন্তু ১৬৯৪ সালে তখনকার England এর রানি Mary II এর শেষকৃত্যে তখনকার ইংল্যান্ডের জাজরা রানিকে সম্মান দেখানোর জন্য সবাই কালো গাউন পরে। এরপর ১৭১৪ সালে রানি আনি এর শেষকৃত্যে আবার সম্মান দেখাতে কালো কোট পরিধান করে।

ইংল্যান্ডবাসী তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও সমবেদনা প্রকাশ করতে টানা চল্লিশ দিন যাবত কালো পোশাক পরিধান করে থাকেন। চল্লিশ দিন পর ইংল্যান্ডের আইনজীবীরা এই মর্মে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তাঁরা প্রতিদিনই কালো পোশাক পরে কোর্টে আসবেন আর সেই থেকেই ইংলিশ আইনের স্রোতধারায় আইনজীবীদের কালো পোশাক পরার প্রথা চলে এসেছে।

এরপর থেকে জাজরা কোর্টে কালো কোট, কালো গাউন পরা শুরু করে এবং এটা তাদের ঐতিহ্যে পরিণত হয়। পরবর্তীতে ইংল্যান্ড পৃথিবীর যেসব দেশ শাসন করেছে সেসব অনেক দেশের কোর্টে এখনও আইনজীবী ও জাজদের কালো কোট,গাউনের সংস্কৃতি  চালু আছে, যাদের মধ্যে বাংলাদেশ একটি।

বাংলাদেশের আবহাওয়ার সঙ্গে কালো পোশাক আরামদায়ক নয়। গরমের সময় কালো কোট পরে আদালতে কার্যক্রম পরিচালনা করতে আইনজীবী এবং বিচারপতিদের অসুবিধা হয়।

বাংলাদেশে কালো কোর্টের বিধান কোথায় রয়েছে?

বাংলাদেশ সিভিল রুলস এন্ড অর্ডার – এর ৮২৫ ও ৮২৬ এবং বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট রুলস -এর প্রথম পর্বের তৃতীয় আদেশের ৩৮তম বিধিতে আইনজীবীদের এই ড্রেসকোড সম্পর্কে দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।আদালতের আইনজীবীদের পোশক এবং নিম্ন আদালতের আইনজীবীদের পোশক সুপ্রীম কোর্টের এডভোকেটগণ অধঃস্তন আদালতে উপস্থিত হওয়ার সময় সুপ্রীম কোর্টের ন্যায় একই প্রকার গাউন পরিধান করিবেন।” এবং দেওয়ানী নিয়ম ও আদেশাবলীর নিয়ম ৮২৬ এ জানতে পারি যে, আদালতের উপস্থিতিকালে অধঃস্তন আদালতসমূহের এডভোকেটগণ নিম্নোক্ত বিশেষ পোশাক পরিধান করিবেন:

(১) পাজামার সহিত মানানসই কালো বা সাদা চাপকান, আচকান বা বোতাম যুক্ত লম্বা কোট এবং বিএ গাউনের কাটা এবং আকৃতির কালো আলপাকা গাউন; অথবা

(২) ইউরোপীয় পোষক পরিধান করিলে কালো বা সাদা পাজামাসহ কালো কোট; এবং কালো বা গাঢ় কালো রংয়ের বন্ধনী (tie) এবং গাউন।

নোট: (১) উপনিয়মে ‘‘সাদা” বলিতে ফিকে ক্রিম রংয়ের ন্যায় সরল বিমর্ষ রং, প্রাকৃতিক টাসর ইত্যাদিকে বুঝায়। গাউন পরিধান বাধ্যতামূলক। ম্যাজিষ্ট্রেট এবং দেওয়ানী ও রাজস্ব কর্তব্য পালনকারী নির্বাহী কর্মকর্তাগণ গাউন   পরিধান করে না বিধায় তাহাদের সম্মুখে উপস্থিতকালে এডভোকেটগণের পরিধান করা না করা ঐচ্ছিক।

আবার ২০০৯ সালের ফৌজদারী নিয়ম ও আদেশাবলীর এর সংখ্যা-১, অধ্যায় ২৯ নিয়ম ৪৮৭ মোতাবেক ‘‘সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবীবৃন্দ যখন কোন দায়রা আদালতে,  ট্রাইব্যুনালে অথবা  বিচারিক ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে কেস পরিচালনায় উপস্থিত হবে তখন সুপ্রীম কোর্টে পরিধেয় গাউনই পরিধান করবেন।” এবং ২০০৯ সালের ফৌজদারী নিয়ম ও আদেশাবলীর এর সংখ্যা-১, অধ্যায় ২৯ নিয়ম ৪৮৮ মোতাবেক ‘‘অধঃস্তন আদালতের সকল পুরুষ আইনজীবীগণ নিম্নে বর্ণিত পোশাকাদি তাদের পোশাকের একাংশ হিসাবে পরিধান করবেন:

(ক) বোতাম লাগানো কোট অথবা কালো চাপকান, আচকান অথবা শেরোয়ানী এবং হাফহাতা গাউন এবং ব্যান্ড অথবা

(খ) কাল বুক খোলা কোট সাদা শার্ট, খাড়া পাখিরডানার মত সাদা কলার, শক্ত অথবা নরম, এবং কাল গাউন এবং ব্যান্ড।

(গ) যেকোন ক্ষেত্রে, লম্বা পাজামা (সাদা, কালো,  কালো রঙের দাগাবিশিষ্ট ডোরাকাটা অথবা ছাই রঙের) পরিধান করতে হবে।

(ঘ) যদি ইউরোপিয়ান পোশাক পরিধান করা হয় তবে একটি কালো কোটের সঙ্গে কালো অথবা সাদা পাজামা এবং কালো অথবা কালোর মধ্যে রঙ্গিন পেইন টাই এবং গাউন পরতে হবে”

এবং ২০০৯ সালের ফৌজদারী নিয়ম ও আদেশাবলীর এর সংখ্যা-১, অধ্যায় ২৯ নিয়ম ৪৮৯ মোতাবেক : ‘‘অধঃস্তন আদালতে মহিলা আইনজীবীগণ তাহাদের পোশাকের একাংশ হিসাবে নিম্নে লিখিত পোশাকাদি পরিধান করবেন:

কালো রঙের ফুল হাতা জ্যাকেট অথবা বাউজ, খাড়া জোড়া সাদা কলার শক্ত অথবা৪৮৯ মোতাবেক : ‘‘অধঃস্তন আদালতে মহিলা আইনজীবীগণ তাহাদের পোশাকের একাংশ হিসাবে নিম্নে লিখিত পোশাকাদি পরিধান করবেন:

কালো রঙের ফুল হাতা জ্যাকেট অথবা বাউজ, খাড়া জোড়া সাদা কলার শক্ত অথবা নরম হবে সঙ্গে কালো রঙের গাউন এবং ব্যান্ড থাকবে, শাড়ি অথবা স্যালোয়ার কামিজ (সাদা অথবা কালো) পরিধান করতে হবে”।

নোট: নির্ধারিত পোশক পরিধান করা সকল আইনজীবীদের জন্য বাধ্যতামূলক।

বাংলাদেশেও বর্তমানে আইন দ্বারা নির্দেশিত। কোট পরে আদালতে উপস্থিত হবার বিষয়টি বাংলাদেশ বার কাউন্সিল আইনে রয়েছে। যে কোন আইনজীবী চাইলেই তার নিজের ইচ্ছেমতো পোশাক পরে আদালতে উপস্থিত হতে পারবেন না। তাকে অবশ্যই আইনের সাথে সম্মান রেখে নিয়ম মেনে কালো কোট ও গাউন পড়েই আসতে হবে।

আবার আরো একটি কারণ রয়েছে যে, আদালত কক্ষে বাদী-বিবাদীসহ অনেকেই আসেন। সাদা শার্ট এবং কালো কোটের মাধ্যমে আইনজীবীদের অন্যদের চেয়ে পৃথক করা করা যায়। তবে সব কিছুর মূলে প্রায় ৩৫০ বছর আগের ব্রিটিশদের নিয়মের নিমিত্তেই এটি চলে আসছে।

করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির ফলে গত বছর আইনজীবী ও বিচারকদের পোশাকে শিথিলতা আনা হয়। প্রথমে কালো কোট ও কালো গাউন বাদ দিয়ে শুধু সাদা শার্ট বা সাদা শাড়ি/সাদা সালোয়ার কামিজ ও সাদা নেক ব্যান্ড পরে বিচারকাজ পরিচালনা করার সুযোগ দিয়ে নোটিশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।

এরপর গত বছরের ১৬ নভেম্বর থেকে নতুন আরেকটি নোটিশ দিয়ে কোট পরার বাধ্যতাবাধকতা ফিরিয়ে আনা হয়। তবে গাউনের ওপর শিথিলতা বহাল আছে। কয়েক বছর পূর্বে কালো পোশাক পরিধানের বিরুদ্ধে কোলকাতা হাইকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন বিক্ষোভের ডাক দেয় এবং আদালতে তা রেফারেন্সের সৃষ্টি করে।

