বাংলাদেশ শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্ট আইন, ২০০১ একটি সাধারণ আলোচনা
শাহ্ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সাংবিধানিক পদধারী ব্যক্তিবর্গের শপথ: একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা

শাহ্ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান: সাংবিধানিক পদধারী ব্যক্তিদের শপথের মধ্যে রয়েছে গভীর তাৎপর্য। এ সকল পদধারী একজন ব্যক্তি মাত্র নন, তাঁরা প্রতিষ্ঠান। এজন্য সাংবিধানিক পদধারী ব্যক্তিদের শপথকে অফিসের শপথও বলা হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় তফসিলে যেসব পদধারীর উল্লেখ রয়েছে, তাঁরা সবাই শপথের অধীন। এসব পদধারী কোনো পদে নির্বাচিত বা নিযুক্ত হলে শপথগ্রহণ ছাড়া পদে আসীন হন না। তাঁরা অফিসের দায়িত্ব গ্রহণ করার আগে শপথগ্রহণের প্রয়োজন হয়।

আবার এসব পদধারী পদ থেকে পদত্যাগ বা অবসর গ্রহণ করলে বা অন্য যেকোনো কারণে তাঁদের পদ শুন্য হলে তারা তাঁদের শপথ থেকে অবমুক্ত হয়ে যান। বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সাংবিধানিক পদধারীদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে শপথগ্রহণের গুরুত্ব অপরিসীম। কোনো সাংবিধানিক পদের শপথগ্রহণ হলো উক্ত পদের অন্তর্নিহিত প্রেরণা।

আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সাংবিধানিক পদধারীদের শপথগ্রহণ পদ্ধতি প্রায় একই ধরনের। এই শপথ গ্রহণ কখনও সীমিত পরিসরে ব্যক্তিগতভাবে বা পাবলিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে যেসব পদ সুনির্দিষ্টভাবে নিয়োগ ও যোগ্যতা বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে – সেসব পদগুলো হলো সাংবিধানিক পদ।

সংবিধানে উল্লিখিত পদগুলো হলো: মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, সংসদ সদস্য, প্রধান বিচারপতি এবং সুপ্রীম কোর্টের আপীল ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অপরাপর কমিশনার, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, ন্যায়পাল, অ্যাটর্নি জেনারেল, সরকারি কর্মকমিশনের সভাপতি ও অপরাপর সদস্য।

প্রসঙ্গত, অ্যাটর্নি জেনারেলের পদটি সাংবিধানিক পদ হলেও এপদের শপথ গ্রহণ করতে হয় না। অ্যাটর্নি জেনারেল রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হন এবং নিয়োগ লাভের পর তিনি রাষ্ট্রপতি বরাবরে যোগদানপত্র দাখিল সাপেক্ষে পদে আসীন হন। এছাড়া ন্যায়পাল পদটিও শপথের অধীন নয়। সংবিধানে ন্যায়পালের পদের বিধান থাকলেও সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদের অনুকূলে এখনও এপদে নিয়োগ দেওয়া হয়নি।  উল্লেখ্য, ২০০৭ সালে কর ন্যায়পাল পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল- পরবর্তীকালে এসংক্রান্ত আইনটি রদ করা হয়।

সাংবিধানিক পদধারীদের মধ্যে রাষ্ট্রীয় মান ক্রমে রাষ্ট্রপতির অবস্থান সবার শীর্ষে। রাষ্ট্রপতির পরবর্তী অবস্থানে প্রধানমন্ত্রী, এরপরের অবস্থান যথাক্রমে স্পিকার ও প্রধান বিচারপতির। রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপ্রধান রূপে রাষ্ট্রের অন্যসব পদধারীদের ঊর্ধ্বে স্থান লাভ বিষয়ে সংবিধানেও উল্লেখ রয়েছে। অ্যাটর্নি জেনারেল ও ন্যায়পাল এ দুটি সাংবিধানিক পদ ছাড়া অন্যান্য সব সাংবিধানিক পদধারীদেরকে শপথ গ্রহণ করতে হয়। শপথ পাঠ ব্যতিত তাঁরা পদে আসীন হতে পারেন না এবং শপথ পাঠ ব্যতিত তাঁদের কারও দায়িত্ব পালনের অবকাশ নেই।

উল্লেখ্য, সাংবিধানিক পদধারীরা শপথে- ‘… আমি সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তাবিধান করিব’ এ কথাটি বলেন। তবে সাংবিধানিক পদধারী ব্যক্তিবর্গের মধ্যে শুধু সংসদ সদস্যরা একথাটি বলেন না। এ কারণে তারা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের বিধান মোতাবেক সংবিধান সংশোধন অংশগ্রহণ করতে পারেন।

১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল তারিখে মুজিবনগরে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামক নবীন রাষ্ট্রের যে সরকার গঠিত হয়েছিল তার সাংবিধানিক ভিত্তি ছিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র আদেশ। ঘোষণাপত্র অনুযায়ী অধ্যাপক ইউসুফ আলী মুজিবনগরে মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ পরিচালনা করেন। ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল মুজিবনগরে গৃহীত বাংলাদেশের প্রথম অন্তবর্তীকালীন সংবিধান হলো ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’। এ ঘোষণাপত্রের বিধান অনুযায়ী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্র আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং ঘোষণাপত্রের বিধানের আলোকেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করা হয়।

১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান বলবৎ হয়। এ সংবিধানে তৃতীয় তফসিল অনুযায়ী সাংবিধানিক পদধারী মহামান্য রাষ্ট্রপতি, স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার, সুপ্রীম কোর্টের আপীল ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার, মহাহিসাব-নিয়ন্ত্রক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্মকমিশনের সদস্যদের শপথ প্রধান বিচারপতির উপর এবং প্রধানমন্ত্রী ও সময়ে সময়ে সৃষ্ট উপপ্রধানমন্ত্রী, অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, ও উপমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতির শপথ মহামান্য রাষ্ট্রপতির উপর ও সংসদ সদস্যগণের শপথ স্পিকার কর্তৃক পরিচালিত হতো।

সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির শপথ পরিচালনার দায়িত্ব প্রধান বিচার পরিবর্তে স্পিকারের উপর, উপরাষ্ট্রপতির বিধান হলে তাঁর শপথ রাষ্ট্রপতির উপর অর্পণ করা হয়। স্পিকার, ডেপুটি স্পিকারের শপথ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক পরিচালিত হয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরে রাষ্ট্রপতির শপথ প্রধান বিচারপতির উপর অর্পণ করা হয়েছিল। ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্টপতির শপথ পুনঃরায় স্পিকারের উপর অর্পণ করা হয়।

প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর শপথ রাষ্ট্রপতি এবং সংসদ সদস্যদের শপথ স্পিকার কর্তৃক পূর্বাপর পরিচালিত হচ্ছে। সংবিধান প্রণয়ন থেকে অদ্যাবধি প্রধান বিচারপতির শপথ রাষ্ট্রপতি এবং সুপ্রীম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট ভিভাগের অন্যান্য বিচারপতির শপথ প্রধান বিচারপতি পরিচালনা করে আসছেন।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অপরাপর নির্বচন কমিশনারের শপথ পূর্বাপর প্রধান বিচারপতি পরিচালনা করছেন। মহাহিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্মকমিশনের সভাপতি ও অপরাপর সদস্যের শপথ গ্রহণ পূর্বাপর প্রধান বিচারপতি কর্তৃক পরিচালিত হয়ে আসছে।

সময়ে সময়ে সংবিধানে সংশোধনীর মাধ্যমে শপথ গ্রহণ পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত পদধারীদের পরিবর্তন হয়েছে। আধুনিক বিশ্বের রাষ্ট্রব্যবস্থায় সর্বোচ্চ পদধারীদের শপথ বাক্য পাঠ ও শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা পদ্ধতি একই ধরনের। সাংবিধানিক একটি পদের শপথগ্রহণ পরিচালনার জন্য সংবিধানে নির্ধারিত পদধারী ছাড়া অন্য কেউ শপথ কার্য পরিচালনা করলে তা অসাংবিধানিক, বেআইনি ও অকার্যকর হবে।

সাংবিধানিক পদধারীদের শপথ গ্রহণ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সাংবিধানিক পদধারী ব্যক্তিগণ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারা, সাংবিধানিক আইন ও আইনের শাসন এবং মৌলিক মানবাধিকারকে সমুন্নত করে তাঁদের উপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করছেন।

লেখক: গবেষক