নুসরাত জাহান রাফিকে থানায় তার বক্তব্য ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেয়ার অভিযোগে করা মামলায় সোনাগাজী মডেল থানার ওসি (প্রত্যাহার হওয়া) মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
আজ সোমবার (২৭ মে) বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মাদ আস সামশ জগলুল হোসেন পিবিআইয়ের প্রতিবেদন আমলে নিয়ে এ গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। গ্রেফতার সংক্রান্ত তামিল প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ১৭ জুন দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
যৌন হয়রানির শিকার নুসরাত রাফির বক্তব্যের ভিডিও ধারণ ও প্রচারের সত্যতা পাওয়ায় ওসির বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনের ২৬, ২৯ ও ৩১ ধারায় অভিযোগপত্র দাখিল করে পিবিআই। আজ অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে ওসির বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারির জন্য আবেদন জানায় মামলার বাদী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন।
ব্যারিষ্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন বলেন, গত ১৫ এপ্রিল ফেনীর সোনাগাজী মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (প্রত্যাহার) মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৬, ২৯ ও ৩১ ধারায় মামলা করা হয়।
পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ভিকটিম নুসরাতকে ওসির কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদের সময় তার দুই বান্ধবী নাসরিন সুলতানা, নিশাত সুলতানা এবং সেনাগাজীর পৌরসভার মেয়র অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। ভিকটিমের পরিবারের সদস্যরা পাশের কক্ষে বসা ছিলেন। ভিকটিমের দুই বান্ধবীর বক্তব্য অনুযায়ী ভিডিও ধারণ করার পূর্বে ওসি মোয়াজ্জেম মুখের নেকাব খুলতে নুসরাতকে বাধ্য এবং দফায় দফায় বিব্রতকর প্রশ্ন করেন। আপত্তি জানালে ওসি তাকে আশ্বস্ত করে বলেন্ত এ ভিডিওটি সম্পর্কে কেউ জানবে না। যৌন নিপীড়নের শিকার একজন ভিকটিমের সঙ্গে ওসির এরকম অমানবিক আচরণ অপেশাদারিত্বের পরিচয় বহন করে। ওসির এ পেশাগত অদক্ষ আচরণের ফলে রাফিকে আগুন দিয়ে হত্যার ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ এবং পুলিশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন হয়। জিজ্ঞাসাবাদে মোয়াজ্জেম জানান, মোবাইলটি অফিসের টেবিলে রেখে অজু করতে যান। এ সময় তার অজ্ঞাতে একটি বেসরকারি টিভির ফেনী প্রতিনিধি (সাংবাদিক) শেয়ারইট অ্যাপসের মাধ্যমে নিজের মোবাইলে নিয়ে নেন। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তা তার প্রতিবেদনে বলেছেন, ওসির এই বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য নয়। ওসি নিজেই স্বেচ্ছায় তার ব্যক্তিগত মোবাইল হতে ওই ভিডিও ক্লিপটি তার মোবাইলে পাঠায়। এছাড়া ওসির হোয়াটস অ্যাপ আইডি থেকে অন্য একটি আইডিতেও ভিডিওটি প্রেরণ করা হয়।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ওসির বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৬ ধারার (অনুমতি ব্যতীত পরিচিতি তথ্য সংগ্রহ, ব্যবহার, ইত্যাদির দণ্ড) অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। নুসরাত অগ্নিদগ্ধ হওয়ার পর ওই ভিডিওটি প্রচার করায় তার বিরুদ্ধে ২৯ ধারার (মানহানিকর তথ্য প্রকাশ, প্রচার, ইত্যাদি) অপরাধ প্রমাণিত। এছাড়া ওই ভিডিও ভাইরাল হয়ে সামাজিক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। যাতে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটার উপক্রম হওয়ায় তার বিরুদ্ধে ৩১ ধারার (আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো, ইত্যাদির অপরাধ ও দণ্ড) অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। প্রসঙ্গত ২৬ ধারায় ৫ বছর, ২৯ ধারায় তিন বছর এবং ৩১ ধারায় অপরাধের জন্য সাত বছর কারাদণ্ড, অর্থ দণ্ড এবং উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।
উল্লেখ্য, ২৭ মার্চ রাফিকে মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা শ্রেণিকক্ষে নিয়ে যৌন নিপীড়ন করেন। এমন অভিযোগ উঠলে দুজনকে থানায় নিয়ে যান ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। ওসি নিয়ম ভেঙে জেরা করতে নুসরাতের বক্তব্য ভিডিও করেন। মৌখিক অভিযোগ নেয়ার সময় দুই পুরুষের কণ্ঠ শোনা গেলেও সেখানে নুসরাত ছাড়া অন্য কোনো নারী বা তার আইনজীবী ছিলেন না। ভিডিওটি প্রকাশ হলে অধ্যক্ষ ও তার সহযোগীদের সঙ্গে ওসির সখ্যতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়।
ভিডিওতে দেখা যায়, থানার ওসির সামনে অঝোরে কাঁদছিলেন নুসরাত। সেই কান্নার ভিডিও করছিলেন সোনাগাজী থানার ওসি। নুসরাত তার মুখ দুই হাতে ঢেকে রেখেছিলেন। তাতেও ওসির আপত্তি। বারবারই ‘মুখ থেকে হাত সরাও, কান্না থামাও’ বলার পাশাপাশি তিনি এও বলেন, ‘এমন কিছু হয়নি যে এখনও তোমাকে কাঁদতে হবে।’
মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, ওসি মোয়াজ্জেম অনুমতি ছাড়া নিয়মবহির্ভূতভাবে নুসরাতকে জেরা এবং তা ভিডিও করেন। পরবর্তীতে ওই ভিডিও ফেসবুক ও ইউটিউবসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
ভিডিওতে দেখা যায় ওসি মোয়াজ্জেম অত্যন্ত অপমানজনক ও আপত্তিকর ভাষায় একের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছেন নুসরাতকে। নুসরাতের বুকে হাত দিয়ে শ্লীলতাহানি করা হয়েছে কি-না এমন প্রশ্নও করতে দেখা যায় ওসি মোয়াজ্জেমকে।
অধ্যক্ষের নিপীড়নের ঘটনায় রাফির মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন। এরপর গত ৬ এপ্রিল সকালে রাফি আলিম পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসায় যান। এ সময় মাদরাসার এক ছাত্রী তার বান্ধবী নিশাতকে ছাদের ওপর কেউ মারধর করছে- এমন সংবাদ দিলে তিনি ওই বিল্ডিংয়ের চার তলায় যান। সেখানে মুখোশ পরা চার-পাঁচজন তাকে অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে মামলা ও অভিযোগ তুলে নিতে চাপ দেয়। রাফি অস্বীকৃতি জানালে তারা তার গায়ে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায়।
গত ১০ এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নুসরাতের মৃত্যু হয়।