খেলাপি ঋণ আদায়ে অর্থঋণ আদালতকে কার্যকর করার কিছু সুপারিশ
মোঃ জাহিদ হোসেন

খেলাপি ঋণ আদায়ে অর্থঋণ আদালতকে কার্যকর করার কিছু সুপারিশ

মোঃ জাহিদ হোসেন: যখন কোনো কারণে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় পর কোনো ঋণ বা ঋণের কিস্তি ফেরত পাওয়া যায় না বা সম্ভব হয় না; তখন ওই ঋণকে খেলাপি ঋণ বলে। বর্তমান বাংলাদেশের অর্থনীতি তথা ব্যাংক খাতের প্রধান সমস্যা এই খেলাপি ঋণ। অনেক পদ্ধতি, কৌশল ও প্রচেষ্টা অবলম্বনের পরও তা আজও হাতের নাগালের বাইরে। তবে নিম্নেউল্লেখিত সুপারিশগুলো অনুসরণ করা হলে খেলাপি ঋণ আদায় করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণ খেলাপি হওয়ার প্রবণতা কমবে বলে বিশ্বাস করি।

১. অর্থ ঋণ আদালত আইন, ২০০৩ এর ৩৪(১) ধারা অনুযায়ী আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ডিক্রীর টাকা পরিশোধে বাধ্য করার জন্য আদালত দায়িককে ৬ মাস পর্যন্ত দেওয়ানি কারাগারে আটক রাখতে পারবে৷ কিন্তু ৩৪(১২) ধারা অনুযায়ী, কোন একজন দায়িককে একবার গ্রেফতার করে পরিপূর্ণ মেয়াদের জন্য দেওয়ানি কারাগারে আটক রাখা হলে, তাকে পুনরায় গ্রেফতার ও দেওয়ানি কারাগারে আটক করা যাবে না।

এক্ষেত্রে আটকাদেশের মেয়াদ শুধু ৬ (ছয়) মাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বরং খেলাপি ঋণের টাকার পরিমাণ অনুযায়ী তা ৬ মাস হতে ৬ বছর পর্যন্ত বর্ধিত করা যেতে পারে। অন্তত দেওয়ানী কারাগারে আটকাদেশের মেয়াদ বেশি হলে বড় ঋণ খেলাপিরা বাধ্য হয়ে খেলাপি ঋণের টাকা পরিশোধে আরও তৎপর হবে। সেই সাথে দেশে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি হওয়ার প্রবণতা শুরু থেকেই কমে যাবে।

২. অর্থ ঋণ আদালত আইন, ২০০৩ এর ধারা ৪৬ অনুযায়ী কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠান সম্পাদিত চুক্তি বা চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ঋণ গ্রহীতা হতে ঋণ পরিশোধ সূচী অনুযায়ী ঋণ পরিশোধ শুরু হবার পরবর্তী- (ক) প্রথম এক বত্সরে প্রাপ্য অর্থের অন্যূন ১০%, বা (খ) প্রথম দুই বত্সরে প্রাপ্য অর্থের অন্যূন ১৫%, বা (গ) প্রথম তিন বত্সরে প্রাপ্য অর্থের অন্যূন ২৫% পরিমাণ অর্থ আদায় না হলে, পরবর্তী এক বত্সরের মধ্যে মামলা দায়ের করার বিধান রয়েছে। আর উল্লিখিত ঋণ পরিশোধ সূচী অনুযায়ী ঋণ পরিশোধের নির্ধারিত সাকুল্য মেয়াদ ৩ (তিন) বত্সর অপেক্ষা কম হলে উক্ত নির্ধারিত সাকুল্য মেয়াদের মধ্যে আদায়ের পরিমাণ ২০% অপেক্ষা কম হলে তার পরবর্তী ১ (এক) বত্সরের মধ্যে মামলা দায়ের করার বিধান রয়েছে।

