প্রসঙ্গ : আইন পেশার ইতিহাস ও আইনজীবী হওয়ার যোগ্যতা
অ্যাডভোকেট দীপজয় বড়ুয়া

দলিলের সংজ্ঞা, প্রকারভেদ ও দলিল জালের শাস্তি এবং প্রতিকার প্রসঙ্গ

দীপজয় বড়ুয়া: দলিল শব্দটি শুনলেই আমাদের স্মরণে আসে লিখিত কোন নথিমালা। যার মাধ্যমে কোন সম্পদ বা বস্তুর উপর সংশ্লিষ্ট পক্ষ বা পক্ষসমূহের আইনি অধিকার নিশ্চিত হয়ে থাকে। দলিল লেনদেনের একটি মাধ্যম। কারণ, লেনদেনের ক্ষেত্রে দলিল ব্যবহার ছাড়া এর সুনির্দিষ্ট গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণিত হয়না।

সাধারণ অর্থে দলিল হচ্ছে কোনো চুক্তি বা লেনদেনের লিখিত এবং সর্বগ্রহণীয় রূপ। জমির ক্ষেত্রে জমির মালিকানা প্রমাণের লিখিত সাক্ষ্যই দলিল। সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ এর ৩ নং ধারা অনুযায়ী দলিল বলতে বুঝায় কোন পদার্থের উপর কোন অক্ষর, সংখ্যা বা চিহ্নের সাহায্যে বর্ণিত কোন ব্যবহার হতে পারে এমন বিষয়কে দলিল বলা হয়।

দলিলের প্রকারভেদ

সাক্ষ্য আইনে বাংলাদেশের দলিল সমূহকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা:-

(১) সরকারী দলিল (Public documents)

সাক্ষ্য আইনের ৭৪ ধারা মতে নিম্নবর্ণিত দলিলগুলো সরকারী দলিলের অন্তর্ভুক্ত।

সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের কার্যাবলীর লিখিত বিবরণাদি ও নথিপত্র; সংসদের আইন প্রভৃতি এর আওতাভুক্ত। সরকারী সংস্থা এবং Tribunal এর কার্যাবলীর লিখিত বিবরণাদি ও নথিপত্র; বাংলাদেশের বা কমনওয়েলথের কোন অংশের বা বিদেশের আইন বিভাগীয়, বিচার বিভাগীয় কোন কর্মচারীর কার্যাবলীর লিখিত বিবরণাদি ও নথিপত্র; বাংলাদেশ সরকারের হেফাজতে রক্ষিত ব্যক্তিগত দলিলের নথিপত্র, ব্যক্তিগত রেজিষ্ট্রি দলিলের বিবরণ যা সরকারী হেফাজতে রেজিষ্ট্রি অফিসে রাখা হয় তা এ নিয়মের অধীন।

(২) ব্যক্তিগত দলিল (Private documents)

সাক্ষ্য আইানের ৭৫ ধারানুসারে উপরোক্ত ৭৪ ধারায় বর্ণিত দলিলাদি ব্যতীত সকল প্রকার দলিল ব্যক্তিগত দলিল।

ব্যক্তিগত জমির দলিল কত প্রকার ও কি কি?

বাংলাদেশ ভূমি আইন অনুযায়ী জমির দলিল মোট ৯ ধরনের হয়ে থাকে। ১। সাফ-কবলা দলিল, ২। দানপত্র দলিল, ৩। হেবা দলিল, ৪। হেবা বিল এওয়াজ দলিল, ৫। এওয়াজ দলিল, ৬। বন্টন নামা দলিল, ৭। অসিয়তনামা দলিল, ৮। উইল দলিল এবং ৯। না-দাবি দলিলকার দলিল ব্যক্তিগত।

দলিলের গুরুত্ব

জমি ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে দলিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে দলিল। অনেকেই অজ্ঞতা প্রসূত দলিলের গুরুত্ব অনুধাবন না করে জমি ক্রয় করে নানা ঝামেলায় পরেছেন এবং পরছেন। ঘুরতে হচ্ছে আদালতের দ্বারে দ্বারে। এতে একদিকে যেমন অর্থের শ্রাদ্ধ হয়, অন্যদিকে হয় মূল্যবান সময়ের অপচয়। এজন্য অথযা হয়রানি এড়াতে জমি ক্ররের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধাপে দলিল যাচাই-বাছাই বাঞ্ছনীয়।

জমি কেনার আগে করণীয়

জমি কেনার আগে নিম্নোলিখিত বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে দেখা উচিৎ। যেমন-

১। জমি বিক্রেতার নামে রেজিষ্ট্রিকৃত দলিল আছে কিনা অথবা জমির বৈধ স্বত্ব আছে কিনা, এমনকি দখলি স্বত্ব আছে কিনা।
২। হালসন পর্যন্ত খাজনা পরিশোধের রশিদ আছে কিনা।
৩। দলিলে উল্লেখিত পরিমাণ জমি তার দখলে আছে কিনা।
৪। জমিটি আংশিক বা সম্পূর্ণ বিক্রি করা হয়েছে কিনা।
৫। জমিটিতে অন্য কোন ওয়ারিশ আছে কিনা।
৬। জমির দলিলটি জাল কিনা।
৭। মালিকের নামে জমিটি খারিজ করা আছে কিনা।
৮। দলিলে উল্লেখিত দাগ নম্বর নকশার সঙ্গে মিল আছে কিনা এবং রেকর্ডের সঙ্গে খতিয়ান নম্বরের কোন মিল আছে কিনা।
৯। বিক্রেতা ক্রয়সূত্রে মালিক নাকি উত্তরাধিকার সূত্রে জমিটির মালিক হয়েছেন।
১০। জমি বর্গা বা বন্ধক দেওয়া আছে কিনা।
১১। দেখতে হবে জমিটির সহশরিকগণ জমিটি কিনতে চায় কিনা।
১২। উকিল নোটিশ করা আছে কিনা।
১৩। সরোজমিনে জমি মেপে ভালোভাবে খোঁজ নেওয়া।
১৪। নকশার সঙ্গে দলিলে উল্লেখিত জমির পরিমান ঠিক আছে কিনা ইত্যাদি।

জমি কেনার সময় করণীয়

(১) জমির দলিলের স্ট্যাম্প ক্রেতার নামে খরিদ করা ও রশিদ যত্নসহকারে রাখা।
(২) দলিল রেজিষ্ট্রির সময় ক্রেতা ও বিক্রেতার উপস্থিত থাকা, স্বাক্ষর ও টিপসই ও তারিখ নিশ্চিত করা।
(৩) নিজ নামে দলিল সম্পাদন ও রেজিষ্ট্রি করা।
(৪) দলিল রেজিষ্ট্রির রশিদ সংগ্রহ করা ও যত্নসহকারে তা সংরক্ষণ করা।
(৫) ক্রেতা-বিক্রেতার পাসপোর্ট সাইজের ছবি জমা দেওয়া।
(৬) বিক্রেতার ক্রমানুসারে ২৫ বছরের মালিকের ইতিহাস দেখা।
(৭) জমির চৌহদ্দি সঠিকভাবে দেখা।
(৮) বিক্রেতার নামে নামজারির কপি এবং আরএস পর্চা উপস্থাপন করা।

জমি কেনার পর করণীয়

(১) রেজিষ্ট্রিকৃত জমি দখল করা।
(২) নিজ নামে খারিজ করা।
(৩) নিজ নামে খাজনা দিয়ে রশিদ সংগ্রহ করা ও যত্নসহকারে সংরক্ষণ করে রাখা।
(৪) রশিদ জমা দিয়ে সাবরেজিষ্ট্রি অফিস থেকে মূল দলিল সংগ্রহ করা।
(৫) জমির সকল কাগজপত্র যত্নসহকারে রাখা।

জাল দলিল

দলিল অনেক সময় জাল হয়ে থাকে। কারণ, অসাধু ব্যক্তিবর্গ নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য অনৈতিক পন্থা ব্যবহার করে থাকে। তবে জাল দলিল সম্পাদন করলে রয়েছে উপযুক্ত শাস্তির বিধান। কারণ জাল দলিল ব্যবহার করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে শৃংখলা ভঙ্গের কাজে নিয়োজিত করা হয়ে থাকে।

অনেক সময় দেখা যায়, মালিকের ছদ্মবেশে কাউকে মালিক সাজিয়ে জমি সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে কিছু অতি মুনাফালোভী অসৎ কর্মচারীর যোগসাজশে দলিল জাল করে থাকে। এক্ষেত্রে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের সিল-সইও ভুয়া হতে পারে বা দলিল সম্পাদনকারীদের সই ও সিল জালিয়াতি করে দলিল জাল হতে পারে।

আবার বণ্টননামার ক্ষেত্রে সহ-শরিকদের অজান্তে ভুয়া বণ্টননামা করে দলিল জাল করতে পারে। সাধারণত যেসব ক্ষেত্রে আদালত থেকে বণ্টননামা সম্পন্ন করা হয় না, সে ক্ষেত্রে দলিল জালের সম্ভাবনা বেশি থাকে। গ্রামের লেখাপড়া না জানা লোকদের বিভিন্ন প্রয়োজনে অনেক সময় তাদের স্বাক্ষর জালিয়াতি করা হয়।

অনেক সময় জমির মালিক বিদেশে থাকলে মূল দলিল থেকে জালিয়াতি করা হতে পারে বা অনেক সময় ঘষামাজা করে এবং ওভাররাইটিং বা কাটাছেঁড়া করেও দলিল জাল করতে পারে বা আবার মূল তারিখ ঠিক রেখে দলিলের বিষয়বস্তু জাল করতে পারে।

নিম্নলিখিত উপায়ে জাল দলিল সনাক্ত করা যেতে পারে

১। বিক্রেতার কাছ থেকে ভায়া দলিল চেয়ে নিয়ে সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে দলিলের ক্রমিক নম্বর, দলিল নম্বর ঠিক আছে কি না যাচাই করে।
২। দলিল নিয়ে সন্দেহ হলে প্রথমে রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে দেখতে হবে যে, দলিলটির রেজিস্ট্রি কার্যক্রম শেষ হয়েছে কি-না ।
৩। সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিস থেকে সংশ্লিষ্ট দলিলে উল্লিখিত জমির মিউটেশন বা নামজারিতে ধারাবাহিকতা ঠিক আছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
৪। রেজিস্ট্রি অফিসে বা ভূমি অফিসে গিয়ে বিভিন্ন সীল পরীক্ষা পরীক্ষা করেও জালিয়াতি নির্ণয় করা যায়।
৫। একাধিক মালিকের ক্ষেত্রে সরেজমিনে গিয়ে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে মূল মালিক কে, তা নির্ণয় করতে হবে
৬। স্বাক্ষর জালিয়াতি করে দলিলদাতা বা গ্রহীতার সাজানো হয়।এ ক্ষেত্রে স্বাক্ষর বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে স্বাক্ষরের সত্যতা যাচাই করিয়ে নেওয়া যেতে পারে। ভালো করে তারিখ, কাগজ, সিল ইত্যাদি যাচাই।
৭। জরিপ খতিয়ানে জমির পরিমাণ পরবর্তী সময়ে যতবার বিক্রি হয়েছে, তার সঙ্গে জমির দাগ নম্বর, ঠিকানা এসব ঠিক আছে কি না,পরীক্ষা করা।
৮। দলিলটি “হেবার ঘোষণাপত্র” বা “দানের ঘোষণাপত্র” হলে সেক্ষেত্রে দাতা-গ্রহিতার সম্পর্ক যাচাই করা।
৯। দলিলটি সাম্প্রতিক রেজিস্ট্রিকৃত পাওয়ার অব অ্যাটর্ণি দলিল হলে সেটি নির্দিষ্ট ফরমেটে প্রস্তুত কিনা যাচাই করা।
১০। স্টাম্প-ভেন্ডার মাধ্যমে স্টাম্প ক্রেতার নাম ও ব্যবহৃত নম্বর পরীক্ষা করে।

দলিল জালের শাস্তি এবং প্রতিকার

দলিল জাল-জালিয়াতি করা হলে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে ২ ধরনের প্রতিকার রয়েছে।

১। ফৌজদারী আদালতে জালিয়াতির সাজা

জালিয়াতির মাধ্যমে কোনো দলিল সম্পাদন করে লোক ঠকানো, প্রতারণা বা অন্যায়মূলক কাজে সহায়তাদান আইনের দৃষ্টিতে একটি গুরুতর অপরাধ। দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ৪০৬/৪২০ এবং ৪৬৩ থেকে ৪৭৭ ধারা পর্যন্ত জালিয়াতি সম্পর্কে বিস্তারিত বলা আছে এবং দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান রয়েছে।

দণ্ডবিধির ১৮৬০ এর ৪৬৩ ধারা অনুযায়ী জালিয়াতির অপরাধের আবশ্যকীয় উপাদান দুটি- প্রথমত, মিথ্যা দলিল প্রস্তুত করা। দ্বিতীয়ত, প্রতারণামূলক ইচ্ছা নিয়ে কোন ব্যক্তিকে ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে উহা করা। [42 DLR 238] কোনো লোকের ক্ষতি বা অনিষ্ট করার উদ্দেশ্যে মিথ্যা দলিল তৈরী করা। মিথ্যা দাবি বা স্বত্বকে সমর্থনের জন্য এই ধরনের দলিল সৃষ্টি করা হয়।

দণ্ডবিধির ১৮৬০ এর ৪৬৪ ধারায় মিথ্যা দলিল প্রণয়নের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে,

প্রথমত, কোনো দলিল কিংবা অংশবিশেষ এমন ব্যক্তি কর্তৃক প্রণীত স্বাক্ষরিত, সিলমোহরকৃত বা সম্পাদিত বলে বিশ্বাস জন্মানোর উদ্দেশ্যে, যা প্রকৃত ব্যক্তি কর্তৃক সম্পাদিত হয়নি;

দ্বিতীয়ত, কোনো ব্যক্তি কর্তৃক দলিল সম্পাদিত হওয়ার পর প্রতারণামূলক ভাবে বাতিল করে; তৃতীয়ত, যদি কোনো ব্যক্তি প্রতারণামূলক কোনো মাতাল বা মানসিক বিকারগ্রস্থ ব্যক্তি দ্বারা কোন দলিল স্বাক্ষরিত, সিলমোহর বা পরিবর্তন করান, যা বুঝতে অক্ষম, তা হলে এ ক্ষেত্রগুলোতে দলিল জালিয়াতি করা হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হবে।

এ ধারার দুটো ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি তাঁর নিজ নাম স্বাক্ষর করলেও যদি অন্য ব্যক্তির স্বাক্ষর হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তাহলে জালিয়াতি হতে পারে। মৃত লোকের নামে মিথ্যা দলিল প্রণয়ন করা হলে জালিয়াতি হিসেবে গণ্য হবে।

[42 DLR 191] মনু মিয়া বনাম রাষ্ট্র মামলায় বলা হয়েছে, কোনো দলিলকে জাল বলতে হলে অবশ্যই তা অসৎ ও প্রতারণার উদ্দেশ্যে সম্পাদিত হতে হবে। কেননা অপরকে প্রতারিত করার অসৎ উদ্দেশ্যে কোন দলিল সম্পাদন করলে উহাকে জালিয়াতি বলা যায়।

দণ্ডবিধির ১৮৬০ এর ৪৬৫ ধারায় জালিয়াতির শাস্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি জালিয়াতি করেন, তাহলে ওই ব্যক্তি দু বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ডসহ উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে পারেন।

