অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

ভিন্ন ধর্মে দুজনের বিয়ে হলেও কারও ধর্ম বদলায় না

সিরাজ প্রামানিক

ভিন্ন ধর্মের দুজনের বিয়ে হলে বিয়ের পর স্বামীর ধর্মবিশ্বাস পালন করতে কোনো নারীকে বাধ্য করা যায় না। এ ক্ষেত্রে স্ত্রী কোন ধর্ম পালন করবেন তা তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। এক পার্সি নারীর দায়ের করা মামলায় ৭ ডিসেম্বর’২০১৭ এ রায় দেন ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত সাংবিধানিক বেঞ্চ।

গুলরোখ এম গুপ্তা নামের ওই পার্সি নারী হিন্দু এক ব্যক্তিকে বিয়ে করেছিলেন। এরপর তাঁকে তাঁর বাবা-মায়ের শেষকৃত্যে যোগ দিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে পার্সিদের সংগঠন ‘ভালসাদ জোরোয়াস্ট্রিয়ান ট্রাস্ট’। ট্রাস্ট থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, ভিন্ন ধর্মে বিয়ে করে গুলরোখ ধর্মচ্যূত হয়েছেন। এ কারণে তিনি মা-বাবার শেষকৃত্যে যোগ দিতে পারবেন না। ট্রাস্টের এ নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে গুলরোখ মুম্বাই হাইকোর্টে আবেদন করেন। কিন্তু মুম্বাই হাইকোর্ট ট্রাস্টের নিষেধাজ্ঞাই বহাল রাখেন। এরপর মুম্বাই হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে গুলরোখ ভারতের সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন।

সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চে ওই মামলার শুনানি হয়। শুনানি শেষে আদালত ওই রায় দেন। রায়ে বলা হয়, আইনে কোথাও বলা নেই যে ভিন্ন ধর্মের দুজনের বিয়ে হলে স্ত্রীকে স্বামীর ধর্ম পালন করতে হবে। কোনোভাবেই স্বামীর ধর্মীয় আচার পালন স্ত্রীকে বাধ্য করা যায় না। স্ত্রী কোনো ধর্মীয় আচার পালন করবেন, সেটা একান্তই তাঁর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত।

মামলার শুনানিতেই আদালত স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট-এর প্রসঙ্গ তুলে মন্তব্য করে, দুই ভিন্ন ধর্মের পুরুষ-নারী বিয়ের পর নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় বজায় রাখতে পারেন। বিয়ের পর স্বামীর ধর্মই স্ত্রীর ধর্ম হবে, এ কথা আইন বলে না। পাশাপাশি, বাবা-মায়ের প্রতি তাঁর সন্তানদের আবেগকে গুরুত্ব দিয়ে এই নিয়ম শিথিল করার জন্যও পার্সি সমাজকে পরামর্শ দেয় আদালত।

ব্রিটিশ শাসনামলেই ব্রিটিশরা এই আইনটি তৈরি করে গেছে। যে কোনো ধর্মের লোকই ‘বিশেষ বিবাহ আইন, ১৮৭২’ (সংশোধিত ২০০৭) অনুযায়ী তার নিজ ধর্মের বাইরে যে কোনো ধর্মাবলম্বীকে ‘বিশেষ বিবাহ’ করতে পারবে। যে ব্যক্তি মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, ইহুদি, পার্সি, বৌদ্ধ, শিখ বা জৈন এর কোনো একটির অনুসারী কিন্তু সে নিজ ধর্ম ভিন্ন অন্য ধর্মের কাউকে বিয়ে করতে চায়, সে ‘বিশেষ বিবাহ আইন, ১৮৭২’-এর অধীনে বিয়ে করতে পারে।

এই বিয়ে কাদের জন্য প্রযোজ্য, বিয়ে অনুষ্ঠানের শর্তাবলি কী, সম্পাদনের পদ্ধতি কী, কার দ্বারা এ বিয়ে সম্পাদিত হবে, এ বিয়ের ফলে জন্ম নেয়া সন্তান কোন ধর্মের পরিচয়ে বড় হবে, এ বিয়ের স্বামী বা স্ত্রী কোন ধর্ম অনুসরণ করবেন, এ বিয়ের ফলে উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে কে কতটুকু ভোগ করতে পারবেন তা নিয়ে নি¤েœ বিস্তারিত আলোচনা করা হল।

বিশেষ বিবাহ আইন, ১৮৭২-এর ২ ধারা অনুযায়ী বিয়ে অনুষ্ঠানের বেশ কিছু শর্ত রয়েছে।

প্রথমত : বিয়ের সময় বিয়ের পক্ষগণের মধ্যে কারো কোনো জীবিত স্বামী বা স্ত্রী থাকতে পারবে না, অর্থাৎ, স্বামী বা স্ত্রী থাকা অবস্থায় কেউ বিশেষ বিবাহ আইনের অধীন বিশেষ বিবাহ করতে পারবে না।

দ্বিতীয়ত : বিবাহ করতে ইচ্ছুক পুরুষ ব্যক্তির বয়স ২১ বছর এবং নারীর বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হতে হবে।

তৃতীয়ত : পক্ষগণ রক্ত সম্পর্কে বা বৈবাহিক সম্পর্কে সম্পর্কযুক্ত হতে পারবে না। যাতে তাদের একজনের ওপর প্রযোজ্য আইন দ্বারা ওই বিবাহ অবৈধ হতে পারে। বিশেষ করে এ ক্ষেত্রে নোটিশ অত্যন্ত জরুরি। ১৮৭২-এর ৪ ধারায় বলা আছে, বিয়ের দুই পক্ষের মধ্যে যেকোনো একটি পক্ষ রেজিস্ট্রারের কাছে ১৪ দিন আগে বিয়ের নোটিশ পাঠাবেন। যদি এই সময়ের মধ্যে কেউ আপত্তি না করে তবে বিয়ে সম্পন্ন করা যাবে।

বিশেষ বিবাহ আইন, ১৮৭২-এর অধীন বিয়ে একটি দেওয়ানি চুক্তি সুতরাং সম্মতি অত্যন্ত জরুরি। এর ১১ ধারায় বলা আছে, বিয়ে সম্পন্ন করতে হবে রেজিস্ট্রার এবং ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরদানকারী তিনজন সাক্ষীর সামনে। বিয়ের দুই পক্ষ রেজিস্ট্রার ও তিনজন সাক্ষীর সামনে- “আমি ‘ক’ কে আইনত স্ত্রী/স্বামী হিসেবে গ্রহণ করছি- এই রকম ঘোষণা দেওয়ার সময়, ইসলাম ধর্মে ক্ষেত্রে নারী সাক্ষী হলে হবে না। এমনকি দুজন নারী স্বাক্ষীও গ্রহণযোগ্য নয়। স্বাক্ষী ঠিকঠাক থাকলে এই আইনের অধীনে অনুষ্ঠিত বিয়ে রেজিস্ট্রি করা হয় এবং এ জন্য নির্দিষ্ট রেজিস্ট্রির বই আছে। তিনজন সাক্ষী আর পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে হাজির হতে হবে। আর দুই কপি ছবি সাথে পরচিয়পত্রের ফটোকপি। তারপর এতেই হয়ে যাবে দুজনের বিয়ে। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা পালন না করলে বিয়েটি বাতিল হয়ে যাবে। ১১ ধারার বিধানাবলী বাধ্যতামূলক করা হয়েছে [১৮ ডিএলআর (১৯৬৬) পাতা ৫০৯]।

উত্তরাধিকার
তবে এ ধরনের বিয়ের ফলে বেড়ে উঠছে নতুন একটি প্রজন্ম। যারা উত্তরাধিকার সূত্রে কোনো নির্দিষ্ট ধর্মীয় পরিচয় বহন করছে না। এই উত্তরাধিকারীদের মধ্যে আবার কেউ কেউ একটি ধর্ম বেছে নিচ্ছে। তবে রাষ্ট্র আইন করে এমন বিয়ের ব্যবস্থা করলেও এইসব পরিবারের সম্পত্তি বন্টনের জন্য কোন আইন নেই। বাংলাদেশে ইসলাম, হিন্দু ও খৃষ্টান ধর্মীয় আইনে সম্পত্তি ভাগ হয়। কিন্তু এই পরিবারের সম্পত্তি যদি বাবা-মা ভাগ করে দিয়ে না যান বা উইল না করেন, তবে ভাগ করার কোন নিয়ম নেই।

যেখানে অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ বিবাহ
সরকারিভাবে এমন বিয়ে হওয়ার একমাত্র স্থান পুরনো ঢাকার পাটুয়াটুলিতে। সরকার নিযুক্ত প্রাণেশ সমাদ্দার নামের একজন এধরণের বিয়ের রেজিষ্ট্রার হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন এতোদিন। তাঁর অবর্তমানে এখন অন্য একজন একই জায়গায় এই কাজ করছেন। প্রানেশ সমাদ্দার ছিলেন শরৎচন্দ্র ব্রাহ্ম প্রচারক নিবাসের আর্চায ও ট্রাস্ট। তিনি সেখানেই থাকতেন।

শুধু ঢাকা নয় দেশের অন্যান্য জেলা থেকেও ছেলেমেয়েরা আসে বিয়ে করতে। বিশেষ করে যারা দেশের বাইরে যেতে চায় তাদের আসতইে হয়। কারণ কোর্টে বিয়ে করলে বিয়ে রেজিষ্ট্রির কোন প্রমাণপত্র পাওয়া যায় না। অবশ্য কোর্টে দুই ধর্মের দু’জন বিয়ে করতে পারে না। অনেক সময় যারা জানে না তারা প্রথমে কোর্টে যায়। আর তখন আইনজীবীরা এখানে নিয়ে আসেন। একটি মজার এবং ব্যতিক্রমী বিষয় হচ্ছে বিশেষ বিবাহের সবকিছুই যখন এই আইনের অধীনে হচ্ছে, তখন বিবাহ বিচ্ছেদটা হচ্ছে অন্য আইনের অধীন। বিশেষ বিবাহ আইনের ১৭ ধারায় বলা আছে এই আইনের অধীনে বিয়ে করলে বিয়ে বিচ্ছেদের সময় ১৮৬৯ সালের ‘ডিভোর্স আইনের’ মাধ্যমে বিচ্ছেদ সম্পাদন করতে হয়। পুরোপুরি না হলেও এই আইনে কিছুটা নারী-পুরুষের সমতা রয়েছে। সুতরাং এখানেও একটি স্বতন্ত্র পারিবারিক আইন অনুসরণ করতে হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, ১৮৬৯ সালের ডিভোর্স অ্যাক্ট খ্রিস্টানদের ডিভোর্সের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

জন্মগ্রহণকারী সন্তানের বিবাহ
এ আইনের অধীনে বিয়ের ফলে জন্মগ্রহণকারী সন্তান যদি এ আইনের অধীনেই বিয়ের ইচ্ছা পোষণ করেন, তবে তার পিতা বিয়ের ক্ষেত্রে যে আইনে রক্ত-সম্পর্কীয় ও বৈবাহিক সম্পর্কীয় বাধার সম্মুখীন ছিলেন, সে আইন এবং এ আইনের ২ ধারা তাঁর ওপর প্রযোজ্য হবে। এ আইনের কোনো কিছুই এ আইনের অধীনে বিয়ের ফলে জন্মগ্রহণকারী সন্তানের অন্য কোনো আইনে সম্পাদিত বিয়ের বৈধতা ক্ষুণœ করবে না।

মিথ্যা বর্ণনা-সংবলিত ঘোষণার প্রত্যয়নপত্র স্বাক্ষরের শাস্তি
এ আইন দ্বারা নির্দেশিত কোনো ঘোষণা বা প্রত্যয়নপত্র তৈরি করেন, স্বাক্ষর করেন বা সত্যায়ন করেন, যা মিথ্যা বর্ণনা, এবং তিনি জানেন ও বিশ্বাস করেন মিথ্যা বলে, বা সত্য বলে বিশ্বাস করেন না, এমন কোনো ব্যক্তি দন্ডবিধির ১৯৯ ধারায় অপরাধী বলে বিবেচিত হবেন।

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী ও আইন গ্রন্থ প্রণেতা।