এক্ষেত্রে দেখা যায়, এই ধারা অনুযায়ী মেয়াদী ঋণের ক্ষেত্রে বিধান করা হলেও যেমন- সিসি (হাইপো) ঋণ অর্থাৎ বছর থেকে বছরে নবায়ন হয় এমন ঋণের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট ভাবে বলা হয়নি। উল্লেখ্য ঋণ পুনঃ তফসিল (Reschedule) এবং ঋণ নবায়ন একই বিষয় নয়। এক্ষেত্রে এমন চলমান ঋণ (Continuous Loan) এর ক্ষেত্রে আইনে সুস্পষ্ট বিধান রাখা উচিত যাতে সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা সঠিক সময়ে মামলা দায়ের করতে দিক নির্দেশনা পান।

৩. মামলা চলাকালীন অর্থঋণ আদালতের কোন আদেশ বা ডিক্রীকে চ্যালেঞ্জ করে ঋণগ্রহীতা মহামান্য হাইকোর্টে কোন রিট মামলা দায়ের করলে সেক্ষেত্রে দেখা যায় উক্ত রিট মামলাটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত অধস্তন আদালতে দায়েরকৃত অর্থঋণ বা অর্থজারী মামলা বছরের পর বছর স্থগিত হয়ে থাকে। এতে একদিকে যেমন আদালতের ঘাড়ে মামলা জট বাড়ে তেমন অন্যদিকে বাদী আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ আদায় অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে রিট মামলা দায়েরের সময় ঋণগ্রহীতা যাতে বাদী আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাওনা টাকার ২০% বা ২৫% টাকা জমা দিয়েই রিট করে তেমন বিধান করা যেতে পারে।

৪. অর্থঋণ আদালত আইনের অধীনে মামলা দায়ের ও পরিচালনার ক্ষেত্রে বাদী আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারী সরল বিশ্বাসে কোন কর্ম করে থাকলে, সেক্ষেত্রে দায়মুক্তির ক্ষমতা আদালতের বিবেচনার উপর ছেড়ে দেওয়া উচিত যাতে মামলা পরিচালনায় তারা অহেতুক হয়রানীর শিকার না হন।

৫. ডিক্রীর টাকা পরিশোধে বাধ্য করার প্রয়াস হিসাবে দায়িককে দেওয়ানি কারাগারে আটক রাখা ছাড়াও আরও কিভাবে বাধ্য করা যায় সেই বিষয়ে অর্থঋণ আদালত আইনে কিছু বিধান যুক্ত করা যেতে পারে। যেমন: পাসপোর্ট জব্দের ক্ষমতা, নতুন ব্যবসা করতে না পারা, কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে না পারার বিধানও এই আইনে সরাসরি অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

৬. এই আইনে খেলাপি ঋণের দায় সমন্বয়ে বাদী আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের কি কি দায়-দায়িত্ব থাকবে এবং ঋণগ্রহীতারও কি কি দায়-দায়িত্ব থাকবে সেই মর্মে কিছু বিধান যুক্ত করা যেতে পারে।

৭. আইনে ঋণগ্রহীতার উত্তরাধিকারদেরও ঋণ গ্রহীতার মতই সমান দায়ী করে মামলা চালাবার বিধান রাখতে হবে। যদি তারা মৃত ঋণগ্রহীতার সম্পত্তি ভোগ করে। তাই তাদেরও দেওয়ানি আটকাদেশের আওতায় আনাতে হবে। এর অন্যথা হলে উত্তরাধিকারী ঋণ পরিশোধে আগ্রহী হবে না।

৮. বিদ্যমান আইনে অর্থঋণ মামলার জারী পর্যায়ে নিলামের ব্যবস্থা রয়েছে মাত্র। মূল মামলায়ও যাতে উপযুক্ত ক্রেতা পেলে নিলামের মাধ্যমে জামানত বিক্রি করে ঋণের টাকা সমন্বয় করা যায় সেই বিধান করতে হবে। অর্থাৎ মূল মামলা দায়েরের দিন থেকে রায়ের আগ পর্যন্ত নিলাম এর বিধান রাখা যেতে পারে।

৯. খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১০ কোটি টাকার বেশি হলে সেসব ক্ষেত্রে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির বিধান রেখে আইন সংশোধন করা যেতে পারে।

১০. অর্থঋণ মূল মামলায় সাক্ষ্য পর্যায় সংক্ষিপ্ত রাখার বিধান করা। যেমন: বিবাদী যাতে অহেতুক জেরার নামে সময়ক্ষেপণ করতে না পারে। কারণ বর্তমানে জেরার নামে বছরের পর বছর মামলা দীর্ঘায়িত করা হয়।

১১. খেলাপি ঋণের দাবী ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত হলে সেক্ষেত্রে এর বিপরীতে দায়েরকৃত আপিল/রিভিশন মামলা জেলা জজ আদালতে নিষ্পত্তির বিধান করা।

১২. দায়েরকৃত অর্থঋণ মামলায় যদি কোন জামানত না থাকে সেক্ষেত্রে ঋণ খেলাপির মালিকানাধীন সম্পত্তির ক্রোকের জন্য খুঁজে বের করার দায়িত্ব পুলিশের বিশেষ বা প্রশাসনের অন্য কোন সংস্থাকে দায়িত্ব অর্পণের বিধান করা। যেহেতু এসব খুঁজে বের করতে প্রশাসনের যথেষ্ট ক্ষমতা ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা আছে।

১৩. মামলায় ঋণ খেলাপি, জামিনদার, বন্ধকদাতার পাশাপাশি সিএনএফ এজেন্ট, কাস্টম কর্তৃপক্ষ ও প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পক্ষকে পক্ষভুক্ত করার বিধান রাখা যাদের অপরাধমূলক সহযোগিতায় কোন ঋণ খেলাপির উৎপত্তি।

১৪. অর্থঋণ সংক্রান্ত দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির জন্য অর্থঋণ আদালতের সংখ্যা বাড়াতে হবে। বর্তমানে দেশে এ আদালতের সংখ্যা খুবই কম। কিন্তু সেই তুলনায় মামলার সংখ্যা অনেক বেশি। আদালতের তুলনায় মামলা বেশি বলে মামলাগুলোর মেরিট বিবেচনায় নিষ্পত্তি হতে সময় বেশি লেগে যাচ্ছে।

১৫. অর্থঋণ মামলার বিভিন্ন পর্যায়ে মধ্যস্থতা কার্যক্রম মামলাকে বিলম্বিত করে। এটা বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে দেখা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় অর্থঋণ মামলায় মধ্যস্থতা কার্যক্রম সফল হয় না। সেক্ষেত্রে এই আইনের অধীনে দায়েরকৃত মামলায় মধ্যস্থতা কার্যক্রম বাতিল করা উচিত।

১৬. খেলাপি ঋণের দায় আদায়ে কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শুধু নিম্ন পর্যায়ে কর্মরত কর্মকর্তাদের উপর দায় না চাপিয়ে আইনের মাধ্যমে উক্ত দায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের উচ্চ বা ব্যবস্থাপনা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের উপরও দায় দায়িত্ব সমভাবে অর্পণ করা সমীচীন। এতে দেশে খেলাপি ঋণের দায় আদায় জোরদার হবে।

১৭. অনেক সময় বিবাদী পক্ষ অর্থাৎ ঋণ খেলাপিরা উচ্চ আদালতে সংশ্লিষ্ট মামলা বিষয়ে বা আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে কোন মামলা করেছে মর্মে ল’ইয়ার সার্টিফিকেট নিয়ে এসে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর মামলা স্থগিত করে রাখে। যদিও এতে উচ্চ আদালত হতে কোন স্থগিত আদেশ প্রদান করা হয়নি।

আবার অনেক সময় দেখা যায়, পরবর্তী ধার্য তারিখে বিবাদীপক্ষ স্থগিত আদেশের সার্টিফাইড কপি দাখিল করবে বলে আদালতে বার বার সময়ের আবেদন দেয়। এভাবে তারা সময়ক্ষেপণ করে প্রতিটা ধার্য তারিখে। এটা মূলত আদালতের সাথে প্রতারণা করার শামিল। তাই আইন করে এসব বন্ধ করা উচিত। বিশেষ করে মূল অর্থঋণ মামলায় বিজ্ঞ আদালতের এই বিষয়টা বিবেচনায় আনা উচিত।

লেখক: সিনিয়র অফিসার (আইন), অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড।