নির্যাতিত নারী-শিশুর নিরাপত্তা হেফাজত, ন্যায়বিচার ও বাস্তবতা

সিরাজ প্রামাণিক প্রায় ১৬০০ বছর আগে মহান দার্শনিক প্লেটো লিখেছিলেন, “যদি আইন হয় সরকারের প্রভু আর সরকার হয় আইনের দাস, তখন সবকিছুতে একটা প্রতিশ্রুতি থাকে এবং তখন নাগরিক একটি রাষ্ট্রে ঈশ্বরের ঢেলে দেয়া পুরো রহমত উপভোগ করে”।

এবার আসল কথায় আসি। ‘রংপুরে তরুণীকে ১০ দিন আটকে রেখে ধর্ষণ করেছে যুবলীগ নেতা’ শিরোনামে ৪ জুন’২০১০ একটি দৈনিক পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। রংপুরের কাউনিয়া উপজেলায় ১৯ মে এ ঘটনা ঘটে। প্রতিবেদনে ২২ বছরের এক তরুণীকে অপহরণের পর আটকে রেখে ধর্ষণের কথা বলা হয়। আটক অবস্থা থেকে পালিয়ে ধর্ষণের শিকার ওই তরুণী ৩১ মে কাউনিয়া থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। ওই দিন রংপুর মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে তাঁর ডাক্তারি পরীক্ষা হয়। পুলিশ ধর্ষণের শিকার তরুণীকে কারাগারে নিরাপদ হেফাজতে রাখার আবেদন করলে বিচারক তাঁকে কেন্দ্রীয় কারাগারের নিরাপত্তা হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন।

নিরাপত্তা হেফাজতের নামে নির্যাতিতদের কারাগারে আটক রাখা মানবাধিকারের লঙ্ঘন। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের তিন আইনজীবী রিট করেন। রিটে বলা হয়, হেফাজতের নামে কারাগারে আটক রাখা মানে দ্বিতীয় দফা নির্যাতন করা। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীনে দায়ের করা মামলায় ট্রাইব্যুনাল কেবল নির্যাতিত ব্যক্তিকে কারাগারের বাইরে নিরাপত্তা হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিতে পারেন। ম্যাজিস্ট্রেটের নির্যাতিতকে নিরাপত্তা হেফাজতে এবং একইসঙ্গে নিরাপত্তা হেফাজতের নামে কারাগারে পাঠানোর এখতিয়ার নেই। মেয়েটি অভিযুক্ত নয়, কিন্তু তাঁকে দণ্ডিত ও অভিযুক্তদের সঙ্গে রাখা হয়েছে। যা নির্যাতনের পর্যায়ে পড়ে। অথচ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে এখনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে আদালতের নির্দেশনা প্রয়োজন। প্রাথমিক শুনানি গ্রহণ করে আদালত নিরাপত্তা হেফাজতের নামে নির্যাতিত ব্যক্তিকে (ভিকটিম) কারাগারে আটক রাখা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারিসহ পাঁচ দফা নির্দেশনা দেন।

ন্যায়বিচার পাওয়া প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার। কিন্তু অনেক সময় অপরাধের বিচার চেয়ে মামলা দায়েরের পর মামলার বাদী নিরাপত্তাহীনতা, ভীতি ও আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করেন। কারণ আসামি পক্ষ বেশির ভাগ সময় সামাজিকভাবে অনেক প্রভাবশালী হয়ে থাকে। এ কারণে বাদীকে প্রাণনাশ এবং গুম হওয়ার আশঙ্কায় রাষ্ট্রীয় আশ্রয়ে থাকতে হয়। যাকে আইনের দৃষ্টিতে নিরাপত্তা হেফাজত বলা হয়। বাংলাদেশে প্রচলিত ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন এবং ২০১৩ সালের শিশু আইনে ‘সেফ কাস্টডি’ বা নিরাপত্তা হেফাজতের বিধান উল্লেখ রয়েছে।

নিরাপত্তা হেফাজত কোনো কারাগারে নয়, বরং সরকার-প্রত্যায়িত কোনো বিশেষ স্থান কিংবা কোনো বেসরকারি সংস্থা এমনকি কোনো ব্যক্তির হেফাজতও হতে পারে। তবে এটি নির্ধারণ করেন আদালত। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৩১ ধারায় বলা হয়েছে, এই আইনের অধীন কোনো অপরাধের বিচার চলাকালে ট্রাইব্যুনাল যদি মনে করেন, কোনো নারী বা শিশুকে নিরাপত্তা হেফাজতে রাখা প্রয়োজন; তাহলে ট্রাইব্যুনাল উক্ত নারী বা শিশুকে কারাগারের বাইরে ও সরকার কর্তৃক এই উদ্দেশে নির্ধারিত স্থানে সরকারি কর্তৃপক্ষের হেফাজতে বা ট্রাইব্যুনালের বিবেচনায় যথাযথ অন্য কোনো ব্যক্তি বা সংস্থার হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিতে পারেন। তবে এ আইনের ২০ ধারার ৮ উপ-ধারা মতে, কোনো নারী বা শিশুকে নিরাপত্তা হেফাজতে রাখার আদেশ প্রদানের ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল উক্ত নারী বা শিশুর কল্যাণ ও স্বার্থ রক্ষার্থে তার মতামত গ্রহণ ও বিবেচনা করবেন। সুতরাং নিরাপত্তা হেফাজতে প্রদানের ব্যাপারে আদালত অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির ইচ্ছার মূল্যায়ন করবেন। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির যদি সরকার কর্তৃক প্রত্যায়িত কোনো স্থানে থাকতে রাজি না হয়, তাহলে তার ইচ্ছা অনুসারেই তাকে কোনো এনজিও কিংবা কোনো আত্মীয়র কাছেও সোপর্দ করা যেতে পারে।