কিন্তু বিচারকগণ যুক্তি হিসেবে উপস্থাপন করেন  – “আইনজীবীদের কালো পোশাক পরা একটি প্রথা যা রাণী অ্যান – এর মৃত্যুর পর থেকে চলে এসেছে। আইনজীবীগণ কালো পোশাক পরিধান করেন ইউরোপিয়ান ধাঁচে এবং এটি একটি কনভেনশন হিসেবে গৃহীত হয়েছে। অতএব, এটি পরিবর্তনের কোন প্রয়োজন নেই৷”

সাদা লম্বা পরচুলা (Wig) সম্পর্কে না বললে কিছুটা কমতি থেকে যায়। তাই সুপ্রিয় পাঠকের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি যে, আমাদের দেশে এ রেওয়াজ ইতোমধ্যে উঠে গিয়েছে। কিন্তু প্রধান বিচারপতি এখনও পরচুলা পরে থাকেন।

প্রসঙ্গত, বিচারকের পরচুলা পরিধান ব্যতিরেকে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে এখনো কোনো বিচার কাজ সম্পন্ন হয় না। তারা অদ্যাবধি এর গুরুত্ব এবং নিগুঢ় দর্শন আঁঁকড়ে ধরে আছেন।

উল্লেখ্য, সাদা পরচুলার পিছনের রহস্য হলো সাদা কেশি বৃদ্ধ মা জননী সন্তানের প্রতি যেমন স্নেহপরায়ণ থাকেন, তার কাছে সকল সন্তান একই ধরনের এবং সমান। কারো প্রতি অবিচার করার মানসিকতা থাকে না। সে আলোকে দু’পক্ষই (বাদী ও বিবাদী) তার সন্তান বলে বিবেচ্য বিধায় সঠিক বিচারের পথ সমুন্নত থাকে, কোনো পক্ষপাতিত্বের অবকাশ থাকে না। এজলাসে দু’পক্ষের কথা ও আবেদন মায়ের মত আন্তরিকভাবে শুনে ঠাণ্ডা মাথায় রায় (Verdict) দিয়ে থাকেন। যাতে বিবাদী আত্মপক্ষ সমর্থনের (Self Defence) মৌলিক অধিকার (Fundamental Right) ও ন্যায়পরায়ণতা (Equity) বরখেলাপের এতটুকু সুযোগ না থাকে।

এর আগে বাংলাদেশসহ ব্রিটিশ কলোনিগুলোর বেঞ্চে, বিচারকদের পরিধানকৃত কালো কোট বা গাউনের হাতা ব্যক্তির হাতের চেয়ে লম্বা রাখার রেওয়াজ ছিল। এখন আর সে রীতির প্রচলন নেই। তবে যুক্তরাজ্যে এই বিধি এখনও মেনে চলা হচ্ছে। লম্বা হাতার ব্যাখ্যা হলো, আইনের হাত এত দীর্ঘ যে, আসামি যেখানেই লুকিয়ে থাকুক না কেন, এ হাত তাকে খুঁজে বের করবেই। অন্যভাবে বলা হয়ে থাকে, অপরাধী যত জ্ঞান বা ক্ষমতার অধিকারী হোক না কেন, আইনের হাত লম্বা বিধায় সংশ্লিষ্ট সাজাপ্রাপ্ত আসামি বেঞ্চের রায় মানতে বাধ্য।

মূলত আমরা উপনিবেশকে মনে প্রাণে লালন পালন করেই চলছি। প্রাচ্যবিদ এওয়ার্ড সাঈদ বলেন,”উপনিবেশ প্রক্রিয়াটি এমন ছিলো যে, একটি দেশ থেকে কিছু মানুষ অন্য দেশে গিয়ে দখলদারিত্ব কায়েম করার জন্য প্রথমে ব্যবসায়ীরা গিয়েছে। এরপর সমর শক্তি। সবশেষে প্রশাসন গিয়ে সেখানে একটি প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করে কাজ শুরু করেছে। ফলশ্রুতিতে ভীত মজবুত হয়েছে ঔপনিবেশিকতার।”

আমাদের সংস্কৃতিই মূলত ঔপনিবেশিকতার ফসল, ড্রেসকোডও। নইলে এই নিদারুণ গরমে একজন আইনজীবী কেনই বা গাউন, কোট পরে থাকবেন। 

লেখক: ফাইজুল ইসলাম, শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।