দণ্ডবিধির ১৮৬০ এর ৪৬৬ ধারা অনুযায়ী আদালতে নথি বা সরকারি রেজিষ্টার ইত্যাদিতে জালিয়াতির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি বিচারালয়ের নথিপত্র বা মামলার বিবরণী বলে গণ্য কোনো দলিল বা জন্মনামকরণ বিয়ে বা শবসংক্রান্ত রেজিষ্টার হিসাবে গণ্য বা বা সরকারি সার্টিফিকেট জাল করেন অথবা মামলার কোনো রায়ের কপি জাল করেন, তাহলে দায়ী ব্যক্তি সাত বছর পর্যন্ত মেয়াদের কারাদণ্ডসহ অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন। এ অপরাধ জামিনযোগ্য নয়।

দণ্ডবিধির ১৮৬০ এর ৪৬৭ ধারানুয়ায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি মূল্যবান জামানত, উইল প্রভৃতি জাল করেন, তাহলে ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডসহ অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন। [19 DLR 862] দণ্ডবিধির ১৮৬০ এর ৪৬৭ ধারার অধীন দণ্ডনীয় অপরাধ এ রকম জালিয়াতিতে সহায়তার কারণেও হতে পারে। দণ্ডবিধির ১৮৬০ এর ৪৭০ ও ৪৭১ ধারা অনুযায়ী, জাল বা মিথ্যা দলিল হচ্ছে, যে দলিল জাল প্রক্রিয়ায় সম্পাদন করা হয়েছে এবং যদি কোনো ব্যক্তি প্রতারণামূলকভাবে কোনো জাল দলিল জেনে শুনে মূল দলিল হিসেবে ব্যবহার করেন, তাহলে তিনি দায়ী হবেন এবং দলিল জালিয়াতির অপরাধে দন্ডিত হবেন।

দণ্ডবিধির ১৮৬০ এর ৪৭৪ ধারায় বলা হয়েছে, ৪৬৬ ও ৪৬৭ ধারানুযায়ী প্রতারণার উদ্দেশ্যে জালিয়াতির জন্য সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডসহ জরিমানার বিধান আছে।

ফৌজদারী কার্যবিধি ১৮৯৮ এর ১৯৫(১) ধারানুযায়ী, কোনো আদালত এমন কোনো অপরাধের প্রতিকার আমলে নেবেন না, যা কোনো দলিল সম্পর্কে কোনো অপরাধ সংঘটিত করেছে বলে অভিযোগ করা হয়, যা কোনো আদালতে বিচারধীন। অর্থাৎ জালিয়াতি সংক্রান্ত কোনো বিচার কার্যচলাকালে আদালতের লিখিত অভিযোগ ব্যতীত কোনো দলিল জালিয়াতি-সংক্রান্ত ধারার অধীন অপরাধের বিচার অন্য আদালত করতে পারেন না।

২। দেওয়ানি আদালতে প্রতিকার

কোন ব্যক্তি নিশ্চিত হন যে দলিলটি জাল এবং তিনি উক্তজাল দলিলটি বাতিল এবং অকার্যকর হিসেবে ঘোষণা করতে চান তাহলে দেওয়ানি আদালতের বিধান অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৩৯ ধারা মোতাবেক দলিল বাতিলের মোকদ্দমা করতে হবে।

এই আইনে বলা হয়েছে- কোনো ব্যক্তি, যার বিরুদ্ধে লিখিত দলিলটি জাল, বাতিল বা বাতিল যোগ্য যা বলবত থাকলে তার গুরুতর ক্ষতির কারণ হতে পারে এমন অবস্থায় তিনি তা বাতিল বা বাতিলযোগ্য ঘোষণার জন্য সরাসরি দলিল বাতিলের মামলা দায়ের করতে পারেন এবং আদালত তার ইচ্ছাধীন ক্ষমতার বলে তেমন রায় প্রদান করতে এবং চুক্তি বিলুপ্ত হিসেবে বাতিল করার নির্দেশ প্রদান করতে পারেন।

এই ধারা অনুযায়ী প্রতিকার পেতে হলে যে বিষয়গুলো প্রমাণ করতে হয় তা হলো:

১. দলিলটি জাল, বাতিল বা বাতিলযোগ্য,
২. দলিলটি বাতিল না হলে বাদীর অপূরণীয় ক্ষতির আশংকা,
৩. আদালত ন্যায় বিচারের স্বার্থে তা বাতিল করতে সক্ষম।

সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৩৯ ধারা মতে বাদী যদি কোনো সম্পত্তি দখলে থাকাকালীন বিবাদী কর্তৃক বা অন্য কোনো মাধ্যমে সত্ব দখল বিহীন অবস্থায় কোনো জাল দলিল সম্পাদন করে প্রতারনার আশ্রয় নেয় তাহলে বাদী সরাসরি দলিলটি বাতিলের আদেশ চাইতে পারে।

সাক্ষ্য আইন ১০১ ধারা এবং [26 DLR 392] যিনি কোন দলিলকে জাল বা জোর পূর্বকভাবে দলিল সম্পাদিত হয়েছে বলে দাবি করবেন তাকে তার দাবির সত্যতা প্রমাণ করতে হবে। তামদি আইন ১ম তফসিলের ৯১ অনুযায়ী জাল দলিল সম্পর্কে জানার ৩ বছরের মধ্যে ঐ দলিল বাতিলের মামলা করতে হাবে। নচেৎ তা তামাদি দোষে বাতিল হবে।

অপরদিকে, বাদী যদি ভুয়া বা জাল দলিলের মাধ্যমে সম্পত্তি থেকে বেদখল হয় তাহলে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৮ ধারা অনুযায়ী স্বত্ব সাব্যস্তে খাস দখলের মামলা করতে পারে এবং আর্জির প্রার্থনায় দফায় দলিলটি বাতিল চাইতে পারে। এর সঙ্গে এই আইনের ৪২ ধারায় পৃথক ঘোষণাও চাইতে পারে।

কোর্ট ফি

কোর্ট ফি আইন ৭(৪) (গ) ধারা অনুযায়ী দলিল বাতিলের মামলা করার জন্য কোর্ট ফি আইনের দ্বিতীয় তফসিলে ১৭(৩) অনুচ্ছেদ উল্লিখিত হারে কোর্ট ফি প্রদান করতে হবে। দলিল বাতিলের মামলার সাথে অন্য প্রতিকার যেমন দখল পাবার প্রার্থনা ও করা যাবে তবে এর জন্য অতিরিক্ত কোর্ট ফি দিতে হবে।

মন্তব্য

জেনে রাখা ভাল, জালিয়াতির প্রতিকার দেওয়ানি আইনে চাইলে দন্ডবিধি আইনে মামলা চলবে না একই বিষয়ে দুটি পৃথক আদালতে মামলা-মোকদ্দমা চলবে না। কারণ এতে রেস-জুডিকাটা দোষে মামলাটি বাতিল হতে পারে। তবে জালিয়াতি-সংক্রান্ত কোনো কারণে যদি দেওয়ানি আদালতে দলিল বাতিলসহ স্বত্ব দখলের প্রতিকার কিংবা এ মর্মে ঘোষণামূলক প্রতিকার চাওয়া হয়।

পরিশেষে বলা যায়, কোন দলিলের মাধ্যমে সম্পত্তি বা জমি ক্রয় বিক্রয় বা ভাড়া নেয়ার আগে অবশ্যই দলিলটি যাচাই করে নেয়া আবশ্যক। আমাদের দেশের সহজ-সরল নিরীহ জনসাধারণ সরল বিশ্বাস এবং আইন সম্পর্কে না জানার কারণে কিছু অসৎ এবং দুষ্ট প্রকৃতির অতি মুনাফালোভী ব্যক্তিদের প্ররোচনায় জায়গা ক্রয়-বিক্রয় করে প্রতারিত হচ্ছে। তাই সকলের জায়গা-জমি ক্রয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।

লেখক: আইনজীবী, জজ কোর্ট, চট্টগ্রাম।