প্রকাশ্যে ধূমপান যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট
প্রকাশ্যে ধূমপান

পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ধূমপান নিয়ন্ত্রণে আইন কতটা কার্যকর?

সোয়েব আক্তার: দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে যারা ধূমপান করেন না তাদের কাছে প্রায়শই যে বিষয়টি বিরক্তির সৃষ্টি করে সেটা হলো পথিমধ্যে অন্য কারো ধূমপানের ধোয়া নাকের মধ্যে ঢুকে পড়া। এটা যতটা মানসিক বিরক্তিকর ততটা শারীরিক ক্ষতিকরও। পাবলিক প্লেস কিংবা পাবলিক পরিবহনে এরকম অনায়াসে ধূমপান করাটা নতুন কিছু নয়। এসব পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আমাদের রয়েছে একটি বিশেষ আইন “ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫”।

এ আইনের প্রস্তাবনা অনুযায়ী এটা তৈরি করা হয়েছে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের উৎপাদন, ব্যবহার, ক্রয়-বিক্রয় ও বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে৷ এসবের মধ্যে পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে ধূমপান নিয়েও বেশ কিছু বিধান রয়েছে যেখানে পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে ধূমপানকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন আসে, কোনগুলো পাবলিক প্লেস কিংবা পাবলিক পরিবহন?

এর ব্যাখ্যা আছে এ আইনের ধারা ২ এ, যেখানে বলা হয়েছে “পাবলিক প্লেস” অর্থ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস, আধা-সরকারি অফিস, স্বায়ত্তশাসিত অফিস ও বেসরকারি অফিস, গ্রন্থাগার, লিফট, আচ্ছাদিত কর্মক্ষেত্র (indoor workplace), হাসপাতাল ও ক্লিনিক ভবন, আদালত ভবন, বিমানবন্দর ভবন, সমুদ্রবন্দর ভবন, নৌ-বন্দর ভবন, রেলওয়ে স্টেশন ভবন, বাস টার্নিমাল ভবন, প্রেক্ষাগৃহ, প্রদর্শনী কেন্দ্র, থিয়েটার হল, বিপণী ভবন, চতুর্দিকে দেয়াল দ্বারা আবদ্ধ রেস্টুরেন্ট, পাবলিক টয়লেট, শিশুপার্ক, মেলা বা পাবলিক পরিবহনে আরোহণের জন্য যাত্রীদের অপেক্ষার জন্য নির্দিষ্ট সারি, জনসাধারণ কর্তৃক সম্মিলিতভাবে ব্যবহার্য অন্য কোন স্থান অথবা সরকার বা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান কর্তৃক, সাধারণ বা বিশেষ আদেশ দ্বারা, সময় সময় ঘোষিত অন্য যে কোন বা সকল স্থান। একই ধারায় পাবলিক পরিবহনের কথা বলা হয়েছে “পাবলিক পরিবহণ” অর্থ মোটর গাড়ী, বাস, রেলগাড়ী, ট্রাম, জাহাজ, লঞ্চ, যান্ত্রিক সকল প্রকার জন-যানবাহন, উড়োজাহাজ এবং সরকার কর্তৃক, সরকারী গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, নির্দিষ্টকৃত বা ঘোষিত অন্য যে কোন যান।

অর্থাৎ এসব জায়গায় ধূমপান করা যাবে না। আর করলে সেটা ধারা ৪ অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ হবে যার জন্য অনধিক তিনশত টাকা অর্থদন্ডে দন্ডনীয় হইবেন। সবথেকে উদ্রেক কিংবা চিন্তা-ভাবনার বিষয় হলো ধারা ৪ কোন একক ধারা নয়। এর কিছু ব্যতিক্রমও রয়েছে, যখন পাবলিক পরিবহনে ধূমপান করলেও সেটা অপরাধ বলে বিবেচিত হবে না!!

এই আইনেরই ধারা ৭ অনুযায়ী  কোন পাবলিক প্লেসের মালিক, তত্ত্বাবধায়ক বা নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি বা ব্যবস্থাপক উহাতে এবং কোন পাবলিক পরিবহণের মালিক, তত্ত্বাবধায়ক, নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি বা ব্যবস্থাপক উহাতে ধূমপানের জন্য স্থান চিহ্নিত বা নির্দিষ্ট করিয়া দিতে পারিবেন৷ এসব পাবলিক প্লেস এবং পাবলিক পরিবহনের এসব চিহ্নিত স্থানে ধূমপান করলে সেটা ধারা ৪ এর অধীনে অপরাধ বলে বিবেচিত হবে না।

এ আইনের নাম এবং প্রস্তাবনা দেখলে এটা সহজেই অনুমেয় যে আইনটি ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্যই করা হয়েছে। ধারা ৪ দেখলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার মনে হয়। কিন্তু বিষয়টি জটিল এবং চিন্তা উদ্রেককারী মনে হবে ধারা ৭ ভালোভাবে বিবেচনায় নিলে। একদিকে এ আইন ধূমপান নিয়ন্ত্রণের কথা বল্লেও এসব পাবলিক পরিবহন ও পাবলিক প্লেসে ধূমপান করার বিশেষ ব্যবস্থার কথাও বলা হয়েছে!!

এ আইনকে কার্যকরভাবে প্রয়োগ করার জন্য ২০১৫ তৈরি করা হয় “ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০১৫” যেখানে আরো বিস্তারিতভাবে অনেক কিছু বলা আছে। যার মধ্যে পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে ধূমপানের জন্য নির্দিষ্ট স্থান কেমন হবে ইত্যাদি বলা আছে।

এ আইনের প্রয়োগের পদ্ধতির দিকে নজর দিলে দেখা যায় কতিপয় কর্মকর্তার হাতে ক্ষমতা দেয়া আছে। ধারা ২ অনুযায়ী “কর্তৃত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা” অর্থ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা বা তাঁহার সমমানের বা তদূর্ধ্ব পদমর্যাদার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোন কর্মকর্তা এবং এতদ্‌সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপালনের জন্য কোন আইনের অধীন, বা সরকার কর্তৃক সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা, ক্ষমতাপ্রাপ্ত যে কোন বা সকল কর্মকর্তাও ইহার অন্তর্ভুক্ত হইবে। ২০১৫ সালের বিধিমালায় আরো কিছু কর্মকর্তার নাম যুক্ত করা হয়েছে- সাব-ইন্সপেক্টরের নিম্নে নয় এমন পুলিশ কর্মকর্তা, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক এর নিম্নে নয় এমন কর্মকর্তাসহ বেশ কয়েক ধরণের কর্মকর্তা যারা তাদের স্ব স্ব অধিক্ষেত্রে কোন পাবলিক প্লেস কিংবা পাবলিক পরিবহণে প্রবেশ করিয়া পরিদর্শন করিতে পারিবেন এবং এই আইনের বিধান লংঘন করিয়াছেন এমন কোন ব্যক্তিকে কর্তৃত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কোন পাবলিক প্লেস বা পাবলিক পরিবহণ হইতে বহিষ্কার করিতে পারিবেন৷ এছাড়াও তাদের শাস্তি নিশ্চিত করাী জন্য নির্ধারিত আদলতে লিখিত অভিযোগ দিতে পারেন।

এ আইনটি সবচেয়ে বেশি সমালোচনার মুখোমুখি হওয়ার জন্য ২টি বিষয় আছে। প্রথমটি, পাবলিক প্লেস বলতে কতিপয় স্থানকে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে আর দ্বিতীয়টি, কর্তৃত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার লিখিত অভিযোগ ব্যতিরেকে কোন আদালত এই আইনের অধীন কোন অপরাধ বিচারের জন্য গ্রহণ করিবে না৷ অর্থাৎ কোন ব্যক্তিকে পাবলিকে প্লেস কিংবা পাবলিক পরিবহনে ধূমপানের জন্য শাস্তি দিতে চাইলে এ আইন এবং বিধিমালাতে উল্লেখিত স্থানে ধূমপান করতে হবে এবং কর্তৃত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার লিখিত অভিযোগের প্রয়োজন হবে। সুতরাং চাইলেই খুব সহজে পাবলিক প্লেস/পরিবহনে ধূমপায়ী ব্যক্তিকে ধূমপানের জন্য এ আইনের অধীনে দায়ী করা যাচ্ছে না কতিপয় প্রয়োগগত জটিলতার কারণে। এসব জটিলতা দূর করতে পারলে বিশেষ করে পাবলিক প্লেসের সংজ্ঞাকে নির্দিষ্ট স্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে এভাবে ব্যাখ্যা করা যে, পাবলিক প্লেস বলতে এমন জায়গাকে বুঝাবে যেখানে সর্বসাধারণের প্রবেশাধিকার আছে। এছাড়াও পাবলিক প্লেস/পরিবহনে ধূমপানের জন্য “ধূমপানের জন্য নির্দিষ্ট স্থান” বলে যে বিধান এ আইনে রয়েছে সেটাকেও বাদ দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করে দেখা দরকার। এ আইনের অধীনে অপরাধের জন্য যে অর্থদন্ডের কথা বলা আছে সেটাও বাড়ানোর বিষয়টি ভেবে দেখা এখনি জরুরি। সর্বোপরি এসব বিষয়গুলো বিবেচনা করে আইনটিকে সংশোধন করা গেলে পাবলিক প্লেস/পরিবহনে ধূমপান নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি।

লেখক: সোয়েব আক্তার, শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।