তবে কোন বালিকার জিম্মা বা তত্ত্বাবধান বিষয়ে উচ্চ আদালতের একটি সিদ্ধান্ত রয়েছে, যা ৩৫ ডিএলআর ৩১৫ পৃষ্ঠায় সংযোজিত হয়েছে। সিদ্ধান্তটি এরকম যে, কোন মেয়ের বয়স ১৬ বছর উত্তীর্ণ হলে তার তত্ত্বাবধান বা জিম্মার বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। সে কোন আসামী বা সাক্ষী না হওয়ায় তাকে আদালতের আদেশে কারাগৃহে বা আটকাবস্থায় রাখা যায় না। এমতাবস্থায় তাকে তার ইচ্ছানুসারে খোনে অবস্থান করতে চায়, সেখানেই তাকে অবস্থানের জন্য মুক্তি প্রদান করতে হয়।

১৯৭৪ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন আইনকে সংশোধন করে ২০১৩ সালে শিশু আইন তৈরি করা হয়। এ আইনের অষ্টম অধ্যায়ে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র কিংবা প্রত্যায়িত প্রতিষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে এবং এসব স্থানে শিশু পরিচর্যায় ন্যূনতম মানদ- কী হবে তা বলা আছে। নয় বছরের কম বয়সী শিশুদের এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে নয়, বরং বিকল্প পরিচর্যার ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে তার মা-বাবার সঙ্গে তার পুনঃএকত্রীকরণের দিকটি গুরুত্ব দিতে হবে। বিভিন্ন বয়সী শিশুর আবাসনের ক্ষেত্রে এসব প্রতিষ্ঠানে পৃথক পৃথক ব্যবস্থা রাখতে হবে। শিশুর জিম্মাদারির দায়িত্ব যাকেই দেওয়া হোক না কেন তার ওপর আদালতের নিয়ন্ত্রণই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।

বাস্তবে অনেক সময় দেখা যায় যে বিভিন্ন ফৌজদারি মামলার ভিকটিম এবং কুড়িয়ে পাওয়া নারী-শিশু ও কিশোরীরা মামলার আসামি না হওয়া সত্ত্বেও তাদের অনেক সময় নিরাপত্তা হেফাজতের নামে কারাগারে আসামিদের সঙ্গে বসবাস করতে হয়। অথচ তারা তাদের অভিভাবকদের কাছে ফিরে যাবে কিংবা নিরাপত্তামূলক হেফাজতে তাদের রাখার সুব্যবস্থা করতে হবে। ১৯৯৬ সালে চট্টগ্রামের রাউজান থানার পুলিশ হেফাজতে নির্যাতিতা পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম জেলা কারাগারে নিহত গার্মেন্ট কর্মী সীমা চৌধুরীর ঘটনার মধ্য দিয়ে কারাগারে নিরাপত্তা হেফাজত যে কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, তার প্রমাণ মেলে। ভিকটিম সীমা চৌধুরী মামলার আসামি না হওয়া সত্ত্বেও তাকে নিরাপত্তা হেফাজতের নামে কারাগারে আসামিদের সঙ্গে রাখা হয়। মামলায় তাকে বাদী না করে পুলিশের বিরুদ্ধে মামলায় পুলিশকে বাদী এবং সাক্ষী করা হয়। ফলে আসামিরা খালাস পায়। সীমার মা এবং ভাইকে খবর না দিয়ে তার লাশ পুড়ে ফেলা হয়।

ভিকটিম নারী-শিশু কিংবা আইনের সংস্পর্শে আসা শিশুর ব্যাপারে সর্বপ্রথম লক্ষ্য হবে তাকে তার ঘরে ফিরে যেতে সাহায্য করা। তা সম্ভব না হলে তাকে নিরাপদ আবাসনে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে প্রণীত আইন ও সিডও সনদে নারী অধিকার এবং ২০১৩ সালের শিশু আইন শিশুদের যে অধিকার দিয়েছে তা থেকে কোনো নারী-শিশু যেন বঞ্চিত না হয় সেদিকে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে।

জুডিসিয়াল কাষ্টডি’র বিষয়ে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত রয়েছে, যা ৪৬ ডিএলআর পৃষ্ঠা ১০ এ সন্নিবেশিত আছে। সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, কোন অপরাধ সংঘটনের নিমিত্তে বন্দি আর কোন হতভাগ্য মেয়ের বন্দিবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এরকম বন্দি অবস্থায় রাখার অর্থ হলো এই যে, যাতে মেয়েটি তার স্বাধীন মতামত সৃষ্টি ও তার মনস্থির করতে পারে। অন্যদিকে আরেকটি কারণ হলো যাতে মেয়েটির মতামতের উপর বাহ্যিকভাবে অন্য কেউ প্রভাব বিস্তার করতে না পারে।

 

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা, গবেষক ও সম্পাদক-প্রকাশক দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল